ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

পিরোজপুর জেলা

আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী

শফিউল হক মিঠু, পিরোজপুর

প্রকাশিত: ০০:১৪, ১৫ নভেম্বর ২০২৩

আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী

সুন্দরবনের কোলঘেঁষা কালীগঙ্গা, বলেশ্বর, দামোদর, সন্ধ্যা বিধৌত প্রাকৃতিক সবুজের লীলাভূমি পিরোজপুর জেলা

সুন্দরবনের কোলঘেঁষা কালীগঙ্গা, বলেশ্বর, দামোদর, সন্ধ্যা বিধৌত প্রাকৃতিক সবুজের লীলাভূমি পিরোজপুর জেলা। বৈচিত্র্যে ভরপুর এই জেলার একদিকে লবণপানি অন্য দিকে মিঠাপানি। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর বাকি অল্প কিছুদিন। জেলায় বইছে নির্বাচনী হাওয়া। সম্ভাব্য প্রার্থীদের দৌড়ঝাঁপ চলছে। নির্বাচনী আসন পুনর্বিন্যাসের কারণে অল্প সময়ে নতুন করে নির্বাচনী প্রচার চালাতে হবে বলে বেশ চিন্তিত প্রার্থীরা। গত নির্বাচনে পিরোজপুর-১ আসনটি ছিল পিরোজপুর সদর, নাজিরপুর ও নেছারাবাদ উপজেলা নিয়ে। ২০০৮ সালে ছিল পিরোজপুর সদর, নাজিরপুর ও ইন্দুরকানী নিয়ে। ২০০৮ সালে চারদলীয় জোট প্রার্থী সাঈদীকে হারিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্র্থী এ কে এম এ আউয়াল বিজয়ী হন।

২০১৪ সালে ফের ভাগ হয়ে ইন্দুরকানী-ভা-ারিয়া-কাউখালীর সঙ্গে যুক্ত হয়। আগামী নির্বাচনে ফের পিরোজপুর-১ আসন ২০০৮ সালের মতো সদর, নাজিরপুর ও ইন্দুরকানী উপজেলা পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। একই সঙ্গে পিরোজপুর-২ সংসদীয় আসন গঠন করা হয়েছে কাউখালী, ভা-ারিয়া ও নেছারাবাদ উপজেলা নিয়ে। প্রার্থীরা আগের সংসদীয় এলাকাগুলোতে নিজেদের উন্নয়নমূলক কর্মকা- ও নির্বাচনী প্রচার চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আসন পুনর্বিন্যাসে বিপাকে পড়েছেন তারা। নতুন করে চলছে প্রার্থীদের গণসংযোগ। টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন করায় সুবিধাজনক অবস্থানে আওয়ামী লীগ।
পিরোজপুর-১ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শম রেজাউল করিম। তিনি এলাকায় ব্যাপক গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইসাহাক আলী খান পান্না, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি একেএমএ আউয়াল, পিরোজপুর পৌর মেয়র হাবিবুর রহমান মালেক, জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ শেখ খালিদ অরিন্দম তান প্রমুখ। গত নির্বাচনে শম রেজাউল করিম সাঈদীর ছেলে শামীম সাঈদীকে পরাজিত করে বিজয়ী হয়েছিলেন।

শম রেজাউল করিম দাবি করেন, এলাকায় যে উন্নয়ন হয়েছে, তা অতীতে কখনোই হয়নি। উন্নয়ন ও শান্তির ধারা অব্যাহত রাখতে আগামী নির্বাচনে মানুষ নৌকায় ভোট দেবেন। ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইসাহাক আলী খান পান্না এলাকায় নিয়মিত গণসংযোগ করছেন। এই আসনে তাকে মনোনয়ন দেওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে।
এ আসনে জামায়াত-বিএনপির প্রার্থিতা নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে। জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর জানাজার সময় কেন্দ্রীয় জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির সাঈদীর ছেলে মাসুদ সাঈদীকে এ আসনের প্রার্থী হিসাবে ঘোষণা দেন।

