ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

নারুলী বধ্যভূমি হারিয়ে যেতে দেখে কষ্ট পান

স্বজন হারানোর বেদনা নারায়ণ-গফুরকে আজও কাঁদায়

মাহমুদুল আলম নয়ন, বগুড়া অফিস

প্রকাশিত: ০০:১৮, ১২ ডিসেম্বর ২০২৩

স্বজন হারানোর বেদনা নারায়ণ-গফুরকে আজও কাঁদায়

বগুড়ার নারুলী বধ্যভূমি দেখাচ্ছেন শহীদ পরিবারের দুই সদস্য

নারায়ণ ও আব্দুল গফুর এই বৃদ্ধ বয়সেও  চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না। পাক হানাদার ও তাদের দোসরদের হাতে স্বজন হারানোর কথা বলতে গিয়ে আজও চোখ যেন হয়ে ওঠে উপচেপড়া নদী। যুদ্ধ দিনের ভয়াবহতা তুলে ধরে শহীদ হওয়া স্বজনের কথা বলতে গিয়ে তারা ফিরে যান স্মৃতির পাতায়। ফিরে আসেন পরক্ষণেই, সঙ্গে দু’চোখে বাঁধ ভাঙা অশ্রুর ঢল। কথা বলতে গিয়ে বেদনায় কণ্ঠ জড়িয়ে যায়। আর সে সময়ে কৈশরের সন্ধিক্ষণে থাকা এনামুল ভুলতে পারেন না কিভাবে তার পিতাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। পাক হানাদারদের ভয় উপেক্ষা করে বাড়ি থেকে পিতার পিছু পিছু বধ্যভূমি পর্যন্ত ছুটে এসেছিলেন। তবে বাঁচাতে পারেননি তার মুক্তি সেনানী পিতাকে।

চোখের সামনে পাক হানাদারদের মেশিনগানের গুলিতে পিতার বুক বিদীর্ণ হতে দেখেছেন। বধ্যভূমির সামনে দাঁড়িয়ে সে দিনের ভয়াবহতার কথা বললেও এই শহীদ পরিবারের সদস্যরা চোখের সামনে দেখছেন বধ্যভূমি হারিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। তারা কথা বলছিলেন বগুড়ার নারুলী বধ্যভূমির সামনে। এখন সেখানে এলাকার শিশুরা খেলার মাঠ বানিয়েছে। অথচ এলাকাবাসীসহ শহীদ পরিবারের সদস্যদের আশা সেখানে স্মৃতি সৌধ হবে। শহীদদের নাম ফলক অন্তত থাকবে। এখন অবহেলা অযতেœ চোখের সামনে ক্রমান্বয়ে ধূসর হয়ে যাচ্ছে বধ্যভূমি। জেলা পরিষদ থেকে বধ্যভূমিতে শহীদ মিনার নির্মাণ করার প্রকল্প থাকলেও তার পরিবর্তে সেখানে শুধু ড্রেন নির্মাণ করে দায়িত্ব শেষে করা হয়েছে। তবে গণপূর্ত অধিদপ্তর জানিয়েছে, ওই স্থানে একটি স্মৃতি সৌধ নির্মাণের প্রকল্প রয়েছে।
বগুড়ার যে ক’টি বধ্যভূমি আবিষ্কৃত, তার মধ্যে শহরের নারুলী বধ্যভূমি অন্যতম। রেল লাইনের পাশে রাস্তার ঘেঁষে এর অবস্থান। আগে এর পাশেই ছিল নার্সারি। পাশে ডোবা। সেখানেই  প্রায় ৭০ জনেররও বেশি মুক্তিকামী মানুষকে পাক হানাদার ও তাদের রাজাকার বিহারী দোসররা চরম নির্মমতায় হত্যা করেছিল। এই বধ্য ভূমিতে কত মানুষকে হত্যা করে পুঁতে রাখা হয়েছিল, তা এখনো নির্দিষ্ট করা যায়নি। প্রত্যক্ষদশী কেউ কেউ বলেন, এর সংখ্যা শতও ছাড়িয়ে যেতে পারে। তবে এই সংখ্যা নিয়ে সুনির্দিষ্ট না থাকলেও বগুড়ার করতোয়া নদীর পূর্বাংশ চেলোপাড়া ও নারুলী এলাকায় আর যে, অনেক বধ্যভূমি ছিল এবং তা এখান হারিয়ে গেছে তার সুস্পষ্ট তথ্য মিলেছে এলাকাবাসীর কথা থেকে।

