অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে উদ্দেশ্য করে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক সমন্বয়ক জননেতা মোহাম্মদ শাহজাহান বলেছেন আমাদের দলের মূল দাবী একটাই মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে অবশ্যই নির্বাচন দিতে হবে। এতে কোন প্রকার চলচাতুরি দল সহ্য করবে না। শনিবার বিকেলে নোয়াখালী ৪ (সদর-সুবর্ণচর) আসনে বারবার বিপুল ভোটে নির্বাচিত এমপি মোঃ শাহজাহান তার বক্তব্যে এ দাবী জানান। সুবর্ণচর উপজেলার চরভাটায় প্রায় অর্থলক্ষ লোকের এক বিশাল জনসভায় তিনি প্রধান অতিথি বক্তব্যে আরো বলেন--“বিগত সরকারের এমপি অদৃশ্য কারণে সরকারের তালিকায় জাতীয়করণের জন্য থাকলেও অজ্ঞাত কারণে বিশেষ ব্যবস্থায় এই সুবর্ণচরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত চরজব্বর ডিগ্রি কলেজটির নাম বাদ দিয়ে উপজেলা থেকে দূরবর্তী অন্য একটি কলেজের নাম অন্তভুর্ক্ত করায় এখানে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে, যা আমাদের দলের পক্ষ থেকে মোটেও কাম্য ছিল না।” সুবর্ণচর উপজেলা বিএনপির সভাপতি জেলা বারের বারবার নির্বাচিত সভাপতি এ্যাড. এ বি এম জাকারিয়ার সভাপতিত্বে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এনায়েত উল্লাহ বাবুলসহ বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ। এর একদিন আগে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় সাবেক চীফ হুইপ জয়নুল আবদীন ফারুক বলেছেন, মঈনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনের মতো ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টা করবেন না। তিনি বলেন, ওয়ান ইলেভেনের সময় ডাকাত—জালিমরা তিন মাসের কথা বলে দুই বছর ক্ষমতায় থেকে বিএনপি নেতাকর্মীদের জেলে দিয়ে নির্যাতন করছে। এমন কিছু দেখলে বিএনপির অগনিত নেতাকর্মীরা সদা—সর্বদা প্রস্তুত রয়েছেন।
বৃহস্পতিবার রাতে নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলায় তার নিজ বাড়ীতে নোয়াখালীতে কর্মরত বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সিনিয়র গণমাধ্যমকর্মীদের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মঈন—ফখরুদ্দিন মাইনাস টু ফর্মুলার পরিবর্তে মাইনাস ওয়ান ফর্মুলা করে খালেদা জিয়াকে বাদ দিতে চেয়েছিলেন। যদি এবারও তেমন কিছু হয় তার জন্য কঠিন পরিণতি বরণ করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া সব মামলা দ্রুত প্রত্যাহার করতে হবে। এছাড়া জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে।
নোয়াখালী বিএনপি রাজনীতিতে উত্তাপের আভাস
বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। এই বৃহৎ দলের অংশীদার নোয়াখালী জেলা বিএনপি'র নিয়ন্ত্রিত সুশৃংখল রাজনীতিতে উত্তাপের আভাস পাওয়া যাচ্ছে আসন্ন জেলা বিএনপি'র কমিটিকে ঘিরে।
একই নিয়মে শৃঙ্খলিত বিএনপি'র রাজনীতিতে ঐক্য ধরে রাখা এখন চ্যালেঞ্জিং বিষয় হয়ে উঠছে, শুধুমাত্র জেলা বিএনপির আসন্ন কমিটিকে কেন্দ্র করে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে বিগত সরকার আমলে বিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথের নিবেদিত প্রাণ জেলার শীর্ষ নেতারা হচ্ছেন একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী। মিলিয়ে নিচ্ছেন রাজনীতিতে ত্যাগ ও প্রাপ্তির হিসাব। যে কারণে একদিকে জেলার সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে প্রাণ চাঞ্চল্য। অপরদিকে সৃষ্টি হয়েছে বিরোধ, বিভেদ ও রাজনৈতিক কোন্দলের আতঙ্কিত পরিবেশ।
