ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঝিনাইদহ-২

বড় দু’দলেই একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী

এম. রায়হান, ঝিনাইদহ

প্রকাশিত: ২৩:৪৫, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

বড় দু’দলেই একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী

ঝিনাইদহ সদর, হরিণাকুন্ডু উপজেলা, দুটি পৌরসভা ও ২১টি ইউনিয়ন নিয়ে ঝিনাইদহ-২ আসন

ঝিনাইদহ সদর, হরিণাকুন্ডু উপজেলা, দুটি পৌরসভা ও ২১টি ইউনিয়ন নিয়ে ঝিনাইদহ-২ আসন। আসনটিতে নির্বাচনী আমেজ এখন সর্বত্র। এলাকার চায়ের দোকান থেকে শুরু করে সর্বত্র এখন একই আলোচনা আগামী নির্বাচনে কে হচ্ছেন আসনটির কা-ারি, কোন প্রার্থীর কেমন জনপ্রিয়তা, বিজয়ের সম্ভাবনা কার বেশি ইত্যাদি এন্তার আলোচনা। 
আগামী নির্বাচনে আসনটি নিজেদের দখলে রাখতে এবং আসনটি পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে অবতীর্ণ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় সেদিক থেকে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে জামায়াত চাইছে আসনটি নিজেদের দখলে নিতে। তবে বড় দুই দলেই রয়েছে একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী। অভ্যন্তরীণ কোন্দলও রয়েছে। এ আসনে মোট ভোটার ৪ লাখ ২৩ হাজার ৪৫৫ জন।

এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ১১ হাজার ১০৪ জন ও নারী ভোটার ২ লাখ ১২ হাজার ৩৫১ জন। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঝিনাইদহ-২ আসনে আনোয়ার জাহিদ (জাপা), ’৯১ সালে মসিউর রহমান (বিএনপি), ৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনে মসিউর রহমান (বিএনপি), ’৯৬ সালের ২ জুনের নির্বাচনে মসিউর রহমান (বিএনপি), ২০০১ সালে মসিউর রহমান (বিএনপি), ২০০৮ সালে সফিকুল ইসলাম অপু (আ. লীগ), ২০১৪ সালে তাহজীব আলম সিদ্দিকী (স্বতন্ত্র) এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তাহজীব আলম সিদ্দিকী।
আগামী নির্বাচনে আসনটি থেকে মনোনয়ন পেয়ে তৃতীয়বারের মতো নৌকা প্রতীক নিয়ে জিততে চান আওয়ামী লীগ দলীয় বর্তমান সংসদ সদস্য তাহজীব আলম সিদ্দিকী সমি। তাঁর বাবা নূরে আলম সিদ্দিকী বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। নূরে আলম সিদ্দিকী ১৯৭৩ সালে এ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। গত নির্বাচনে তাহজীব আলম সিদ্দিকী সমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এ আসন থেকে নির্বাচিত হন। আবারও তিনি দলের মনোনয়ন পাওয়ার জন্য জোর লবিং করে যাচ্ছেন। 
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পৌর মেয়র সাইদুল করিম মিন্টু এবার শক্ত মনোনয়নপ্রত্যাশী। তিনি দলের মনোনয়নের জন্য ব্যাপক গণসংযোগ করে যাচ্ছেন। শহরের বিভিন্ন স্থানে ব্যানার বিলবোর্ডে তাঁর ছবি শোভা পাচ্ছে। এই মুহূর্তে তাঁর নাম তৃণমূল নেতাকর্মীদের মুখে উচ্চারিত হচ্ছে। তাঁর কর্মী-সমর্থকদের বক্তব্য, ইতোমধ্যে তিনি নবীন ও প্রবীণদের নিয়ে গঠিত জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের সাংগঠনিকভাবে গতিশীল করেছেন। এর মধ্যে তাঁর নেতৃত্বে অধিকাংশ ইউনিয়ন ও পৌরসভার ওয়ার্ড আ. লীগের সম্মেলন সম্পন্ন হয়েছে।

