ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৩ মে ২০২৫, ২০ বৈশাখ ১৪৩২

অবকাঠামো নির্মাণ কাজ সমাপ্ত ॥ লোকবল নিয়োগ ও টিকিটিং ব্যবস্থা প্রচলনের অপেক্ষা

দর্শনার্থীদের অপেক্ষায় ঐতিহাসিক রোজ গার্ডেন

মনোয়ার হোসেন

প্রকাশিত: ০১:২২, ৩ মে ২০২৫

দর্শনার্থীদের অপেক্ষায় ঐতিহাসিক রোজ গার্ডেন

সংস্কার কাজের পর রোজ গার্ডেন

কমবেশি সকলেরই পরিচিত পুরান ঢাকার কে এম দাস লেনের ঐতিহাসিক স্থাপনা রোজ গার্ডেন। ৯৩ বছরের পুরোনো প্রাসাদোপম ভবনটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশের প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের জন্ম ইতিহাস। বর্তমানে ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি হিসেবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সংরক্ষিত রয়েছে গ্রীক স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শনের সাক্ষ্যবহ ভবনটি।

পুরান ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে প্রকল্পটি নেওয়া হয়। স্থাপত্যশৈলী অক্ষুণœ রেখে সাড়ে সাত বিঘা জমির বিস্তৃত প্রান্তরে প্রতিষ্ঠিত রোজ গার্ডেনের সংস্কার এবং ঢাকা জাদুঘর প্রতিষ্ঠা ও বেঙ্গল স্টুডিও পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০২২ সালের জুলাই মাসে।

রোজ গার্ডেনকে ঘিরে পুরান ঢাকার মানুষসহ সর্বসাধারণের জন্য একটি বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে এ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। সেই প্রেক্ষাপটে সুখবরটি হচ্ছে, রোজ গার্ডেনের মূল ভবনসহ জাদুঘর ও বেঙ্গল স্টুডিওর অবকাঠামোগত নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে বিশালাকৃতির নজরকাড়া ভবনটি যেন আবির্ভূত হয়েছে নবরূপে।

ঝলমল করছে নতুন রঙের আঁচড়মাখা ভবনসংলগ্ন ভাস্কর্যসমূহ। ওই আঙিনায় পূর্বে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া গোলাপ বাগান ফিরে পেয়েছে তার স্বরূপ। গাছে গাছে উঁকি দিচ্ছে লাল গোলাপ। সে বাগানের চারপাশে শোভা পাচ্ছে নানা জাতের বৃক্ষ। ভবনের পেছনের দেয়ালে ঝুলছে গুল্মজাতীয় রকমারি উদ্ভিদ। পথচারীদের চলার জন্য তৈরি হয়েছে সুদৃশ্য ওয়াকওয়ে। পর্যটকদের বিশ্রামের জন্য বসানো হয়েছে সুদৃশ্য কাঠের বেঞ্চ।

একইভাবে পুকুরটি ফিরে পিয়েছে নাব্যতা। সংস্কারের মাধ্যমে পূর্বের ক্ষয়িষ্ণু দুই পুকুরঘাট ফিরে পেয়েছে হারানো সৌন্দর্য। নাটক কিংবা সিনেমার শূটিংয়ের জন্য পুনরায় প্রস্তুত হয়েছে বেঙ্গল স্টুডিও। আগামী কিছুদিনের মধ্যেই জাতীয় জাদুঘর থেকে নিদর্শনসমূহে পৌঁছে যাবে জাদুঘরে। সব মিলিয়ে যেন দর্শনার্থীদের অপেক্ষায় রয়েছে রোজ গার্ডেন।

সেই বাস্তবতায় সর্বসাধারণের জন্য রোজ গার্ডেন উন্মুক্ত করে দেওয়ার জন্য লোকবল নিয়োগ এবং টিকিট ব্যবস্থা প্রচলনের চূড়ান্ত পর্বের কাজটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এ বিষয়ে মূল ভবনের তত্ত্বাবধানকারী প্রতিষ্ঠান প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। 
 এ বিষয়ে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা দ্রুত রোজ গার্ডেন জনসাধারণের জন্য খুলে দিতে চাই। ইতোমধ্যে ঐতিহাসিক স্থাপনাটির সংস্কারসহ সকল কাঠামোগত কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এখন জনবল নিয়োগসহ চূড়ান্ত পর্বের কাজ শেষ হবে। তাই সর্বসাধারণের জন্য স্থানটি উন্মুক্ত করে দেওয়ার লক্ষ্যে আমরা সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি।

ওই প্রস্তাবনায় টিকিট ব্যবস্থার প্রচলন এবং পৃথক তিনটি স্থাপনার জন্য লোকবল নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। সাধারণের সুবিধার্থে টিকিটের মূল্যও হবে স্বল্প। সেটা হবে ২০ থেকে ৩০ টাকা। স্বাভাবিকভাবেই বিদেশী পর্যটকদের জন্য এই টিকিট মূল্য বেশি হবে। এখন ওই প্রস্তাবনা অনুমোদিত হলেই চালু হবে রোজ গার্ডেন। বর্তমানে নিয়মিত পরিচর্যা করা হচ্ছে স্থাপনাটির। এছাড়া টিকিটের অনুমোদন পেলে সেখানে থাকা বিদ্যমান জনবল দিয়েই রোজ গার্ডেন উন্মুক্ত করে দেওয়া সম্ভব।’

