ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৩ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল ॥ বিশ্বকাপের আসল উন্মাদনা

জাহিদুল আলম জয়

প্রকাশিত: ২৩:১৫, ১২ জুন ২০২৫

আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল ॥ বিশ্বকাপের আসল উন্মাদনা

দুই বিশ্বনন্দিত তারকাÑ আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসি ও ব্রাজিলের নেইমার

বিশ্ব ফুটবলেরই শুধু নয়; বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনেরই সবচেয়ে জনপ্রিয় দল ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। এ দু’টি দেশের নান্দনিক ফুটবলের জন্য গোটা দুনিয়া পাগল। বিশেষ করে বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় গোটা বিশ্ব দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। ২০২৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোয় অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ২৩তম বিশ্বকাপেও এর ব্যতিক্রম হবে না। 
ইতোমধ্যে লিওনেল মেসি ও নেইমারের দেশ আগামী বিশ্বকাপে খেলার টিকিট নিশ্চিত করেছে। আর্জেন্টিনা কয়েক মাস আগে দাপটের সঙ্গে বিশ্বকাপের টিকিট কাটে। বুধবার সব শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে বিশ্বকাপ মঞ্চে খেলা নিশ্চিত করেছে রেকর্ড সর্বোচ্চ পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলও। এর মধ্য দিয়ে ২৩-এ ২৩ অর্থাৎ সব বিশ্বকাপে খেলার একমাত্র রেকর্ডটি ধরে রেখেছে সাম্বা ছন্দের দেশ। পেলের দেশ ছাড়া আর কোনো দেশের প্রতিটি বিশ্বকাপে খেলার নজির নেই। ব্রাজিলের বিশ্বকাপ খেলা নিশ্চিত হওয়ার মধ্য দিয়ে গোটা দুনিয়ায় ফুটবলপ্রেমীরাও হাফ ছেড়ে বেঁচেছেন। কেননা তারা কিছুতেই চান না, ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনাকে ছাড়া বিশ্বকাপ হোক। সেটা হলে সেই বিশ্বকাপের উন্মাদনা যে অর্ধেকে নেমে আসবে সেটা বলাই বাহুল্য। 
রেকর্ড সর্বোচ্চ পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল সবশেষ সোনার ট্রফি জিতেছে সেই ২০০২ সালে। অর্থাৎ সময়ের হিসেবে ২৩ বছর বিশ্বসেরা হতে পারেনি সেলেসাওরা। আগামী বিশ্বকাপে সময়টা দাঁড়াবে দুই যুগে। অন্যদিকে কাতার বিশ্বকাপের আগে আর্জেন্টিনার অবস্থা ছিল আরও করুণ। কিংবদন্তি দিয়াগো ম্যারাডোনার হাত ধরে আলবিসেলেস্তারা সেই ১৯৮৬ সালে সবশেষ বিশ্ব জয় করেছিল। এরপর গুনে গুনে তিন যুগ অতিবাহিত হয়। কিন্তু সোনার ট্রফি আর ছুঁয়ে দেখতে পারছিল না। অর্থাৎ ৩৬ বছর ধরে বিশ্বকাপ ট্রফির জন্য হাহাকার করছিল আর্জেন্টিনা। অবশেষে সেই খরা আলবিসেলেস্তারা ঘুচিয়েছে ২০২২ কাতার বিশ্বকাপে। সুপারস্টার লিওনেল মেসির জাদুকরি পারফরম্যান্সে ভর করে তিন যুগ পর বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা। 
১৯৮৬ সালে সর্বকালের সেরা ফুটবলার দিয়াগো ম্যারাডোনার নৈপুণ্য বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল আর্জেন্টিনা। সেবার ম্যারাডোনার মায়াময় পারফরম্যান্স শত্রু-মিত্র সবাইকে এক সুতায় গেঁথেছিল। ওই বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার চোখ ধাঁধানো পারফরম্যান্সের কারণেই মূলত সারাবিশ্বে আর্জেন্টিনার কোটি কোটি ভক্ত-সমর্থকের সৃষ্টি হয়। ম্যারাডোনা থেকে মেসিÑ সেই ধারা এখন আরও বেগবান হয়েছে। ১৯৯০ সালে নিজে কেঁদে ও ১৯৯৪ সালে সবাইকে কাঁদিয়ে বিদায় নিয়েছিলেন ম্যারাডোনা।