খোলা মাঠ থেকে ইঁদারা সবখানেই হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে বর্বরতার ছাপ রেখে গিয়েছিল পাক হানাদার বাহিনী। এসব কূপে কত মানুষকে হত্যা করে ফেলা হয়েছিল তার সংখ্যা অজানাই রয়ে গেছে। নারুলী গণকবরের (বধ্যভূমি) পাশেও এ রকম কূপের কথা জানিয়ে এলাকার অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক রামগোপাল গোস্বামী জানালেন, তার বাড়ির পাশেই এ রকম একটি ইঁদারা ছিল। বাড়ি ফিরে তারা সেখানে চারপাশের কালচে রক্তের ছোপও দেখেছেন। একই রকম একটি কূপ ছিল পাশের চেলোপাড়া হরিবাসর এলাকায়, জানালেন নারায়ন দাস ওপফে পান্তা। ওই বাড়িতেই মুক্তিযুদ্ধের আগে তাদের পরিবার থাকতেন। পাকবাহিননী বগুড়ায় হামলা চালালে তার সেখান থেকে চলে যান।

সেখানেই পাকবাহিনী ও রাজাকার বিহারীরা আস্তানা বানিয়েছিল। বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজনকে ধরে এনে নির্যাতনের পর হত্যা করে কূপে ফেলা হতো। জানালেন রেললাইনের ধারে বড়িতলা এলাকাতেও ৫/৬ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে অশোক ও রমণী মোহন্ত নামে দুজনকে তিনি চিনতেন। 
নারুলী মধ্যপাড়ার আব্দুস সাত্তার (৭১) ও সামছুল হকের (৭২)সঙ্গে দেখা মিলল নারুলী রেললাইনের ধারে এক মুদি দোকানে সামনে। যুদ্ধ দিনে স্মৃতি হাতড়ে জানালেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় এপ্রিলের মাঝামাঝিতে পাকবাহিনী বগুড়ায় প্রবেশ করে বিভিন্ন এলাকা বিশেষে করে পূর্ব বগুড়ার বিভিন্ন এলাকায় হানা দেয়। তারা লোকজন ধরে এনে সারি ধরে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে ফেলে যেত। বেশিরভাগই নারুলী বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়েছে। পাকবাহিনীর তা-বে তখন এলাকায় কাকপক্ষীও যেন উড়ত না। আব্দুস সাত্তার জানালেন, ওই সময় তার বয়স ছিল ১৮। পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে পালিয়েছিলেন গাবতলীর গোলাবাড়ি এলাকায়। সেখান থেকে চাল আনতে বাড়িতে ফিরেছিলেন এক বিকেলে। হাত তুলে কয়েকশ’ গজ সামনে দেখিয়ে জানালেন, তিনি সেখানে ১০/১৫ জনের লাশ পরে থাকতে দেখে দ্রুত চলে গিয়েছিলেন। এখন ওই স্থানে এখন বাড়িঘর। 
নারুলী বধ্যভূমির সামনে চোখ মুছে চেলোপাড়া হরিবাসর এলাকার বৃদ্ধ নারায়ণ চন্দ্র দাস পান্তা জানালেন পাক হানাদারদের তা-ব শুরু হলে তিনি মা গোরাঙ্গিনী বালাদাসসহ কয়েকজনকে নিয়ে দুপচাঁচিয়ার দিকে রওনা হয়েছিলেন। বগুড়ার জামিলনগর এলাকা পার হওয়ার পর খবর পান এলাকায় পাকবাহিনী ঢুকেছে। তখন বাড়িতে দুই ভাই গোপালচন্দ্র দাস ও রবীন্দ্রদাস রবি ছিলেন। এর মধ্যে গোপালকে রাজাকাররা চেলোপাড়া ব্রিজ এলাকায় পাকিদের দেখিয়ে দেয় যে, সে হিন্দু। সঙ্গে সঙ্গে তাকে পাকিরা বুকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। রবিন্দ্র বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছিল। বড় ভাইকে হত্যা করার খবর পেয়ে সে ফিরে আসার পথে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে।

