ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পিঠা শিল্পে অনন্য নারীরা

প্রকাশিত: ০৯:২৬, ১ মার্চ ২০১৯

পিঠা শিল্পে অনন্য নারীরা

আবহমানকাল থেকেই বাংলার ঘরে ঘরে পিঠা তৈরির চল ছিল। কিন্তু সেই পিঠার সঙ্গে তুলনা করতে গেলে বর্তমানের আধুনিক সময়ের পিঠা তৈরির পরিকল্পনায় এসেছে ভিন্নতা আর এর শৈল্পিক কিছু ধারা যা সবাইকে মোহিত করতে বাধ্য। সেই ক্ষেত্রে স্বাদেরও তারতম্য ঘটেছে। কিন্তু আবহমানকালের পিঠার স্বাদের ব্যাপ্তি তা অনন্য হয়ে আছে এক সময় যারা নানি-দাদির হাতে পিঠা খেয়েছে তাদের কাছে। সেই নানি-দাদি ও মায়েদের নানা মজাদার পিঠার স্বাদ আর ব্যাপ্তিকে প্রসারিত করতে কুকিং এ্যাসোসিয়েশন আয়োজন করেছিল পিঠা প্রতিযোগিতা। দেশের প্রতিটি এলাকা থেকে প্রায় ৭০ জন প্রতিযোগী তাদের নিজেদের মেধা ও মনন দিয়ে যে ধরনের পিঠা তৈরি করেছে তা শুধু শৈল্পিক দিক দিয়ে আকর্ষণীও ছিল না এর স্বাদেও ছিল ভিন্নতা। আগত অতিথিরা প্রতিযোগীদের পিঠা খেয়ে এর মন জুড়ানো স্বাদের কারণে ফিরে গেছেন অতীতের নানা-দাদিদের সেই মমতাময়ী মধুর জগতে। আর এখানেই এই পিটা উৎসবের সার্থকতা। এবার প্রতিযোগীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় সংসদের সম্মানিত সংসদ সদস্য মেহের আফরোজ চুমকি, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন হাসনীন মুকতাদির ও অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কুকিং এ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট কেকা ফেরদৌসী। কুকিং এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মেহেরুন নেসা বলেন ‘প্রতিযোগিতার প্রায় এক মাস আগে থেকে অংশগ্রহণকারীদের নাম রেজিস্টেশন করতে বলা হয়। এবার ষষ্ঠবারের মতো অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতার প্রায় ৭০ জন প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিযোগীরা আসলেও ঢাকার প্রতিযোগীর সংখ্যাই বেশি ছিল।’ প্রতিবছর বাড়ছে অংশগ্রহণকারীর সংখ্য। রান্না যে একটি শিল্প তা অনুধাবন করা গেছে প্রতিযোগীদের বিভিন্ন ধরনের পিঠা তৈরির কারুকার্য দেখ। শুধু তাই নয় পিঠা বিচারকদের সামনে উপস্থাপনের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে ভিন্নতা ও ব্যতিক্রমী আঙ্গিক। প্রতিযোগিতার বিচারক ও কুকিং এ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট রিমা জুলফিকার বলেন, প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এক জেলার পিঠার সঙ্গে অন্যা জেলার প্রতিযোগীদের একটা যোগাযোগ তৈরি হয় এবং অংশগ্রহণের মাধ্যমে একে অপরের কাছে রেসিপি বিনিময়ের মাধ্যমে এক এলাকার পিঠা অন্য এলাকায় পৌঁছে যায়। ফলে পিঠা পায় সার্বজনীন একটি রূপ। ফলে প্রতিযোগীদের মধ্যে পরবর্তীতে আরও ভাল পিঠা তৈরির আগ্রহ সৃষ্টি হয়। আর সেরা পিঠা নির্বাচনের সময়ে পিঠার নতুনত্ব, এর স্বাদ, রং ব্যবহারে সতর্কতা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও শৈল্পিক দিকটির দিকে বিশেষ নজর দেয়া হয়।’ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন সাবিহা মরজানা লুশি। তিনি মূলত গোপালগোঞ্জ থেকে সেই এলাকার একটি পিঠা তৈরি করে আনের। পিঠার গড়ন কমলার মতো হওয়ার করণে এর নাম দেন ‘কমলা সুন্দরী’। যেসব উপাদান দিয়ে পিঠা তৈরি করা হয়েছে এর মধ্যে অন্যতম সুজি, চালের গুঁড়া, ঘি, ডিম, দুধ, চিনি এবং ফুডকালার। দেখতে হুবহু কমলার মতো হলেও ফুডকালার ব্যবাহর করার কারণে তিনি পুরস্কার পাননি। অপর এক প্রতিযোগী রেজওয়ানা বরকত এসেছিলেন বরিশাল থেকে। চাঁদের গড়নে তৈরি পিঠা সবার দৃষ্টিকাড়ে। আর এর গড়নের কারণে এর নাম দেন চন্দ্র পুলি পিঠা। পিঠা তৈরিতে উপকরণ হিসাবে তিনি ব্যবহার করেন নারিকেল, সুজি, ছানা, চিনি, দুধ, দুধের