২০১০ সালে ফের এসেছিলেন মুকুট জয়ের লক্ষ্যে। কিন্তু মেসি, তেভেজদের কোচ হয়ে দেখা পাননি সাফল্যের। ২০১৪ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপে নিঃশ্বাস দূরত্বে পৌঁছে গিয়েছিল লিওনেল মেসির দল। কিন্তু ফাইনাল মহারণে ফের জার্মানির কাছে হেরে হৃদয় ভাঙে ফুটবলপাগল দেশটির। ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপেও সঙ্গী হয় ব্যর্থতা। প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে ফ্রান্সের কাছে ৪-৩ গোলে হেরে গোছাতে হয় তল্পিতল্পা। এরপর কাতারে সেই দুঃখ, কষ্ট, গ্লানি দূর করেন মেসি। এখন আর্জেন্টিনা বলতেই এসে যায় দুই কিংবদন্তি ম্যারাডোনা ও মেসির নাম। মূলত ম্যারাডোনার ম্যাজিকের কারণেই বাংলাদেশে আর্জেন্টিনার সমর্থক এখন ব্রাজিলের চেয়ে বেশি। বিষয়টা এমন যে, এরা যতটা না আর্জেন্টিনার সমর্থক তার চেয়ে অনেকটাই বেশি ম্যারাডোনার। এখন এই তালিকায় যোগ হয়েছে আরেক নক্ষত্র, লিওনেল মেসি। 
অন্যদিকে ছন্দময় ও শৈল্পিক ফুটবলের পূজারি বলা হয় ব্রাজিলকে। যুগে যুগে দেশটির কিংবদন্তি ফুটবলারদের নয়নজুড়ানো পারফরম্যান্সে বিমোহিত হয়েছে গোটা দুনিয়া। আগামী বিশ্বকাপেও সাম্বা ছন্দ দেখাতে চায় পেলের দেশ। দুই যুগের অপেক্ষা ঘুচিয়ে ব্রাজিল ‘হেক্সা’ অর্থাৎ ষষ্ঠবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন বুনছে। এই মিশনে তাদের প্রাণভোমরা নিঃসন্দেহে সুপারস্টার নেইমার। কিন্তু চোট কাটিয়ে তিনি কতটা প্রাণবন্ত হয়ে খেলতে পারবেন সেটা দেখার আছে। সাফল্যের পরিসংখ্যানে ব্রাজিল মানেই সেরা হওয়া। ‘দ্বিতীয়’ হওয়াটাকেও দেশটি ব্যর্থতা হিসেবে মনে করে।

১৯৭০ সালে বিশ্বকাপ জয়ের পর দীর্ঘ দুই দশক পর ১৯৯৪ সালে আবারও বিশ্বকাপ জেতে বনিতোরা। আধুনিক যুগে এসে এ সময় থেকেই মূলত দেশটি অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। ১৯৯৪ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত টানা তিন বিশ্বকাপে ১২ বছর বিস্ময়কর সাফল্য দেখায় ব্রাজিলিয়ানরা। এ সময়ের তিনটি বিশ্বকাপের প্রতিটিতেই ফাইনালে খেলে ব্রাজিল এবং দু’টিতে চ্যাম্পিয়ন হয়। এমন আকাশচুম্বী সাফল্যের পর ব্রাজিল দল যেন সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। এ কারণেই ২০০৬ বিশ্বকাপে ‘হেক্সা’ জয়ের স্বপ্ন নিয়ে জার্মানি পাড়ি জমায় লুই ফিলিপ সোলারির দল।

ওই সময় রোনাল্ডিনহোরা এতটাই ফর্মের তুঙ্গে অবস্থান করছিলেন যে বিশ্বকাপ জয় করা নিয়ে কোনো সংশয় ছিল না! কিন্তু চূড়ান্ত লড়াইয়ে খেই হারিয়ে বিদায় নিতে হয়  পেলের দেশকে। এরপর ২০১০ দক্ষিণ আফ্রিকা ও ২০১৪ সালে নিজ দেশে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপেও ‘ফেল’ করে ফুটবলপাগল দেশটি। শুধু তাই নয়, ২০১৮ সালে রাশিয়া বিশ্বকাপেও কাঁদতে হয় নেইমারদের। ২০২২ সালে মরুর দেশ কাতারেও সঙ্গী হয় ব্যর্থতা। 
চার বছর পর আবারও বিশ্বকাপের বাঁশি বাজার অপেক্ষা। আর মাত্র ৩৬৩ দিন পর পর্দা উঠবে ২৩তম বিশ্বকাপের। যেখানে নতুন কোচ কার্লো আনচেলত্তির হাত ধরে সোনালি ট্রফি জয় ছাড়া আর কিছুই ভাবছে না ব্রাজিল।

×