ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২২ মে ২০২৫, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ধানের শীষ কুড়িয়ে প্রান্তিক মানুষের বেচেঁ থাকার সংগ্রাম

প্রদীপ রায় জিতু, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, বীরগঞ্জ

প্রকাশিত: ১৮:৪৫, ২১ মে ২০২৫; আপডেট: ১৮:৪৮, ২১ মে ২০২৫

ধানের শীষ কুড়িয়ে প্রান্তিক মানুষের বেচেঁ থাকার সংগ্রাম

ছবি: জনকণ্ঠ


 ধান কাটার মৌসুম শেষ হলেও দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন মাঠে এখনো সরব, তবে কৃষকদের নয়, হতদরিদ্র মানুষের পদচারণায়। আধুনিক যন্ত্রে দ্রুত ধান কেটে নেওয়ার পর মাঠজুড়ে পড়ে থাকে কিছু ছিটেফোঁটা শীষ। আর এই শীষ কুড়িয়ে প্রতিদিনের খাদ্যের ব্যবস্থা করছেন সেইসব মানুষ, যাদের হাতে নেই জমির মালিকানা, নেই স্থায়ী কোনো আয়ের উৎস।

প্রতিদিন ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই এইসব মানুষ, বিশেষ করে নারী-পুরুষ মিলে দলবদ্ধভাবে নামেন মাঠে। কারো হাতে কাস্তে, কারো হাতে পুরোনো পলিথিনের বস্তা। সূর্যের তাপ বাড়ার আগেই যতটা সম্ভব শীষ কুড়িয়ে নেওয়ার তাগিদ সবার চোখে মুখে স্পষ্ট।

বীরগঞ্জ পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মিনতি হেমব্রম (৬২) জানালেন, স্বামী হারিয়েছি বহু বছর আগে। এখন ছেলে-মেয়েদের নিয়েই দিন চলে। যন্ত্রে ধান কাটে বলে খুব বেশি কিছু পাওয়া যায় না, তবুও যেটুকু পাই, তাই দিয়েই চাল বানিয়ে দুবেলা খাওয়ার চেষ্টা করি।”
তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে হয়তো ৮-১০ কেজি শীষ কুড়াতে পারি। যদি ভাগ্য ভালো থাকে, তবেই কিছু বেশি হয়। জমি তো নেই, থাকতেও পারি না অন্যের জায়গায় বানানো একটা ছোট্ট টিনের ঘরে।

একই এলাকার বাসিন্দা হামিদা খাতুন (৩৫) বলেন, আজ সারাদিনে প্রায় ৫ কেজির মতো ধানের শীষ পেয়েছি। এগুলো সিদ্ধ করে চাল বানাবো। আমরা নিজেরা জমি চাষ করতে পারি না, স্বামী রিকশা চালায় কিন্তু প্রতিদিন কাজ জোটে না। বাড়িতে তিনটা ছোট ছেলে-মেয়ে নিয়ে কীভাবে চলে বলুন?

এই রকম পরিস্থিতি শুধু হামিদা বা মিনতির একার নয়। প্রতিদিন বহু নারী-পুরুষ এই কাজে নেমে পড়ছেন। তাদের কাছে এই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ধানের শীষই যেন হয়ে উঠেছে জীবনের শেষ ভরসা।

বীরগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে (২০২৪-২৫) উপজেলায় প্রায় ১৪ হাজার ৭৫৯ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রায় এক হাজার হেক্টরের বেশি জমির ধান কাটা শেষ হয়েছে, এবং আরও অনেক মাঠেই চলছে ধান কাটার কাজ।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, যন্ত্রে ধান কাটার পর জমিতে কিছু শীষ থেকে যায়, যেগুলো কৃষক সাধারণত সংগ্রহ করেন না। এই অব্যবহৃত ধানের শীষ কুড়িয়ে নিচ্ছেন দরিদ্র পরিবারগুলো, যারা এক সময়ের কৃষিভিত্তিক সমাজের বাইরের অংশ হয়ে পড়েছে। তাদের জন্য এটি কিছুটা হলেও সহায়তা হয়ে উঠেছে। ধান কাটার মৌসুম শেষে এসব ফেলে যাওয়া শীষ যেন এখন খাদ্য-নিরাপত্তার ক্ষুদ্র কিন্তু মূল্যবান এক উৎস হয়ে উঠেছে বীরগঞ্জের অসহায় ও দিনমজুর পরিবারের জন্য। তীব্র দারিদ্র্য আর জীবনযুদ্ধে প্রতিদিন বেঁচে থাকার সংগ্রামে এই শীষগুলোই তাদের আশা ও সাহস হয়ে দাঁড়িয়েছে। তুচ্ছ মনে হলেও এই শীষে জড়িয়ে আছে বহু জীবনের একমাত্র সম্ভাবনা।

সাব্বির

×