ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১

সংস্কার করার দাবি

নিষ্ঠুর বর্বরতার নিদর্শন সহমরণ মঠ

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল

প্রকাশিত: ২২:৫১, ৫ আগস্ট ২০২৪

নিষ্ঠুর বর্বরতার নিদর্শন সহমরণ মঠ

বরিশালের বানারীপাড়ার প্রাচীন মঠ

অন্ধকার যুগের ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও অমানবিক নিষ্ঠুর নির্মমতার সাক্ষী হয়ে বরিশালের বানারীপাড়া পৌর শহরের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ঘোষের বাড়ির পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রাচীন নিদর্শন ‘সহমরণ’ কিংবা ‘সতীদাহ’ মঠ। দীর্ঘদিন ধরে অযতœ-অবহেলায় পড়ে থাকা মঠটি রক্ষণাবেক্ষণের দাবি করেছেন এলাকাবাসী।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রাচীন সতীদাহ প্রথা অনুযায়ী, স্বামী মারা গেলে স্ত্রীকেও একই চিতায় জীবন দিতে হতো। এই মঠটি তারই নিদর্শন। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন সেই অন্ধাকার যুগের স্মৃতিচিহ্ন সতীদাহ মঠটি সরকারিভাবে রক্ষণাবেক্ষণের দাবি করেছেন উপজেলা পূজা উদ্যাপন ও হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।

বানারীপাড়া পৌর শহরের প্রাণকেন্দ্র ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ঘোষের বাড়ির পুকুরপাড় ও রাস্তার পাশে সহমরণ মঠটি অবস্থিত। মঠের একপাশে একটি টিনের সাইনবোর্ড সূত্রে জানা গেছে, সহমরণ সমাধিটি ১৮৪৩ সালে স্থাপিত। বানারীপাড়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার তরুণেন্দ্র নারায়ণ ঘোষজানান, প্রায় দুইশ’ বছর আগে তাদের বাড়ির ধর্ম নারায়ণ ঘোষের মৃত্যুর পর পারিবারিক শ্মশানে তার সৎকার করা হয়।

ওই সময় প্রাচীন রীতি অনুযায়ী একই শ্মশানের একই চিতায় তার স্ত্রী হেমলতা ঘোষকেও সৎকার করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, দাদু সম্পর্কের পূর্বপুরুষ ধর্ম নারায়ণ ঘোষ ও তার স্ত্রী হেমলতা ঘোষের সহমরণ হওয়ার পর এর নিদর্শন হিসেবে সেখানে মঠটি নির্মাণ করা হয়েছিল। দীর্ঘদিন থেকে সেই সহমরণ মঠটি অযতœ-অবহেলায় পড়ে থাকায় এখন ধ্বংসের মুখে রয়েছে।
উপজেলা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা বেণী লাল দাসগুপ্ত বলেন, রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত করে ধর্মান্ধতা, কুসংস্কারাচ্ছন্নতা ও মধ্যযুগীয় বর্বরতার অন্ধকার পথ থেকে হিন্দুদের আলোর পথ দেখিয়েছিলেন। নিষ্ঠুর বর্বরতার নিদর্শন বানারীপাড়ার সহমরণ মঠটি রক্ষণাবেক্ষণ করে সেই অন্ধকার যুগ সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে।
হিন্দু কল্যাণ ট্রাস্টের বরিশালের সহকারী পরিচালক ও বানারীপাড়া উপজেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি দেবাশীষ দাস বলেন, নারীদের প্রতি বর্বরতা, অন্যায়-অবিচারের সতীদাহ প্রথা আইনের সেই কালো অধ্যায় সম্পর্কে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানাতে প্রাচীন সহমরণ মঠটি রক্ষণাবেক্ষণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
বানারীপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার রিপন কুমার সাহাবলেন, বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সতীদাহ মঠটি সংস্কারসহ এটি রক্ষণাবেক্ষণে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। বানারীপাড়া পৌরসভার মেয়র অ্যাডভোকেট সুভাষ চন্দ্র শীল বলেন, সতীদাহ মঠসহ পৌর শহরে অবস্থিত অতি প্রাচীন নিদর্শনগুলো সংরক্ষণে খুব দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
উল্লেখ্য, উপমহাদেশে সতীদাহ প্রথা ও এর বিলুপ্ত সম্পর্কে জানা যায়, ‘সতী’ নামটা এসেছিল দেবী সতীর থেকে। তিনি ছিলেন রাজা দক্ষের কন্যা। একই সাথে দেবাদিদেব শিবের স্ত্রী। দক্ষ মেনে নিতে পারেননি তার মেয়ে কোনো শ্মশানবাসী ভবঘুরেকে বিয়ে করবে। একদিন সতীর সামনেই শিবকে কঠোর ভাষায় দক্ষ তিরস্কার করায় স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সতী আত্মহনন করেন। সেই থেকে মৃত স্বামীর জন্য চিতায় ওঠার প্রথার সৃষ্টি হয় বলে লিখেছিলেন এংলো-ইন্ডিয়ান লেখকরা।
বরিশালের কবি ও সাহিত্যিক শিকদার রেজাউল করিম বলেছেন, প্রাচীন যুগে ‘সতীব্রত’ বলে এক প্রথা চালু ছিল। যেখানে নারী তার স্বামীকে কথা দিতেন, স্বামী যদি আগে গত হন, তবে তিনিও সহমরণে যাবেন। সতীপ্রথা পালন করা হলে নারীকে বলা হতো ‘সতীমাতা’। কোনো পরিবার থেকে একজন নারী সতী হওয়া মানে বিরাট সম্মানের বিষয় ছিল।

