সুন্দরবনে মাছ ধরতে যাওয়ার আগে জেলেদের প্রস্তুতি
সুন্দরবনের চাঁদাবাজিতে দিশাহারা জেলেরা। বনবিভাগ, স্মার্ট টহল দল ও কোস্ট গার্ডের কিছু অসাধু সদস্যকে চাঁদা দিতে হচ্ছে। এর পাশাপাশি নতুন করে জলদস্যুদেরও আনাগোনা শুরু হয়েছে বলে ভুক্তভোগী জেলেরা জানিয়েছেন।
ভুক্তভোগীরা জনান, প্রতি মাসে ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা করে চাঁদা না দিলে হামলার শিকার হতে হয়। আগে জলদস্যুদের বছরে একবার টাকা দিলে তারা নিরাপদে মাছ শিকার করতে পারত। স্মার্ট টহল দলের অসাধু সদস্যদের প্রতি মাসে ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হচ্ছে। টাকা না দিলে নৌকা ও জাল আটকে রাখাসহ বিভিন্নভাবে জেলেদের হয়রানি করা হয়। মিথ্যা মামলায় জেলেদের কারাগারেও পাঠানো হচ্ছে। চাঁদা না পেয়ে অনেক সময় গুলিবর্ষণও করা হয়। এ ধরনের গুলিতে আহত হয়ে এক জেলে এখন হাসপাতালে। পাশাপাশি সুন্দরবনে আবারও বাড়ছে জলদস্যুর উৎপাত।
জয়নাল মাঝি (৩০) নামে আহত এই জেলেকে দেখতে গিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন সুন্দরবনের কচিখালী-কটকা এলাকায় মাছ ধরা একাধিক জেলে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগে সুন্দর বনে জলদুস্যুর ব্যাপক উৎপাত ছিল। দীর্ঘদিন থেকে বিভিন্ন নামে বাহিনী গড়ে চলত দস্যুতা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় সেসব বাহিনীর দৌরাত্ম্য কমেছে। কিন্তু উৎপাত থেকে রেহাই মিলছে না জেলেদের। জেলেদের অভিযোগ, নিরাপদে মাছ শিকারের স্বার্থে বন বিভাগের গঠন করা ‘স্মার্ট টহল দল’ এখন গরিব নিরীহ মৎস্যজীবীদের কাছে আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেদের ঘরে ভাত থাকুক আর নাইবা থাকুক। প্রতি মাসে এদের চাঁদার অর্থ পরিশোধ করতেই হচ্ছে।
ভুক্তভোগী জেলেরা বলেন, আগে জলদস্যুদের একবার চাঁদা দিলে সারাবছর নিশ্চিত থাকা যেত। আমরা যাতে নিরাপদে সুন্দরবনের নদীগুলোতে মাছ শিকার করতে পারি, সে কারণেই সরকার বনদস্যুদের দমন করেছে। কিন্তু এখন বিভিন্ন বাহিনীর অসাধু সদস্যরাই আমাদের ওপর জুলুম ও অত্যাচার করছে। চাঁদার টাকা পরিশোধ না করায় গত ১৩ সেপ্টেম্বর রাত ৩টার দিকে সুন্দরবনের কচিখালী-কটকা এলাকায় মাছ ধরা অবস্থায় জেলেদের ওপর স্মার্ট টহল টিমের সদস্যরা গুলি চালায়। এ সময় জয়নাল মাঝি নামের এক জেলে গুলিবিদ্ধ হন।
কোস্ট গার্ড দক্ষিণ জোনের পাথরঘাটা স্টেশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গুলিবিদ্ধ জেলে জয়নাল মাঝিকে কচিখালী স্টেশনের সহযোগিতায় পাথরঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসা হয়। পাথরঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্তব্যরত চিকিৎসক রুবাইয়াত আলী বলেন, জয়নাল মাঝি ডান হাতে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় এসেছিল। প্রচুর রক্তক্ষরণ হওয়ায় তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে। পাথরঘাটা থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) জানান, বন বিভাগের স্মার্ট টহল টিমের হাতে এক জেলে গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পেয়ে আমরা হাসপাতালে যাওয়ার আগেই তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশালে পাঠানো হয়।