বধ্যভূমির সামনে আরও ১৫/২০ জনের সঙ্গে তাকে হত্যা করা হয়। অর ছোট ভাই নারায়ণ প্রায় ১৫ দিন পর দুই ভাইকে হারানোর খবর পান। পাকিদের পরাজয়ের পর বাড়িতে ফিরে  বধ্যভূমির সামনে গিয়ে শুধু চোখের পানি মুছেছেন। তবে দুই ভাইয়ের স্মৃতি মুছতে চাননি বলে আজও বধ্যভূমির সামনে আসলে চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে। নারুলী মধ্যপাড়ার আব্দুল গফুর (৬৮) বড় ভাইকে হারিয়েছিলেন এই বধ্যভূমিতে। বড় ভাই আব্দুল গফফারের কথা বলতে গিয়ে হুহু করে কেঁদে উঠলেন। জানালেন তিনি ছিলেন ছোট। পাকহানাদার ও রাজাকার বাহিনীর তা-বে তখন এলাকা থেকে পালিয়ে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। বাড়িতে ছিল চাল ও গরু। বাবা বড় ভাইকে গরু দেখে চাল আনতে বাড়িতে পাঠিয়ে ছিলেন। বাড়িতে এসে এক আত্মীয়ের সঙ্গে খেতে বসেছিলেন।

ভাত খাওয়া অবস্থায় তাদের দু’জনকে পাকহানাদার বাহিনী দুই হাত পেছন বেঁধে অনেকের সঙ্গে দাঁড় করায়। বধ্যভূমির (তখন ডোবা ছিল) সামনে। তার আত্মীয় উর্দুতে কথা বলে রেহাই পান। তবে বড় ভাই আব্দুল গফ্ফার রেহাই পাননি। ঘাতকের বুলেট তাকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। ভাই বাড়িতে না ফেরায় পরের দিন বাবা খুঁজেতে এসে জানতে পারেন তার ছেলে হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছে। ছেলে হারানোর শোকে ওই দিন তার বাবাও মারা যান। আব্দুল গফুর তার বেঁচে যাওয়া আত্মীয়ের কাছ থেকে ঘটনা শুনেছিলেন। তিনি জানান পাকহানাদারদের গুলি খেয়ে মেরেজ উদ্দিন ম-লসহ আরও কয়কজন বেঁচেছিল। তবে এলাকার রাজাকার গোলা হোসেনের নির্দেশে রাজাকার বিহারিরা গুলিতে বেঁচে যাওয়াসহ অন্যদের ধারাল অস্ত্র দিয়ে হত্যা করে পুঁতে দেয়। 
মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাত্র ইউনিয়ন করতেন বর্তমান এপিপি নারুলী এলাকার অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম। জানান তার পরিবারেরর ৬ জনকে হারিয়েছেন এই বধ্যভূমিতে। প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে ২৬ মার্চ বগুড়ার সূর্যসন্তানরা পাক হানাদারবাহিনীকে শহরে প্রবেশ ঠেকিয়ে দিয়েছিল অসীমা সাহসিকতায়। পরবর্তীতে হানাদারার শক্তি সঞ্চয় করে এপ্রিলে বগুড়া প্রবেশ করে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়। নারুলী বধ্যভূমি পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের বর্বরতার চিহ্নহ্ন। তার মতে এখানে প্রায় ৭০ জনকে হত্যা করে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা। রেল লাইনের ওপর থেকে গুলি করে হত্যার পর মুক্তিকামী মানুষদের বিহারী রাজাকাররা পুঁতে রাখত। যারা শহীদ হয়েছেন তাদের মধ্যে ১৭/১৮ জনের নাম পাওয়া গেছে।

×