ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বরেন্দ্রে ভূ-উপরিস্থ সেচ ব্যবস্থার তাগিদ বিএমডিএ’র

রাজশাহী অঞ্চলে থামানো যাচ্ছে না ব্যক্তিপর্যায়ে গভীর নলকূপ স্থাপন

নিজস্বসংবাদদাতা, রাজশাহী

প্রকাশিত: ১৫:৪৪, ২ জুলাই ২০২২

রাজশাহী অঞ্চলে থামানো যাচ্ছে না ব্যক্তিপর্যায়ে গভীর নলকূপ স্থাপন

ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবস্থায় খনন করা হচ্ছে খাল

ভুগর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে নিম্নমুখি পানি সংকট দেখা দেওয়ায় বরেন্দ্র অঞ্চলে কয়েক বছর থেকেই গভীর নলকূপ বসানো বন্ধ রেখেছে বরেন্দ্র বহুমূখি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) এর বিকল্প হিসেবে খাল খনন করা হচ্ছে তবে বরেন্দ্রজুড়ে থামানো যাচ্ছে না ব্যক্তি উদ্যোগে পাম্প বসিয়ে পানি তোলার মহোৎসব

সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানান, পরিবেশগত ঝুঁকি টের পেয়ে ২০১৪ সাল থেকে গভীর নলকূপ বসানো বন্ধ রেখেছে বিএমডিএ অবস্থায় সেচ সংকটের পেছনে ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের ব্যাপক হারে গভীর নলকূপ স্থাপন করে পানি উত্তোলনকে দুষছেন তারা

রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ নওগাঁ জেলার অধিকাংশ এলাকা এবং নাটোরসহ বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া পাবনা জেলার কিছু এলাকা নিয়ে গঠিত বরেন্দ্র অঞ্চল বিরূপ আবহাওয়ার কারণে কম বৃষ্টিপাত হওয়ায় অঞ্চলের কৃষি আবাদের সুবিধার জন্য ১৯৮৫ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সমীক্ষার পর রাজশাহী, নওগাঁ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় গভীর নলকূপ বসানো শুরু হয় প্রকল্পটির লক্ষ্য ছিল পুরো বরেন্দ্র অঞ্চলের লাখ ২৫ হাজার একর জমি সেচের আওতায় আনা

১৯৮২ সালে ইউএনডিপি প্রকাশিত প্রতিবেদনে বরেন্দ্র জোনকে জিরো এক্যুইফার হিসেবে দেখানো হয় তাতে উল্লেখ করা হয়, এলাকার ভূগর্ভস্থ স্তরে শুধু গৃহস্থালির প্রয়োজন মেটানোর মতো পানি রয়েছে এরপর ১৯৮৫ সালে বিষয়টি নিয়ে সমীক্ষা চালায় পানি উন্নয়ন বোর্ড সংস্থাটি কারিগরি প্রতিবেদনে জানায়, শুধু হস্তচালিত গভীর নলকূপে বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূগর্ভ থেকে পানি তোলা সম্ভব ওই বছরই বরেন্দ্র সমন্বিত এলাকা উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে সোয়া দুই লাখ একর জমি সেচের আওতায় আনার লক্ষ্যে রাজশাহী, নওগাঁ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় গভীর নলকূপ বসানো শুরু হয় এর মাধ্যমে ফসলের নিবিড়তা ১১৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৭৬ শতাংশে উন্নীত হয় এক পর্যায়ে প্রকল্প বিএমডিএ নামে স্থায়ী রূপ পায় বর্তমানে ১৫ হাজার ৫৫৩টি গভীর নলকূপে পানি তুলছে বিএমডিএ

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএমডিসি) ক্ষুদ্র সেচ সমীক্ষা প্রতিবেদন (২০১৯-২০) অনুযায়ী, রাজশাহী, নওগাঁ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় মোট সেচ পাম্প রয়েছে লাখ হাজার ৮৫৮টি এর মধ্যে বিএমডিএর ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয় মাত্র হাজার ৫২৫টি বাকি ৯৬ হাজার ৩৩৩টি পাম্প চলছে ব্যক্তিমালিকানায়