একজন নারীর তার স্বামীর প্রতি চূড়ান্ত অধীনতা, সতীত্ব ও ধর্মপরায়ণতার লক্ষণ ছিল এই প্রথা। কিন্তু দেখা যেত, অনেক ছোট বয়সে বিধবা হয়ে গেছে, স্বামীর মৃত্যুতে হতবিহ্বল হলেও শোকের মাতম তোলার কারণ নেই। এমন সব নারীরা চিতায় ওঠার আগে বেঁকে বসতেন। আসলে খুব কম নারীই ছিলেন, যারা দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের দিকে পরলোকের মোহে পরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে যেতেন।

কেউ কেউ চিৎকার করে কাঁদতেন, ছেড়ে দিতে বলতেন। এই আওয়াজ যেন কেউ না শোনে তাই শবযাত্রীরা ঢোল, মাদল, বাঁশির আওয়াজে ভরিয়ে তুলতেন। অনিচ্ছুক মেয়েদের খাওয়ানো হতো আফিম জাতীয় ওষুধ, যেন তারা অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এভাবেই রীতি অনুযায়ী জীবিত পোড়ানো হতো। তিনি আরও বলেন, ১৫শ’ থেকে ১৮শ’ সাল পর্যন্ত কয়েক হাজার নারীকে জীবিত পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে স্বামীর চিতায়।
কবি শিকদার রেজাউল করিম আরও বলেন, সহমরণে যাওয়ার কিছু নিয়ম ছিল। এর মাঝে ছিল যারা সহমরণে যেতে পারবেন না- যদি কোনো নারীর সন্তান এতই ছোট হয় যে নিজের দেখাশোনা করতে পারেন না, যদি কোনো নারীর পিরিয়ড চলার সময়ে থাকেন, যদি তার গর্ভে বাচ্চা থাকে। তিনি আরও বলেন, মুঘল শাসন শুরুর পরসহমরণ বন্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন স¤্রাটরা। কিন্তু বাদ সাধে ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা’র অভিযোগ।

১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর ভারতের গভর্নর লর্ড বেন্টিঙ্ক আইন জারি করে সতীদাহ নিষিদ্ধ ও সতীদাহের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের ফৌজদারি আদালতে শাস্তির ব্যবস্থা করেন। ১৮৩০ সালের মাঝামাঝি সময় বোম্বে ও মাদ্রাজে আইনের হাত প্রসারিত হয়। 
বাংলা, বিহার, ওড়িশার কয়েক হাজার সনাতন ধর্মাবলম্বী পিটিশন করেন এই আইনের বিরুদ্ধে। এরপর প্রখ্যাত সাহিত্যিক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তার লেখনীর মাধ্যমে সনাতন ধর্মাবলম্বী নারীদের বিধাব বিবাহ প্রথা চালুর আন্দোলন করেন। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই ব্রিটিশ শাসন আমলে ভারতবর্ষের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসির সহায়তায় ভারতবর্ষের সকল বিচারব্যবস্থায় হিন্দু বিধবাদের বিবাহ বৈধ করা হয়।

পরবর্তী সময়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় তৎকালীন বড় লাট লর্ড ক্যানিং আইন (দ্য হিন্দু উইডোস রিম্যারেজ অ্যাক্ট) প্রণয়ন করে বিধবাবিবাহকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তখনো ভারতের সব অঞ্চলে সতীদাহ বিরোধী আইন করা হয়নি। 
ভারতে পুরোপুরি সতীদাহ আইন করে বন্ধ করতে ১৮৬১ সাল পর্যন্ত লেগে যায়। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে ভারতবর্ষ থেকে সতীদাহর মতো শতবর্ষের কুপ্রথা বিলুপ্ত হয়।

×