ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৫ মে ২০২৫, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

আর্সেনিকপ্রবণ এলাকায় নিরাপদ ধান উৎপাদনে সাফল্য

স্টাফ রিপোর্টার, যশোর অফিস

প্রকাশিত: ২০:৫৮, ২৪ মে ২০২৫

আর্সেনিকপ্রবণ এলাকায় নিরাপদ ধান উৎপাদনে সাফল্য

যশোর : জাপানের ন্যাশনাল অ্যাগ্রিকালচার এ ফুড রিসার্স ইনস্টিটিউট (নাবো) উদ্ভাবিত থ্রিএফফোরডি (তিনদিন ভেজানো ও চারদিন শুকনো) সেচ প্রদ্ধতিতে চৌগাছার মাডু

যশোর শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরের গ্রাম মাড়ুয়া। চৌগাছা উপজেলার কৃষিসমৃদ্ধ এই গ্রামে গত দুই দশকে গুপ্তঘাতক আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে প্রাণহানি ঘটেছে ৩০ জনের। অঙ্গহানি হয়েছে অনেকের। এ রোগে আক্রান্ত গ্রামটির বহু মানুষ। এ পরিস্থিতিতে খাবার পানির মাধ্যমে আর্সেনিক সংক্রমণ ঠেকাতে গ্রামটিতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেচের মাধ্যমে আর্সেনিক ছড়িয়ে পড়ছে ধানসহ অন্যান্য ফসলেও। চিত্র যখন এমন ভয়াল তখন জাপানের ন্যাশনাল অ্যাগ্রিকালচার এ- ফুড রিসার্স ইনস্টিটিউট (নারো) উদ্ভাবিত থ্রিএফফোরডি (তিনদিন ভেজানো ও চারদিন শুকনো) সেচ পদ্ধতি আশা জাগিয়েছে এ অঞ্চলের মানুষের। ন্যাচারাল প্রযুক্তির এই সেচ পদ্ধতি ব্যবহারে ধানে আর্সেনিকের মাত্রা ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমানোর পাশাপাশি কমিয়েছে সেচের পরিমাণ ও উৎপাদন খরচ। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়া ঠেকাতেও রাখবে ভূমিকা।

এবার প্রথমবারের মতো থ্রিএফফোরডি সেচ পদ্ধতি ব্যবহার করে ধান চাষকারী মাড়ুয়া গ্রামের তৌহিদুল ইসলাম নয়ন জানান, পাশাপাশি দুটি জমির একটিতে থ্রিএফফোরডি পদ্ধতিতে আর অন্যটিতে সাধারণ পদ্ধতিতে বোরো আবাদ করেছেন। তবে থ্রিএফফোরডি পদ্ধতি প্রয়োগ করে পেয়েছেন বেশি ফলন। উৎপাদন ব্যয়ও কমেছে তার।
থ্রিএফফোরডি পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদনে খরচ কম হওয়াতে ও পর্যায়ক্রমিক সেচ কৌশল ব্যবহার করে ধান চাষে আর্সেনিক মাত্রা কমানোয় সফলতা দেখা দেওয়াতে এই পদ্ধতিতে চাষাবাদে আগ্রহ দেখিয়েছে স্থানীয় কৃষক। মাড়ুয়া গ্রামের আর্সেনিকোসিস আক্রান্ত জব্বার আলী বলেন, ফসলেও যে আর্সেনিক থাকে জানা ছিল না। গতানুগতিক পদ্ধতির চেয়ে থ্রিএফফোরডি পদ্ধতিতে নয়নের জমিতে ফসল ভালো হয়েছে। তার সেচও কম লেগেছে। তাছাড়া যেহেতু এই পদ্ধতি আর্সেনিকের মাত্রা কম তাই আমিও এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করার উদ্যোগ নিচ্ছি।
এশিয়া আর্সেনিক নেটওয়ার্কের মাঠ সমন্বয়ক আবু হাসান বলেন, ‘মাড়ুয়া গ্রাম আর্সেনিকপ্রবণ এলাকা। এ এলাকায় আর্সেনিক সহনশীল খাদ্য উৎপাদনই আমদের মূল লক্ষ্য। এতদিন খাবার পানিতে আর্সেনিক বহন করলেও ফসলেও সেটি বহন করছে। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) কারিগরি সহায়তায় ‘নিরাপদ ও পুষ্টিকর ধান উৎপাদনের জন্য প্রজনন ও পানি ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তির উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় গবেষণা কার্যক্রমটি পরিচালিত হয়। কৃষকরা এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে অনেকটা সফল। সেচের পানির ব্যবহারও ৭০ শতাংশ পর্যন্ত সাশ্রয়ী ও ৪০ শতাংশ পর্যন্ত আর্সেনিক কম আসছে এই চাষাবাদে। সম্প্রতি এই প্রকল্পের সফলতা পরিদর্শনে আসেন জাইকা, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ প্রকল্পটির বাংলাদেশ প্রতিনিধিরাও। এ প্রতিনিধি দলের সদস্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম বলেন, উদ্ভাবিত সেচ পদ্ধতির মাধ্যমে চালে অজৈব আর্সেনিকের মাত্রা ৪০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস হবে। পাশাপাশি এ পদ্ধতির মাধ্যমে সেচের পানি ৬৫ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত সাশ্রয় হবে, ফলে কমবে উৎপাদন খরচ।
গবেষক ড. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশের অনেক এলাকার ভূগর্ভস্থ পানি আর্সেনিক দ্বারা দূষিত। অবিরাম জলাবদ্ধতার সময় ধান চাষ করলে চালের মধ্যে এই বিষাক্ত উপাদানের মাত্রা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যেতে পারে। কিন্তু থ্রিএফফোরডি পদ্ধতি ব্যবহার করে ফলন ব্যাহত না করেই নিরাপদ চাল উৎপাদন করতে পারেন। এই যুগান্তকারী আবিষ্কার শুধু আর্সেনিকের ঝুঁকি কমাতেই নয়, বরং সেচের পানির চাহিদাও ব্যাপকভাবে হ্রাস করে, ফলে ভূগর্ভস্থ পানিদূষণপ্রবণ অঞ্চলে জনস্বাস্থ্য রক্ষা ও টেকসই ধান উৎপাদনের এক বাস্তবভিত্তিক সমাধান হিসেবে এটি বিবেচিত হতে পারে।
জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর টাকিহিরো ক্যামিয়া সেনসি বলেন, ‘এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত ধানে আর্সেনিকের মাত্রা পাওয়া গেছে মাত্র দশমিক ২ শতাংশ, যা স্বাস্থ্যঝুঁকি সীমার নিচে।’  চৌগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুশাব্বির হোসাইন বলেন, উদ্ভাবিত এই সেচ পদ্ধতির ব্যবহার সম্প্রসারণ করা গেলে আর্সেনিকপ্রবণ এলাকায় নিরাপদ খাদ্যশস্য উৎপাদন নিশ্চিত হবে।  এ ব্যাপারে তারা ইতোমধ্যে উদ্যোগও নিয়েছেন। আর চৌগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা ইসলাম বলেন, কৃষি বিভাগের এ উদ্যোগ সফল করতে তারা সব ধরনের সহায়তা  দেবেন।

প্যানেল

×