তিন জেলার লাখ হাজার ১৪৫ হেক্টর জমি সেচের আওতায় এসেছে এর মধ্যে বিএমডিএ সেচ দিচ্ছে লাখ ৯৫ হাজার ৭৬১ হেক্টর জমিতে বাকি লাখ ১১ হাজার ৩৮৬ হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া হচ্ছে ব্যক্তিগত সাবমার্সিবল পাম্প (এসটিডব্লিউ) থেকে

প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি ৫৩ হাজার ৯২৩টি ব্যক্তিমালিকানার পাম্প রয়েছে নওগাঁয় জেলার সেচের ৫১ শতাংশ তাদের দখলে বাকি ৪৯ শতাংশ জমি সেচ পাচ্ছে বিএমডিএর সেচ পাম্প থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহীতেও একই চিত্র রাজশাহীতে হাজার ৮৫২টি বিএমডিএর পাম্প চললেও এসটিডব্লিউ চলছে ২৭ হাজার ১০৫টি চাঁপাইনবাবগঞ্জের   হাজার ৫৮৩টি বিএমডিএর পাম্পের পাশাপাশি ১৫ হাজার ৩১৫টি এসটিডব্লিউ চলছে

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনোভাবেই ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনে এককভাবে বিএমডিএকে দায়ী করা যায় না যদিও তারাই এর শুরুটা করেছে পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে ২০১৪ সাল থেকে গভীর নলকূপ বসানো বন্ধ রেখেছে বিএমডিএ কিন্তু বন্ধ নেই ব্যক্তিমালিকানায় পাম্প বসানো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই পাম্প চলছে

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১১ সালে ব্যক্তিগতভাবে গভীর নলকূপ স্থাপন করেন গোদাগাড়ী পৌর এলাকার লালবাগ সরমঙ্গলা গ্রামের বাসিন্দা হাসান আলী যদিও তার সেচ পাম্পের পাশেই সরমঙ্গলা খাল থেকে পানি সরবরাহের জন্য বিএমডিএর ভূ-উপরিস্থ সেচ নালা রয়েছে

যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েই গভীর নলকূপ বসানোর দাবি করে হাসান আলী বলেন, তার মতো এলাকায় ৪০-৫০ জন ব্যক্তি গভীর নলকূপ স্থাপন করেছেন ওই এলাকার বেশির ভাগ সেচের পানি সরবরাহ হয় ব্যক্তি উদ্যোগে বসানো গভীর নলকূপ থেকে

বিএমডিএর নওগাঁর নিয়ামতপুর জোনে গভীর নলকূপ স্থাপনের হালনাগাদ তথ্য নেই বছর দুয়েক আগের হিসাবে উপজেলায় বিএমডিএ পরিচালিত গভীর নলকূপ রয়েছে ৬৯৪টি এছাড়া ব্যক্তিমালিকানাধীন ১৯২টি গভীর নলকূপ এবং ৮৩৩টি এসটিডব্লিউ রয়েছে উপজেলায় দুই বছরে ব্যক্তিমালিকানাধীন গভীর নলকূপ এসটিডব্লিউর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে রসূলপুর ইউনিয়নে দুই বছর আগে ১৩৫টি গভীর নলকূপের পাশাপাশি ১৪২টি এসটিডব্লিউ বসানো হয়েছে

জোনের সহকারী প্রকৌশলী মতিউর রহমান জানিয়েছেন, উপজেলার অন্যান্য ইউনিয়নের চেয়ে রসূলপুরে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে ফলে এতদিন এখানে সীমিত ব্যক্তিমালিকানাধীন গভীর নলকূপ ছিল কিন্তু সম্প্রতি রাজনৈতিক চাপে প্রচুর এসটিডব্লিউ বসানো হয়েছে কেউ কেউ জমির পরিমাণ বেশি দেখিয়ে একাধিক এসটিডব্লিউ বসিয়েছেন কোথাও কোথাও তারা বিএমডিএর সেচের অধিক্ষেত্রেও ভাগ বসাচ্ছে কিন্তু কিছুই করতে পারছে না বিএমডিএ

