ঘূর্ণিঝড় দানার প্রভাবে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি ও দমকা হাওয়ায় নুয়ে পড়েছে কৃষকদের আধা কাঁচাপাকা আমন ধান
এ বছর দেশে বর্ষা মৌসুম শেষ হয়েছে গত ১৪ অক্টোবর। তা সত্ত্বেও বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’ তৈরি হয়েছে। আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা বলছেন, অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসে ঘূর্ণিঝড়ের ঘটনা নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশ ও ভারত বহুবার এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়েছে। ১৮৯১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০০টি ঘূর্ণিঝড়ের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে।
মূলত এই সময়ে বঙ্গোপসাগরে পানির তাপমাত্রা বেশি থাকায় এসব ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানান আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে সাগরের তাপমাত্রা বেশি থাকায় পানির বাষ্পায়ন বাড়ে এবং ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়। ফলে এই সময়ে সাগরে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়।
আবহাওয়া অফিস জানায়, শেষ পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড় দানা শুক্রবার রাত তিনটার দিকে ভারতের ওড়িশা উপকূলে আঘাত করে দুর্বল হয়ে স্থল নি¤œচাপে পরিণত হয়। ওড়িশা উপকূলে এটি ঘণ্টায় ১১০-১২০ কিলোমিটার গতিতে আঘাত হানে। শুক্রবার সকাল সাতটা পর্যন্ত সেই ঝড়ের দাপট চলে। ‘দানা’র দাপটে তছনছ হয়ে যায় ওড়িশা উপকূল। গাছ উপড়ে, বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তুমুল ঝড়বৃষ্টি হয়। ওড়িশায় কোনো মৃত্যুর ঘটনা না ঘটলেও পশ্চিমবঙ্গে দানায় একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় দানা বাংলাদেশে সরাসরি আঘাত না হানলেও উপকূল অঞ্চলে এটির প্রভাব পড়বে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, উপকূলীয় ১৪ জেলায় জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। তবে এর প্রভাবে বঙ্গপোসাগর উত্তাল থাকলেও উপকূলীয় জেলাগুলোতে দানার বড় ধরনের কোনো প্রভাব পড়েনি। সাগর উত্তাল ছিল। উপকূলে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছে। কোনো কোনো জেলায় গাছের ডাল ভেঙে বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই মাসগুলোতে ঘূর্ণিঝড় কেন হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ ও ঘূর্ণিঝড় গবেষক আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ১৮৯১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৭৪টি ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। এর মধ্যে নভেম্বর মাসে সবচেয়ে বেশি ঘূর্ণিঝড় রেকর্ড করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘গত ১৩৩ বছরে নভেম্বরে ১৩৩টি ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। এছাড়া অক্টোবরে ৯৪টি এবং ডিসেম্বর মাসে ৫৫টি রেকর্ড করা হয়েছে।’
যদিও দীর্ঘমেয়াদে নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় বেশি দেখা গেছে, কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অক্টোবরেও ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা বাড়ছে। এ প্রসঙ্গে আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ১৯৬৭ সালের অক্টোবরে বঙ্গোপসাগরে একসঙ্গে তিনটি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছিল। এর মধ্যে দুটি বাংলাদেশে আঘাত হানে, একটি কক্সবাজারে এবং অন্যটি হাতিয়ায়। বাকি ঘূর্ণিঝড়টি শ্রীলঙ্কায় আঘাত করেছিল।
সর্বশেষ, ২০২৩ সালের ঘূর্ণিঝড় ‘হামুন’ ২১ থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রভাব ফেলেছিল। একইভাবে ২০২২ সালে ‘সিত্রাং’ ২২ থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে আঘাত হেনে সন্দ্বীপের স্থলভাগে আছড়ে পড়ে।
এ বছরের ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’ও ২২ অক্টোবর সৃষ্টি হয়েছে এবং ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত এটির প্রভাব সক্রিয় ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একই সময়ে ধারাবাহিকভাবে ঘূর্ণিঝড় তৈরি হচ্ছে বলে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। এটি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘটতে পারে বলে আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
বর্ষার পর ঘূর্ণিঝড় কেন সৃষ্টি হয়Ñ এ প্রসঙ্গে আবহাওয়াবিদ মল্লিক জানান, বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়ার পর কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতি ঘূর্ণিঝড়ের গঠনের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
তিনি বলেন, সেপ্টেম্বরের ২৩ তারিখ দিবারাত্রি সমান হয় এবং এর পর সূর্যের আলো তীর্যকভাবে সাগরে পড়তে শুরু করে, যা সাগরের পানি দ্রুত উষ্ণ করে তোলে। এ কারণে অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে সাগরের তাপমাত্রা বেশি থাকায় পানির বাষ্পায়ন বাড়ে এবং ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়।
এ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির জন্য সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা কমপক্ষে ২৬.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকা আবশ্যক এবং পানির গভীরতার কমপক্ষে ৫০ মিটার পর্যন্ত এ তাপমাত্রা থাকতে হয়। আর অক্টোবরে এ তাপমাত্রা খুব সহজেই অতিক্রম করে যায়।
একই কথা বলছেন, কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক ও আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল পলাশ। তিনি ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা বাড়ার ক্ষেত্রে সমুদ্রের তাপমাত্রার প্রভাব ব্যাখ্যা করে বলেন, বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হলে আবহাওয়াবিদরা সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির তাপমাত্রার মানচিত্র বিশ্লেষণ করেন। গরম পানি ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি দ্রুত বৃদ্ধি করে।
তিনি আরও বলেন, অক্টোবরের ২২ তারিখ বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা অনেক বেশি ছিল, বিশেষত ওড়িশা উপকূলের কাছে। ফলে ঘূর্ণিঝড় দানা ওড়িশা উপকূলেই আঘাত হানার সম্ভাবনা বেশি ছিল এবং শেষ পর্যন্ত সেটিই হয়েছে।