এ ব্যাপারে সাইদুল করিম মিন্টু বলেন, এবার ভয়াবহ করোনা মহামারির মধ্যে আমি নিজের জীবন বাজি রেখে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি। করোনা আক্রান্তদের নিজে হাসপাতালে নিয়েছি। তাদের বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছে দিয়েছি। করোনাকালীন মানুষের সেবা করতে গিয়ে নিজে করোনায় দুবার আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়েছি। তবুও সেবাদানে পিছপা হইনি। এখনো মানুষের সেবা করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, আমি শিক্ষাবান্ধব কাজ করতেও বেশি ভালোবাসি। যে সমস্ত অসহায় মেধাবী শিক্ষার্থী আছে আমি তাদের পাশে দাঁড়িয়েছি। এখনো নিজস্ব অর্থায়নে তাদের বৃত্তি প্রদান করে যাচ্ছি।

ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগ নেতা এবং সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম অপুও মনোনয়নপ্রত্যাশী। দলে তাঁরও একটি শক্ত গ্রুপ আছে। তিনিও মাঠে নেমে পড়েছেন কোমর বেঁধে। তৃণমূলে ভোটারদের কাছেও যাচ্ছেন। এবারো আওয়ামী লীগ থেকে মনোনায়ন পেতে তিনি মরিয়া। নির্বাচনী এলাকায় শফিকুল ইসলাম অপুর সৎ নির্ভীক রাজনীতিক হিসেবে বেশ সুনাম রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।

২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে শফিকুল ইসলাম অপু প্রথমবার মনোনয়ন পেয়ে বিএনপি থেকে চারবার নির্বাচিত (বিতর্কিত ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ) বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা শক্তিশালী প্রার্থী মসিউর রহমানকে প্রথমবারের মতো পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর কর্মী-সমর্থকদের দাবি, দলের অনেক প্রবীণ নেতা তার মনোনয়নের পক্ষে কাজ করছেন। তিনি আশা করেন এবারো তিনি দলীয় মনোনয়ন পাবেন এবং জয়লাভ করবেন।

শফিকুল ইসলাম অপু বলেন, আমি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পেয়ে বিজয়ী হলে প্রথম ৩ মাসের মধ্যে ঝিনাইদহে রেললাইন ও মেডিক্যাল কলেজের বাস্তবায়ন করব। ঝিনাইদহের ভঙ্গুর অবকাঠামোর উন্নয়ন করব। নতুন নতুন স্কুল কলেজ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করব। ঝিনাইদহকে সন্ত্রাস জঙ্গি ও মাদকমুক্ত করব। সর্বোপরি জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সোনার বাংলা গঠনে কাজ করে যাব। 
এদিকে জেলা আওয়ামী লীগের আরেক নেতা শিল্পপতি নাসের শাহরিয়ার জাহেদী মহুল। পরিবারের লোকজন তাকে ‘দাদাভাই’ বলেই সম্বোধন করেন। তিনি ঝিনাইদহ-২ আসন থেকে আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনায়ন চাইবেন এমন কথাও জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে। তিনি রেডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিক্যালস লিঃ এর চেয়ারম্যান। এলাকার অনেক বেকার যুবক তার প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। এ ছাড়া জাহেদী ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে দুস্থ অসহায় মানুষের মাঝে খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন।

বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকা-েও তাঁর ভূমিকা দৃশ্যমান। বিপুল অর্থ-বৈভব ও ধনসম্পদের মালিক তিনি। অতিসম্প্রতি ঝিনাইদহ পৌরসভা নির্বাচনে তাঁর ভাই নাসের শাহরিয়ার জাহেদী হিজল নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থীকে পরাজিত করে স্বতন্ত্র মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। নাসের শাহরিয়ার জাহেদী মহুল আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন এমন কথা তাঁর অনুসারীদের মুখে শোনা যাচ্ছে। তাঁর মুঠোফোনে একাধিকবার কথা বলার চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। ফলে তাঁর বক্তব্য দেওয়া সম্ভব হলো না। 
বিএনপি’র শক্ত মনোনয়ন প্রত্যাশী হচ্ছেন জেলা বিএনপি’র সভাপতি অ্যাডভোকেট এমএ মজিদ। তিনি মাঠে-ময়দানে বেশ জোরেশোরে কাজ করে যাচ্ছেন। এ আসনে তিনি বিএনপি থেকে দলীয় মনোনয়ন পাবেন এমন আশা করছেন। এ আসনে তাঁর শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মসিউর রহমান। তিনি ইন্তেকাল করেছেন। সে কারণে এ আসনে তিনি বিএনপির একক মনোনয়ন প্রত্যাশী বলে মনে করছেন।
অ্যাডভোকেট এমএ মজিদ বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে বিএনপি যাবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে দল যদি নির্বাচনে আমাকে মনোনয়ন দেয় তাহলে আমি নির্বাচন করতে প্রস্তুত আছি। এ ছাড়া গত নির্বাচনে বিএনপি থেকে আমাকে এ আসনের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছিল। সে কারণে এবারের নির্বাচনেও দল থেকে আমিই মনোনয়ন পাব বলে আশা রাখছি। তিনি বলেন, আমি যদি নির্বাচনে বিজয়ী হতে পারি তাহলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও গ্রাম্য অবকাঠামো উন্নয়ন করব। এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করে যাব। বিএনপির হারানো এ আসনটি আমি পুনরুদ্ধার করার জন্য জোর চেষ্টা করে যাব।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মসিউর রহমানের মৃত্যুর পর তার ছেলে ডাক্তার ইব্রাহীম রহমান বাবু আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি দলীয় মনোনয়ন চাইবেন বলে শোনা যাচ্ছে। তিনি সংগঠনের বিভিন্ন কর্মকা-ে জোরালো ভূমিকা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। তার পিতা ১৯৯১ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আসনটি থেকে টানা চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