অবস্থায় পানি শাসনের ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা জরুরি বলে মনে করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক . চৌধুরী সারওয়ার জাহান সজল তিনি বলেন, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করে তাদের মধ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে দেশের একমাত্র তিন ফসলি জমি বরেন্দ্র অঞ্চলেই এখানে সেচের ক্ষেত্রে নানা চ্যালেঞ্জ আছে জাতীয় গড় বৃষ্টিপাতের প্রায় অর্ধেক বৃষ্টিপাত হয় এলাকায় একবার বৃষ্টি হলে দীর্ঘদিন খরা যায় ফলে ফসল বাঁচাতে কৃষকদের প্রচুর ভূগর্ভস্থ পানি তুলতে হয় এজন্যই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ পড়ে

বরেন্দ্রজুড়ে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় সম্ভাব্যতা যাচাই কমিটির সদস্য . চৌধুরী সারওয়ার জাহান সজল বলেন, বিধিনিষেধের কারণে বিএমডিএ আর গভীর নলকূপ বসাচ্ছে না কিন্তু ব্যক্তিগত উদ্যোগ থামানো যাচ্ছে না তাদের থামানোর জন্য দেশে পানি আইন পানি বিধিমালা রয়েছে সেটা সরকার বাস্তবায়নের জন্য উদ্যোগী না হলে সর্বনাশা কার্যক্রম থামবে না এর সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাব জড়িত ফলে আইন না মেনেই সংশ্লিষ্ট যে দফতরগুলোর কাজ করার কথা তাদের তোয়াক্কা না করেই বা চাপ প্রয়োগ করে গভীর নলকূপ বসানো হচ্ছে

বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রশিদ বলেন, ভূগর্ভস্থ সেচ কার্যক্রম বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষ শুরু করেছিল ঠিকই, কিন্তু প্রযুক্তির হাতবদল হয়েছে সেচের গুরুত্ব বাড়ায় ব্যক্তিমালিকানায় ছোট গভীর নলকূপ বসানো হচ্ছে এমনকি বরেন্দ্র সেচের অধিক্ষেত্রে প্রচুর পরিমাণে এমন গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে এটা কোনোভাবে থামানো যাচ্ছে না এখন রাজশাহী, নওগাঁ   চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় ৫৮ শতাংশ পানি তোলে বিএমডিএ বাকি ৪২ শতাংশ পানি তোলে ব্যক্তিমালিকানাধীন গভীর নলকূপ সেচ ছাড়াও ভূগর্ভস্থ পানি কলকারখানায় ব্যবহার হচ্ছে মাছ চাষের জন্য পুকুরেও ব্যবহার হচ্ছে ফলে বিএমডিএ পানি তুলে ভূগর্ভ খালি করে দিচ্ছে- কথা ঢালাওভাবে বলার সুযোগ নেই

বিএমডিএ সূত্র জানায়, পরিবেশগত ঝুঁকি বিবেচনায় ২০১৪ সালে গভীর নলকূপ স্থাপন বন্ধ করে কেবল পুরনোগুলো মেরামত করে চালু রাখা হয়েছে সেটি না হলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হবে খাদ্যনিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে

বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালক আরো বলেন, এখন ভূ-উপরিস্থ সেচ কার্যক্রম সম্প্রসারণ করেছি পদ্মা মহানন্দা আত্রাই নদীর পানি তুলে সেচের কাজে লাগানো হচ্ছে বৃষ্টির পানি আহরণে বড় বড় পুকুর-দিঘি এবং খাল পুনর্খনন হচ্ছে এখন সেচের প্রায় ১০ শতাংশ পানি আসছে ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে আমরা চেষ্টা করছি ধীরে ধীরে ভূ-উপরিস্থ সেচের পরিধি বাড়ানোর আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে সেচ ৩০ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে

 

 

×