তবে বিএনপি তাদের শরিক দল জামায়াতকে কিছুতেই ছাড় দিতে নারাজ। বিএনপির জেলা আহ্বায়ক আলমগীর হোসেন জানান, আমাদের দাবি থাকবে ধানের শীষের প্রার্থী দেওয়ার। জামায়াতের সঙ্গে বর্তমানে দলের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা আশাবাদী ধানের শীষ নিয়েই ভোটযুদ্ধে নামব পিরোজপুর-১ আসনে। বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হলেন জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী নুরুজ্জামান বাবুল, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আলমগীর হোসেন, জেলা বিএনপির সদস্য এলিজা জামান, নাজিরপুরের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম খান। জাতীয় পার্টির (এরশাদ) মনোনয়ন চাইবেন জেলা আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম খান, সদস্য সচিব বশির হাওলাদার ও সদস্য নজরুল ইসলাম। জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) সাবেক মন্ত্রী মোস্তফা জামাল হায়দার এবং ইসলামী আন্দোলনের মাওলানা মাসুম বিল্লাহ প্রার্থী হবেন বলে শোনা যাচ্ছে।

পিরোজপুর-২ (ভা-ারিয়া-কাউখালী-নেছারাবাদ) ॥ স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সাল ও ২০০৮ সালে এই আসনটি পেয়েছিল আওয়ামী লীগ। এই আসনে ১৯৭৯ সালে আইডিএল প্রার্থী মাওলানা আব্দুর রহিম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। বেশিরভাগ সময় আসনটি ছিল জাপার প্রার্থীর দখলে। বর্তমান সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। এই আসনে ১৯৮৬, ১৯৮৮, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০১৪, ২০১৮ সালে জোট ও মহাজোট থেকে জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ১৯৯৬ সালে দুটি আসনে নির্বাচিত হওয়ায় পিরোজপুর-২ আসন ছেড়ে দিয়েছিলেন।

উপনির্বাচনে তার স্ত্রী তাসমিমা হোসেন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু চারটি আসন থেকে নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে তিনটি আসনে হেরে গিয়ে পিরোজপুর-২ আসনে বিজয়ী হন। মহাজোট থেকে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে একক প্রার্থী করা না হলে এই আসনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চান কাউখালীর সন্তান ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইসহাক আলী খান পান্না। এই এলাকায় তার জনপ্রিয়তা রয়েছে প্রচুর। এর আগে তিনি এ আসন থেকে মনোনয়ন পেয়েছিলেন কিন্তু জোটের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। তিনি বলেন, দলের জন্য কাজ করছি। প্রধনমন্ত্রী যে সিদ্ধান্ত দেবেন, সেই সিদ্ধান্তই মেনে নেব।
এ ছাড়াও দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ শাহ আলম, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কানাই লাল বিশ^াস, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন মহারাজ, কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সাজ্জাদ সাকিব বাদশা, ভা-ারিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মিরাজুল ইসলাম।
এবার এ আসনে কোনোভাবেই আওয়ামী লীগ জোটের শরিক দলের প্রার্থী হিসাবে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে মানতে নারাজ। এমন পরিকল্পনা নিয়েই মাঠে কাজ করছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা। ভা-ারিয়ায় মেয়র নির্বাচনে জেপি প্রার্থী বিপুল ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কাছে হেরে যান। এরপর থেকে দলে দলে আওয়ামী লীগে আসছেন জেপির নেতাকর্মীরা।
ভা-ারিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান মিরাজুল ইসলাম বলেন, আগামী নির্বাচনে পিরোজপুর-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী চান তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। জোটের কারণে বারবার নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী না থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নেতাকর্মীরা।
মনোনয়নপ্রত্যাশী জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন মহারাজ বলেন, গত এক যুগ স্বরূপকাঠী উপজেলা এই নির্বাচনী এলাকায় ছিল না। ফলে সেখানে জেপির কর্মী-সমর্থক, সংগঠন বলতে কিছুই নেই। সেজন্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমাদের দাবি, এ আসনে নৌকার প্রার্থী দেওয়া হোক।
বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মরহুম তফাজ্জল হোসেন মানিক মিঞার কনিষ্ঠ পুত্র আনোয়ার হোসেন মঞ্জু জনকণ্ঠকে বলেন, ৩৫ বছর আগে ভা-ারিয়ায় কী ছিল, আর এখন কী হয়েছে। এলাকার জনগণ কাদা পায়ে হাঁটত। এখন গ্রামেগঞ্জে কার্পেটিং রাস্তা, ব্রিজ-কালভার্ট। এলাকার ইউনিয়ন থেকে ওয়ার্ড পর্যন্ত উন্নয়নের সঙ্গে সংযুক্ত করেছি। এলাকার উন্নয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে গেলে কখনো তিনি ফিরিয়ে দেননি।