এই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের পুরোটা ব্যয় হয়নি উল্লেখ করে আফরোজা মিতা জানান, প্রকল্পটি শুরুর প্রাক্কালে সংরক্ষণ, সংস্কারের জন্য ৩৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে শেষ পর্যন্ত ব্যয় কমেছে। ৩২ কোটি ৬৯ লাখ ৪৭ হাজার টাকায় সংস্কার-সংরক্ষণ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ সম্পাদিত হয়েছে।  
কবে নাগাদ রোজ গার্ডেন সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবেÑ এ প্রশ্নের জবাবে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনুবিভাগের সচিব ও জাতীয় জাদুঘরের নাফরিজা শ্যামা জনকণ্ঠকে বলেন, নির্দিষ্ট করে বলতে না পারলেও আশা করছি শিগগিরই চালু হবে। প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের চাহিদা অনুযায়ী ইতোমধ্যে লোকবল নিয়োগের প্রস্তাবনাটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে অনুমোদনের পর প্রস্তাবনা যাবে অর্থ মন্ত্রণালয়ে। একইভাবে টিকিট প্রচলনের বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

এই দুটি বিষয় নির্ধারিত হলেই চালু হবে রোজ গার্ডেন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, জাতীয় জাদুঘর থেকে বিভিন্ন শিল্প অনুষঙ্গ পাঠানো হবে ঢাকা জাদুঘরে। মূলত পুরনো ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্মারক অনুষঙ্গসমূহ প্রদর্শিত হবে জাদুঘরে। পাশাপাশি জমিদার নবাবী আমলের ভবন হওয়ায় সেই সময়ের পোশাক আশাকসহ নানা বস্তু উপস্থাপিত থাকবে।  
রোজ গার্ডেনের মূল ভবন, ঢাকা জাদুঘর ও বেঙ্গল স্টুডিওর সমন্বিত প্রকল্পটি বাস্তবায়নে যৌথভাবে কাজ করেছে প্রতœতাত্ত্বিক অধিদপ্তর, জাতীয় জাদুঘর ও শিল্পকলা একাডেমি। কাঠামোগত নির্মাণে সহায়তা করেছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। বাগান বিন্যাস করেছে প্রধান বৃক্ষ পালনবিদের কার্যালয়। রোজ গার্ডেনসংলগ্ন সড়কটি উঁচু হয়ে যাওয়ায় বর্ষাকালে অল্প বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধ হয়ে যেত পুরো আঙিনা। সেই জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করেছে গণপূর্ত অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান।
গ্রীক স্থাপত্যশৈলীর রোজ গার্ডেনের মূল প্রাসাদোপম ভবনটি সংরক্ষণ ও সংস্কারের কাজটি সম্পন্ন করেছে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর। অনন্য স্থাপত্যশৈলীর এই ভবনটির সৌন্দর্য অপরিবর্তিত রেখে সম্পন্ন হয়েছে সংস্কারকাজ। ভবনের স্থাপত্যশৈলী অক্ষুণœ রাখার বিষয়টিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেই সুবাদে হুবহু একইরকম ও অবিকৃত কাঠামোয় রূপ পেয়েছে দালানটি।

এজন্য প্রতœত্ত্ববিদদের তত্ত্বাবধানে নির্মাণের শুরুতে ভবনটির ডকুমেন্টশন করা হয়েছে। তারা ভবনের প্রতিটি ইট থেকে ভাস্কর্য কিংবা সিঁড়িসহ সবকিছু ডকুমেন্টেশন করে কাজ সম্পন্ন করেছে। কালের ইতিহ্যাস-ঐতিহ্যের সাক্ষ্যবহ এই ভবনটি দৃষ্টিনন্দন রূপে আবির্ভূত হবে দর্শনার্থীদের কাছে। ছয়টি সুদঢ় থামের ওপর দাঁড়িয়ে আছে ভবনটি। প্রতিটি পিলারে লতাপাতার কারুকাজগুলো আকর্ষণীয়রূপে ফুটে উঠেছে।

ফলশ্রুতিতে নতুন করে নজর কাড়ছে ভবনের করিন্থীয়-গ্রিক স্থাপত্যশৈলী। এই ভবনের দ্বিতীয় তলায় পাঁচটি কামরার সঙ্গে রয়েছে নাচঘর। নিচতলায় রয়েছে একাধিক কক্ষ।
রোজ গার্ডেনের সাবেক মালিকের তিন তলার বাসস্থানটিই রূপান্তরিত হয়েছে ঢাকা জাদুঘরে। জাতীয় জাদুঘরের তত্ত্বাবধানে এই ভবনটি সংস্কার করা হয়েছে। আলোকসজ্জা, অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জাসহ বিভিন্ন কাজ শেষে ভবটিকে জাদুঘরের উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে। ভবনটির প্রথম তলায় স্থাপিত হয়েছে অভ্যর্থনা কক্ষ। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় থাকবে জাদুঘর। এই জাদুঘরে উপস্থাপিত হবে ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্যসংবলিত নানা অনুষঙ্গ।

×