লালমনিরহাটের গোকুন্ডায় তিস্তার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে
গত কয়েকদিনের টানা বর্ষণ এবং উজানের ঢলে লালমনিরহাটের কাউনিয়া পয়েন্ট ও কুড়িগ্রামে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে লালমনিরহাটের ৫ উপজেলার নিম্নাঞ্চলে ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছে পড়েছে। অন্যদিকে নওগাঁর মান্দায় বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে আত্রাই নদীর পানি। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় তলিয়ে যাচ্ছে নদীর উভয় তীরে ফসলি জমির আউশ ও আমন ধান। ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে আত্রাই ও ফকিন্নি নদীর উভয় তীরের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের অন্তত ৩০ পয়েন্ট। খবর স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতাদের।
ভারি বৃষ্টিপাতের ফলে বাড়ছে অন্যান্য নদ-নদীর পানিও। নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন নদী তীরবর্তী এলাকার আমন চাষিরা। সোমবার সকাল ৬টায় কাউনিয়া পয়েন্টে পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় বিপৎসীমার (২৮.৭৫) ৭ সেন্টিমিটার (২৮.৮২) ওপরে আর তিস্তা ব্যারাজের
ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় বিপৎসীমার ২৮ সেন্টিমিটার নিচে। তবে বিকেল ৩টায় তিস্তার পানি কমতে থাকায় কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। অপরদিকে ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি কমেছে আরও ১৭ সেন্টিমিটার। উল্লেখ্য, রবিবার ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপৎসীমার দশমিক ৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল।
টানা বর্ষণে তিস্তার কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ওপরে যাওয়ায় লালমনিরহাট সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, রাজপুর, গোকুন্ডা ইউনিয়নে নদী তীরবর্তী এলাকার পরিবারগুলো প্লাবিত হয়। এদিকে রবিবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে অবিরাম বৃষ্টিপাত বন্ধ হওয়ায় সোমবার দিনভর নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলায় বৃষ্টি হয়নি। তবে রবিবার সকাল ৯টার পর থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত তিস্তা অববাহিকার ডালিয়া পয়েন্টে ৯৬ মিলিমিটার ও কাউনিয়া পয়েন্টে ৮৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিপাত বন্ধ হওয়ায় এই দুই জেলায় নিম্নাঞ্চল, রাস্তাঘাট বসতবাড়ি ও আশ্রয়ণ পল্লীগুলো থেকে পানি নেমে যেতে শুরু করেছে। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আসফাউদ্দৌলা জানান, তিস্তার পানি প্রবাহ কাউনিয়াতে বেশি থাকলেও ডালিয়া পয়েন্টে কম রয়েছে।
কুড়িগ্রাম ॥ কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপৎসীমার ২৪৮ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপৎসীমার ২১৩ সেন্টিমিটার, কুড়িগ্রাম সদর পয়েন্টের ধরলা নদীর পানি বিপৎসীমার ৮০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষি কর্মকর্তা মো. খোরশেদ আলম বলেন, এ রকম বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে শীতকালীন মরিচ ও চালকুমড়াসহ বিভিন্ন শাক-সবজির ক্ষতি হতে পারে। এ ছাড়াও রোপা আমনেরও ক্ষতি হতে পারে। আবহাওয়া এ রকম থাকলে বিভিন্ন সবজিতে ক্ষতির আশঙ্কা আছে আর কি। কুড়িগ্রাম রাজারহাট কৃষি আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র সরকার বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় কুড়িগ্রামে ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। তবে আগামীকালের মধ্যে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
নওগাঁ ॥ নওগাঁ পানি উন্নয়ন বোর্ডের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েকদিন ধরে একটানা বর্ষণ চলছে। এ ছাড়া ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুরসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে ভারি বর্ষণ হয়েছে। ঢলের এসব পানি আত্রাই নদী দিয়ে প্রবাহিত হবে। এতে আগামী ২৪ ঘণ্টা একইভাবে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। আবহাওয়া পরিষ্কার না হলে এ নদীর পানি কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। এদিকে সোমবার বেলা ১১টার দিকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সভাকক্ষে বন্যার আগাম প্রস্তুতিমূলক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় আত্রাই ও ফকিন্নি নদীর ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে সার্বক্ষণিক তদারকির জন্য ৫ ইউনিয়নের অনুকূলে এক লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।