ক্ষীর ও মসলা। দেখতে আকর্ষণীয় হলেও তিনি পুরস্কার পাননি। তারপরেও তিনি খুশি কারণ তার রেসিপি অনেকে সংগ্রহ করেছে এবং অনেকের সঙ্গে যোগাযোগের সাধ্যমে পিঠা তৈরিতে তিনি পরবর্তীতে বৈচিত্র্য আনতে পারবেন বলে মনে করেন। আরও যেসব পিঠা দর্শকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল তার মধ্যে অন্যতম চিড়ার মালাই পিঠা, তালের খিলি, পালং কিমা, মা মালাই, পাটিশাপটা, আস্ত চালের বিবিখানা পিঠা, আত্মিক্কীয়া পিঠা, নকশী পিঠা, ক্ষীর পাটিশাপটা, কাঠিতে ম্যারা পিঠা, মালাই ক্ষীরমা পুলি ইত্যাদি। এবার প্রতিয়োগিতায় প্রথম হয়েছেন আফসানা আশপিয়া। তিনি খুলনা অঞ্চলের একটি পিঠা তৈরি করেছেন যার নাম দিয়েছেন ‘চুই ঝাল পিঠা’। তিনি পেয়েছেন ১০ হাজার টাকা, একটি ক্রেস্ট ও সার্টিফিকেট। দ্বিতীয় হয়েছেন মেহেদী হাসান। তিনি ঢাকার একটি হোটেলে কর্মরত এবং প্রতিযোগিতার জন্য ‘পাকান পিঠা’ তৈরি করেছিলেন। সার্টিফিকেট ও ক্রেস্ট ছাড়া তিনি পেয়েছেন নগদ সাত হাজার টাকা পুরস্কার। তৃতীয় পুরস্কারের মূল্যমান ছিল পাঁচ হাজার টাকা। এই পুরস্কারটি পেয়েছেন নুসরাত খান। তিনি প্রতিযোগিতার জন্য তৈরি করেন ‘আতিকা পিঠা’। এছাড়াও আরও সাতজন প্রত্যেকে পেয়েছেন এক হাজার টাকা, ক্রেস্ট ও সার্টিফিকেট। প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ শেষে কুকিং এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কেকা ফেরদৌসী বলেন, প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমাদের ঐতিহ্যবাহী পিঠা সম্পর্কে জানতে পারে। আর প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আমরা যারা পিঠা তৈরি করতে পারে তাদের পরিচিত করার চেষ্টা করেছি। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সবাই একটা বিষয় জানাতে ও বুঝতে পারছে যে পিঠার বাইরের আকৃতি শুধু সুন্দর হলেই হবে না সেইসঙ্গে খাদ্যমানও যথাপযুক্ত হতে হবে। কুকিং এ্যাসেসিয়েশনের প্রতিটি সদস্য, বিচারক ও মিডিয়া কর্মীদের ঐকান্তিক চেষ্টায় পিঠা উৎসবের প্রতি অংশগ্রহণকারীদের আরও আগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছে। বিষয়টি অবশ্যই আনন্দের একটি নতুন আবহের সৃষ্টি করে। কুকিং এ্যাসোসিয়েশন ভবিষ্যতে আরও সুন্দর এবং আকর্ষণীয়ভাবে পিঠা উৎসবসহ বিভিন্ন ধরনের রান্না প্রতিযোগিতার আয়োজনের ইচ্ছা রাখে।’ প্রধান অতিথি মেহের আফরোজ চুমকি এমপি জানান, বিদেশে বাংলাদেশের রান্না ও পিঠার বেশ কদর আছে। তাই এই বিষয়ে আর প্রচার ও প্রসারের প্রয়োজন আছে বলে তিনি মনে করেন না। তিনি কুকিং এ্যাসোসিয়েশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহযোগিতায় এগিয়ে আসার অনুরোধ করেন। তিনি ভাষার মাসে এই ধরনের প্রতিযোগিতার আয়োজনের জন্য কর্তৃপক্ষকে স্বাগত জানান। বিশেষ অতিথি হাসনীন মুকতাদির কুকিং এ্যাসোসিয়েশনের এই আয়োজনকে নারীদের জন্য একটি বড় প্লাটফ্রম বলে মনে করেন। পিঠা যারা তৈরি করে তারা যে শিল্পী এবার পিঠা প্রতিযোগিতায় তা প্রতিয়োমান হয়েছে বলে মনে করেন। কুকিং এ্যাসোসিয়েশনের আর এক সদস্য এবং অনুষ্ঠানের উপস্থাপক আঞ্জুমান আরা সেতু বলেন, ‘কুকিং এ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে এর সদস্যরা প্রতিষ্ঠানটিকে নিজেদের একটা ভরসার স্থল মনে করেন। একাই কোন কিছু করা সম্ভব নয়। সবাই এক সঙ্গে মিলে অনেক কিছু করা সম্ভব। যেমন এই পিঠা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সাবই তাদের পিঠা তৈরির কৌশল দেখানোর সুযোগ পেয়েছে এটাই সব থেকে বড় পাওয়া।’ শুধু সেতু নয় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীরা সবাই এই মত ব্যক্ত করেন। কুকিং এ্যাসোসিয়েশন তাদের কর্মকা- আর বিস্তৃত করবে উপস্থিত সবাই সেটাই আশা করেন।
×