অন্যদিকে পিরোজপুর-২ আসনে বিএনপি ও সমমনা জোট থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা হলেন কেন্দ্রীয় বিএনপির স্বাস্থ্য ও পরিকল্পনা বিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক ডা. রফিকুল কবির লাভলু, ভাণ্ডারিয়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আহমেদ সোহেল মনজুর সুমন, জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি ফখরুল আলম, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আহসান কবীর ও ওয়াহিদুজ্জামান এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় আইনজীবী নেতা নূরুল ইমন বাবুল, ২০ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান। জাতীয় পার্টি (এরশাদ) খলিলুর রহমান, ইসলামী আন্দোলনের মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ও শহিদুল ইসলাম কবির এলাকায় রয়েছেন।
পিরোজপুর-৩ (মঠবাড়িয়া) আসনটিতে এবার মনোনয়ন প্রত্যাশীর ছড়াছড়ি। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয় দলেই কোন্দল রয়েছে। দুই দলেরই রয়েছে একাধিক প্রার্থী। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক দলকে প্রার্থী দেওয়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারছেন না স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। বর্তমান এমপি জাতীয় পার্টির (এরশাদ) ডা. রুস্তুম আলী ফরাজী। এ পর্যন্ত চারবার এমপি হয়েছেন ফরাজী। দুবার বিএনপি একবার স্বতন্ত্র এবং বর্তমানে জাতীয় পার্টি। মহাজোটে থাকলে এবারও তিনি জাপা থেকে মনোনয়ন নিয়ে প্রার্থী হবেন বলে প্রত্যাশা করছেন। আওয়ামী লীগের কোন্দল চলতে থাকলে এর সুফল পাবেন রুস্তম আলী ফরাজি।

দশম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কোন্দল পুঁজি করেই নির্বাচিত হন স্বতন্ত্র প্রার্থী রুস্তম আলী ফরাজি। আর আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাপার জোট হলে তো এ আসনটি জাপাই পাবে। এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা হলেন সাবেক সংসদ সদস্য ডা. আনোয়ার হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন মহারাজ, উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক পৌর মেয়র রফিউদ্দিন আহমেদ ফেরদৌস, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও মঠবাড়িয়া সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আশরাফুর রহমান, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি ডা. এম নজরুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য তাজউদ্দীন আহমদ, পৌর প্রশাসক আজিজুল হক সেলিম মাতুব্বর, কেন্দ্রীয় যুব মহিলা লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহনাজ পারভীন ডলি।
সংসদ সদস্য ডা. রুস্তম আলী ফরাজী জানান, আগামী নির্বাচনে জোটবদ্ধ হলে নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে জোটের মনোনয়ন চাইব। দুর্গম ও চরাঞ্চল এলাকার সমস্যা সমাধানে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি।
এই আসনে আসনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা হলেন মঠবাড়িয়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক রুহুল আমীন দুলাল, মঠবাড়িয়া পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি কে এম হুমায়ুন কবীর, শামিম মৃধা ও মামুন আহম্মেদ।

×