জানা গেছে, রবিবার সকাল থেকে আত্রাই নদীতে পানি বাড়তে শুরু করে। ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে তা বিপৎসীমা অতিক্রম করে ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে মদনচক, লক্ষ্মীরামপুর, বানডুবি, খুদিয়াডাঙ্গা, পশ্চিম নুরুল্লাবাদ, গোয়ালমান্দা, পারনুরুল্লাবাদ করাতিপাড়া, চকরামপুর, কয়লাবাড়িসহ অন্তত ৩০টি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য ইব্রাহীম হোসেন বলেন, ২০১৭ সালের বন্যায় চকরামপুর ও কয়লাবাড়ি বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়।
এর মধ্যে চকরামপুর বেড়িবাঁধের ভাঙন স্থানটি মেরামত করা হলেও কয়লাবাড়ি ভাঙন স্থানটি এখন পর্যন্ত খোলা অবস্থায় রয়েছে। নদীর পানি যেভাবে বাড়ছে তাতে সোমবার সন্ধ্যা নাগাদ ওই ভাঙন স্থান দিয়ে বেড়িবাঁধের ভেতরে পানি ঢুকতে শুরু করে। এতে বেড়িবাঁধের ভেতরে অন্তত ২০০ বিঘা জমির আমন ধান তলিয়ে যাবে। পানিবন্দি হয়ে পড়বে ২০০ পরিবার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লক্ষ্মীরামপুর গ্রামের এক বাসিন্দা জানান, নদীর পানি বাড়তে থাকায় লক্ষ্মীরামপুর পয়েন্ট চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, খরা মৌসুমে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্তারা দফায় দফায় এ স্থানটি পরিদর্শন করেন।
কিন্তু বাঁধটি টেকসই করতে আজ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সঠিক সময়ে বাঁধটি সংস্কার করা হলে বন্যা মৌসুমে এলাকার লোকজনকে আতঙ্কে দিন কাটাতে হতো না। এ প্রসঙ্গে জানতে নওগাঁ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ফইজুর রহমানের সঙ্গে মোবাইলফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। জানতে চাইলে মান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লায়লা আঞ্জুমান বানু বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের সার্বক্ষণিক মনিটরিং করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি নিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।
ঠাকুরগাঁও ॥ গত বৃহস্পতিবার থেকে অবিরাম বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে ঠাকুরগাঁওয়ের কয়েক হাজার হেক্টর জমির আমন ধান ও সবজিখেত। জলাবদ্ধতার কারণে ধানগাছ নষ্টের আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।
কৃষি অফিস জানায়, দুই-এক দিনের মধ্যেই যদি পানি নেমে যায়, তাহলে ধানের চারার তেমন ক্ষতি হবে না। তবে এর বেশি সময় এমন পরিস্থিতি থাকলে বিপদের কারণ হতে পারে। সেই সঙ্গে নতুন রোপণকৃত আগাম সবজিখেত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
কৃষি অফিস আরও জানায়, চল মৌসুমে ঠাকুরগাঁওয়ে এক লাখ ৩৭ হাজার পাঁচশ’ ৩৫ হেক্টর জমিতে রোপা আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে আমন রোপণ শেষ হয়েছে। কিন্তু ভারি বৃষ্টিপাতে অনেক এলাকায় আমনের চারা তলিয়ে গেছে। রবিমৌসুমে ৮ হাজার হেক্টর জমিতে সবজি চাষের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও ১৫শ’ হেক্টর জমিতে আগাম সবজি রোপণ করেছিলেন কৃষকরা।
সদর উপজেলার সালন্দর গ্রামের কৃষক আলাউদ্দিন বলেন, অনেক কষ্ট করে বাড়তি দামে তেল-সার কিনে তিন বিঘা জমিতে আমন ধান লাগিয়েছিলাম। কিন্তু কয়েকদিনের বৃষ্টিতে তা এখন পানির নিচে। ধানের চারা নষ্ট হলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।
বালিয়া গ্রামের কৃষক আব্দুল খালেক বলেন, অতিরিক্ত সুদে টাকা ধার করে পাঁচ বিঘা জমিতে ধান লাগিয়েছিলাম। টানা বৃষ্টিতে তা এখন পানিচে। ধানের চারা দেখা যাচ্ছে না। এই ফসল নষ্ট হলে নিঃস্ব হয়ে যাব।
শুখানপুকুর ইউনিয়নের কৃষক আব্দুল করিম বলেন, আমাদের গ্রামসহ আশপাশের এলাকার দেড় শতাধিক চাষির মুলা, ঝিঙে, বেগুন, করলাসহ বেশ কিছু আগাম সবজির ক্ষেত পানিতে ডুবে গেছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ফসলের জন্যে এই সময় বৃষ্টিটা অনেক প্রয়োজন ছিল। তবে অবিরাম বর্ষণ কিছুটা চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি আর বৃষ্টি না হয় এবং দ্রুত পানি নেমে যায়, তাহলে ধানের তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। ডুবে যাওয়া খেতের পানি নেমে গেলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা যাবে।