খুব শীঘ্রই ঘোষণা আসতে পারে নোয়াখালী জেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটি। জেলা বিএনপির বর্তমান সভাপতি গোলাম হায়দার বিএসসি এবং সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আব্দুর রহমান সভাপতি হিসেবে দুজনেই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী। কিন্তু সমীকরণ এখানেই শেষ নয়। সভাপতি হিসেবে জোরালো প্রার্থিতায় রয়েছেন জানান দিচ্ছেন জেলা বিএনপি'র সিনিয়র সহ সভাপতি ও কেন্দ্রীয় বিএনপি'র সদস্য এডভোকেট এবিএম জাকারিয়া। প্রার্থিতায় তুমুল আলোচনায় রয়েছেন বিএনপি'র কেন্দ্রীয় নেতা ও নোয়াখালী জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহবুব আলমগীর আলো। সভাপতি প্রার্থী হিসেবে সবচেয়ে বেশি উত্তাপ ছড়াচ্ছেন যিনি, যাকে ঘিরে জেলা বিএনপির রাজনৈতিক হিসেব নিকেশ কষছেন জেলা বিএনপি'র ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতা কর্মীরা।
অপরদিকে মার্চ—এপ্রিলে নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি শুরু করছে বিএনপি। সঠিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন দাবি করে আসা বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা এ বিষয়ে আর বেশি দিন ধৈর্য না ধরার চিন্তাভাবনা শুরু করেছেন। তাঁরা আগামী মার্চ—এপ্রিলের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ চাইবেন। সেটি না হলে মার্চ—এপ্রিলের দিকে নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি শুরুর চিন্তা করছেন দলটির নীতিনির্ধারণী নেতারা। সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় এ বিষয়ে আলোচনা হয়।
এদিকে দলের দুঃসময়ে জেলা বিএনপির বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক তাদের সবটুকু উজাড় করে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে ছাত্র জনতার হাত ধরে বিগত সরকারকে উৎখাতের সফলতা অর্জন করেছেন বলেই তারা আবারও নোয়াখালী জেলা বিএনপির নেতৃত্বের যোগ্য দাবিদার বলে মনে করছেন অনেক নেতা কর্মীরা।
অপরদিকে জেলা বিএনপি'র সহ সভাপতি অ্যাডভোকেট এবিএম জাকারিয়া জেলায় একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ। একাধারে তিনি দলের দুঃসময়ে জেলা বিএনপির সিনিয়র সহ—সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। দায়িত্ব পালন করছেন সুবর্ণচর উপজেলা বিএনপির সভাপতি হিসেবেও। একাধারে তিনি জেলার সিনিয়র আইনজীবী, জেলা বারের কয়েকবারের নির্বাচিত সভাপতি, রাজনীতিবিদ।
সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শক্ত অবস্থানে রয়েছেন তৃণমূলের জনপ্রিয় আরো এক শক্তিমান রাজনীতিবিদ মাহাবুব আলমগীর আলো। যার বক্তব্য রাজনীতির মাঠে বিপ্লবী বজ্রকন্ঠ, আন্দোলিত করে তোলে নির্যাতিত নিপীড়িত নেতাকর্মীদের। সেই নেতৃত্ব যার রাজনীতিতে ত্যাগের তুলনায় প্রাপ্তির খাতা শূন্য বলে মনে করেন সাধারণ নেতাকর্মীরা। যে কারণে সভাপতি প্রার্থী হিসেবে তার রয়েছে শক্ত অবস্থান।
অপরদিকে সভাপতি প্রার্থী হিসেবে সবচেয়ে বেশি উত্তাপ ছড়াচ্ছেন যিনি। রাজনীতিতে তার রয়েছে বহু প্রাপ্তির হিসাব। তিনি নোয়াখালী জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও নোয়াখালী পৌর বিএনপি'র কয়েকবারের সভাপতি, নোয়াখালী পৌরসভার দুই বারের সাবেক সফল মেয়র হারুন অর রশিদ আজাদ। একাধারে তিনি জেলার একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ। যে কারণে তিনি সভাপতি পদে বিএনপি'র একটি অংশের তুমুল জনপ্রিয় প্রার্থী হিসেবে শক্ত অবস্থানের জানান দিচ্ছেন।