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত জয়নাল মাঝি অভিযোগ করে বলেন, বলেশ্বর নদ সংলগ্ন সুন্দরবনের কচিখালী-কটকা এলাকায় মাছ ধরতে বন বিভাগের স্মার্ট টহল টিমের কিছু সদস্যকে প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা করে মাসোহারা দিতে হয়। চলতি মাসের টাকা না দেওয়ায় স্মার্ট একটি টহল টিম গত ১২ সেপ্টেম্বর রাত ৩টার দিকে আমাদের ধাওয়া করে। তখন প্রাণে বাঁচতে আমরা দ্রুত মাছ ধরার ট্রলার নিয়ে সরে যাওয়ার সময় স্মার্ট টিমের সদস্যরা এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে। এ সময় একটি গুলি এসে আমার ডানহাতে বিদ্ধ হয়।
বনবিভাগের স্মার্ট টহল দলের প্রতি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, সুন্দরবন এলাকায় মাছ ধরতে হলে স্মার্ট প্যাট্রল টিমকে টাকা দিতে হয়। তবে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) শেখ মাহবুব হাসান জেলেদের অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের কচিখালী অভয়ারণ্য এলাকার একটি খালে টহলকালে ট্রলার দেখতে পায় স্মার্ট টহল দল। তারা ট্রলারটিকে থামাতে নির্দেশ দিলে না দাঁড়িয়ে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। এ সময় ওই ট্রলার থেকে কিছু একটা পানিতে ফেলে দেওয়া হয়।
তখন বনরক্ষীরা তাদের থামাতে ফাঁকা গুলি ছুড়লে ফোর সিলিন্ডার ট্রলার নিয়ে বন বিভাগের স্পিড বোটে ধাক্কা দেয়। এতে তিন বনরক্ষী নদীতে পড়ে যায়। তখন বনরক্ষীরা গুলি ছোঁড়ে। তিনি আরও বলেন, ওই ট্রলারটিতে হয়তো ৫/৭ জন লোক ছিল। পরে সেখান থেকে খালে পাতা অবস্থায় নিষিদ্ধ বেহেন্দি জাল এবং বনে তল্লাশি করে হরিণ শিকারের ফাঁদ পাওয়া যায়। ধারণা করা হচ্ছে, তখন হয়তো তারা ট্রলার থেকে হরিণের মাংস পানিতে ফেলেছিল। এ ঘটনায় বন আইনে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।
এক সময় অপহরণ, ডাকাতিসহ নানা অপরাধের অভয়ারণ্য ছিল বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। চার বছর পর আবারও সুন্দরবনে দস্যুরা আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে আলাদাভাবে প্রত্যেক গ্রুপের কাছে দাবি করা হচ্ছে লাখ টাকার চাঁদা। সম্প্রতি বিকাশের মাধ্যমে কয়েকটি পরিবার কিছু টাকা পরিশোধও করে। ২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনের ৩২টি বাহিনীর প্রধানসহ ৩২৪ জন দস্যু আত্মসমর্পণ করে। মাছ ধরতে গিয়ে অপহৃত এক জেলে জানান, তাদের কয়েকজনকে টগিবগি এলাকা থেকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে দস্যুরা। এর পর হাত-মুখ বেঁধে আটকে রাখে। তাদের পরিবারের কাছে ফোন করে এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। এ ব্যাপারে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা ৩০ হাজার টাকা বিকাশের মাধ্যমে পাঠায়।
সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনা আমাদের নজরে এসেছে। তবে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি। এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কেউ যদি আবারও আতঙ্ক সৃষ্টি বা কোনো অপরাধ করার চেষ্টা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায়তাদের নির্মূল করা হবে।
এ প্রসঙ্গে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার বলেন, আমাদের কাছে ইতোমধ্যে এ জাতীয় অভিযোগ এসেছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে সুন্দরবন থেকে জলদস্যু মুক্ত করেছি। সরকারি কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।