মসিউর রহমান ঝিনাইদহে ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। জেলা শহরে যে সকল উন্নয়নের চিত্র দেখা যায় তা প্রায় সবই তার পিতার প্রচেষ্টায় হয়েছে, এমন দাবি করে পিতার ইমেজ কাজে লাগিয়ে নির্বাচনী মাঠে নেমেছেন ডাক্তার ইব্রাহীম রহমান বাবু। বাবু বলেন, দল যদি আমাকে মনোনয়ন দেয় তাহলে বিজয়ের ব্যাপারে আমি আশবাদী। আমি বিজয়ী হলে আমার পিতার মতো আমিও ঝিনাইদহ উন্নয়নে কাজ করে যাব। 
এই আসনে বিএনপির অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী হলেন সাবেক ছাত্রনেতা, বর্তমানে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মীর রবিউল ইসলাম লাবলু। তিনি আগামী সংসদ নির্বাচনে ঝিনাইদহ-২ আসন থেকে মনোনয়ন চাইবেন এমনটি জানিয়েছেন দলের নেতাকর্মীরা। তিনি মাঝে-মধ্যে ঢাকা থেকে এসে ঝিনাইদহ ও হরিণাকুন্ডু এলাকায় গণসংযোগ করে থাকেন। 
এ আসন থেকে জেলা জাতীয় পার্টির (এরশাদ) সহ-সভাপতি ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মেজর (অব.) মাহফুজুর রহমান আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিবেন বলে জানান দিচ্ছেন। তিনি এলাকায় আসছেন, গণসংযোগ করছেন। তিনি এই শীতে বেশ কয়েকবার গাড়ি ভর্তি করে শীতবস্ত্র এনে ঝিনাইদহে শীতার্ত মানুষের মাঝে বিতরণ করেছেন।
মাহফুজুর রহমান বলেন, এ আসন থেকে আমি দলের কাছে মনোনয়ন চাইব। দল আমাকে মনোনয়ন দিলে আমি অবশ্যই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব। নির্বাচন করার জন্য আমি ইতোমধ্যেই সকল প্রস্তুতি নিয়েছি। প্রতিনিয়ত সাধারণ ভোটারদের বাড়ি বাড়ি যাচ্ছি। তাদেরকে আমার কথা বলছি। আমি ভোটারদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পাচ্ছি। অবাধ সুষ্ঠু শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলে এ আসন থেকে বিজয়ের ব্যাপারে আমি আশাবাদী। 
এ আসনে জামায়াতের শক্ত ঘাঁটি রয়েছে। তবে তারা এখনো ঘাপটি মেরে আছে। তেমন কোনো প্রার্থীর গণসংযোগ করতে দেখা যাচ্ছে না। এ আসনের হরিণাকুন্ডু ও ঝিনাইদহ সদর উপজেলার পশ্চিমাংশে ও সদরের পশ্চিমাংশে জামায়াতের শক্ত অবস্থান রয়েছে। বর্তমানে জামায়াত গোপনে গোপনে সাংগঠনিক কর্মকা- করে যাচ্ছে। এ আসনে আওয়ামী লীগ অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব মিটিয়ে নির্বাচন করলে বিএনপি প্রার্থীর সঙ্গেই তাদের ভোটযুদ্ধ হবে বলে ভোটারদের দাবি।

×