প্রসঙ্গত এর আগে দীর্ঘদিন হারুনুর রশিদ আজাদ রাজনীতি থেকে বিরত থাকলেও এবার মাঠঘাট বেঁধেই রাজনীতির মাঠে লড়াইয়ে নেমেছেন সভাপতি প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে। যদিও প্রভাবশালী এই প্রার্থীর বিরুদ্ধে দলীয় নেতাকর্মীদের একাংশের অভিযোগ রয়েছে যে তিনি দলের দুঃসময়ে রাজনীতি থেকে বিরত থেকেছেন আর সুসময়ে এসে রাজনীতিতে অবস্থান নিতে চাচ্ছেন। নেতাকর্মীদের এমন প্রশ্নের জবাবে হারুনুর রশিদ আজাদ বলেন, রাজনীতি থেকে আমি কখনো বিরত থাকিনি। আমাকে বিরত করে রাখা হয়েছিল। ২০১৬ সালের জেলা বিএনপির নীল নকশার কাউন্সিলের মাধ্যমে আমাকে সভাপতি পদ থেকে বঞ্চিত করে রাজনীতির মাঠে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় সৃষ্টি করা হয়েছিল। সেই থেকে আমাকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দেয়ার সকল প্রকার চক্রান্তে লিপ্ত ছিল প্রতিপক্ষ গুষ্টি। তবে আমি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আদর্শের সৈনিক, আমি আদর্শ থেকে বিচ্যুত হইনি। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনা মোতাবেক আমি বিগত দিনে সকল রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করে এসেছি।
কিন্তু কয়েকটি গণমাধ্যমের পক্ষপাতদুষ্ট খবরে সেই সব সত্য উঠে আসেনি বলে তিনি অভিযোগ করেন। তিনি আরো বলেন, সভাপতি পদে নির্বাচিত হলে তিনি হিংসা বিদ্বেষ ও প্রতিশোধ পরায়ণ রাজনীতি থেকে বিরত থাকবেন। দলের সকল নেতা কর্মীদেরকে নিয়ে একটি অহিংস কোন্দলবিহীন রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করবেন।
কমিটির বিষয়ে জেলার সিনিয়র রাজনীতিবিদ মাহবুব আলমগীর আলো বলেন, দলের দুঃসময়ে কাজ করে এসেছি, এখন সভাপতি পদে প্রার্থী হয়েছি। তবে আমি শুধুমাত্র পদবীর জন্য রাজনীতি করি না, কারন পদবী পেলেও রাজনীতি করবো, না পেলেও রাজনীতি করবো। দলীয় হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
জেলার আরেক নেতা জেলা বিএনপির সভাপতি গোলাম হায়দার বিএসসি'কে কমিটির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এসব বিষয়ে সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান সাহেব বলবেন। পরে সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আব্দুর রহমান সাহেবের মোবাইলে কল দিলে সংযোগ পাওয়া সম্ভব হয়নি।
এসব বিষয়ে জেলা বিএনপির সিনিয়র সহ সভাপতি অ্যাডভোকেট এ বি এম জাকারিয়া বলেন, আমি দীর্ঘদিন জেলা বিএনপির নেতৃত্ব দিয়ে আসছি। আশা করছি দল আমাকে সেই মূল্যায়ন করবে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের সকলের আমলনামা কিন্তু দলীয় হাই কমান্ডের কাছে আছে। দলের ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নেবেন না। আর তিনি দলীয় স্বার্থে যে সিদ্ধান্ত দেবেন সেই সিদ্ধান্তের আলোকে আমরা কাজ করে যাব।
উল্লেখ্য ২০১৬ সালে কাউন্সিলের মাধ্যমে জেলা বিএনপির সভাপতি পদে এডভোকেট আব্দুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক পদে মাহবুব আলমগীর আলো'কে ঘোষণা করা হয়। সেই কমিটির মেয়াদ দুই মাস যেতে না যেতেই আবারও নতুন করে কমিটি দেয়া হয়। যেখানে গোলাম হায়দার বিএসসি'কে সভাপতি করে অ্যাডভোকেট আব্দুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। সেই ২০১৬ সাল থেকে অদ্যাবধি আর কোন কাউন্সিল হয়নি। ২০১৬ সালের কাউন্সিলে সভাপতি প্রার্থী হিসেবে হারুন অর রশিদ আজাদ ছিলেন একজন প্রভাবশালী প্রার্থী। সেই কাউন্সিলে তাকে সভাপতি ঘোষণা না করায় জেলা বিএনপির রাজনীতিতে দলীয় কোন্দল মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। সেই যে কোন্দলের রাজনীতি শুরু হয়েছিল তা এখন পর্যন্ত বিদ্যমান রয়েছে। তবে ২০১৬ সালের কাউন্সিলের পর থেকে হারুন অর রশিদ আজাদ রাজনীতিতে অনেকটা নিষ্ক্রিয় থাকার কারণে দলীয় নেতাকর্মীরা জেলা বিএনপি'র নেতৃত্বে একত্রিতভাবে আন্দোলন সংগ্রাম করে গিয়েছেন। তবে এখন আবার দীর্ঘ ৮ বছর পর জেলা বিএনপির কমিটিকে কেন্দ্র করে হারুন অর রশিদ আজাদের অনুসারীদের একটি অংশ বিভক্ত হওয়ার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।
রাজু