
বাবর আজমকে
পাকিস্তান ক্রিকেটে প্রতিভার অভাব কখনোই হয়নি। তাই তো ব্যাট-বলের দুনিয়ায় একের পর এক কিংবদন্তি পেয়েছে দেশটি। গত কয়েক মৌসুম কথা হচ্ছে বাবর আজমকে নিয়ে। অনেকেই তাকে বিরাট কোহলি, স্টিভেন স্মিথ, কেন উইলিয়ামসন, জো রুটদের সঙ্গে তুলনা করছেন। ক্রিকেটপাগল পাকিদের কাছে তিনি ভবিষ্যতের কিংবদন্তি। ভবিষ্যতের উত্তর ভবিষ্যতেই মিলবে। তবে সময়টা যে বাবরের তাতে সন্দেহ নেই। ২০১৫ সালে ওয়ানডে দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পা রাখা ২৮ বছর বয়সী ক্রিকেটার সাত বছরের ক্যারিয়ারে ইতোমধ্যে অনেক রেকর্ড নাড়িয়ে দিয়েছেন।
পাকিস্তানের পক্ষে কম সময়ে (নির্দিষ্ট) বেশি রান, বেশি সেঞ্চুরি, বেশি হাফ সেঞ্চুরি, পার্টনারশিপ, র্যাঙ্কিং পয়েন্ট আরও কত কী। রাজনৈতিক অস্থিরতার মতো ক্রিকেটেও চরম আনপ্রেডিক্টেবল একটা দেশের হয়ে এই বয়সে অধিনায়ক হিসেবে কেমন করেন, কয়েক বছরে সন্দেহের সেই প্রশ্নও উড়িয়ে দিয়েছেন। লিডিং ফ্রম দ্য ফ্রন্টÑ ব্যাট হাতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সুপার বাবর। তিন সংস্করণেই সমানে দ্যুতি ছড়িয়ে জিতে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সম্মান ২০২২ আইসিসির বর্ষসেরা পুরস্কার। পাশাপাশি টানা দ্বিতীয়বার হয়েছেন ওয়ানডের বর্ষসেরা।
সীমিত ওভারের ক্রিকেটে বরাবরই দারুণ ধারাবাহিক ব্যাটসম্যান বাবর আজম। গত বছর টেস্টেও খেলেন তিনি দুর্দান্ত, নিজেকে তুলে নেন নতুন উচ্চতায়। তিন সংস্করণেই আলো ছড়ানোর পুরস্কার হিসেবে আইসিসির বর্ষসেরা পুরুষ ক্রিকেটার নির্বাচিত হয়েছেন পাকিস্তান অধিনায়ক। জিতেছেন মর্যাদার ‘স্যার গ্যারফিল্ড সোবার্স ট্রফি’। দুইবার করে এই পুরস্কার জেতা রিকি পন্টিং, মিচেল জনসন, বিরাট কোহলির সঙ্গী হওয়ার হাতছানি ছিল ইংল্যান্ডের বেন স্টোকসের সামনে।
তাকেসহ জিম্বাবুইয়ের সিকান্দার রাজা ও নিউজিল্যান্ডের টিম সাউদিকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো স্বীকৃতিটি জিতে নেন সেশনাল বাবর। ব্যাট হাতে ও নেতৃত্বে বাবর আজমের ২০২২ সালটি ছিল এক কথায় অসাধারণ। সব মিলিয়ে ৪৪ ম্যাচ খেলে ৫৪.১২ গড়ে ৮টি সেঞ্চুরি ও ১৫টি ফিফটিতে ২৫৯৮ রান করেছেন পাকিস্তানের এই অধিনায়ক। টেস্ট, ওয়ানডে ও টি২০ মিলিয়ে পাকিস্তান গত বছর ম্যাচ খেলেছে ৪৪টি। বাবরের নেতৃত্বে এর মধ্যে ২৩টি ম্যাচ জিতেছে তারা। নিজের ও দলের এমন পারফরম্যান্সের পুরস্কারও পেয়েছেন বাবর। বেন স্টোকস, সিকান্দার রাজা, টিম সাউদিকে পেছনে ফেলে আইসিসির বর্ষসেরা ক্রিকেটারের পুরস্কার স্যার গারফিল্ড সোবার্স ট্রফি জিতেছেন তিনি।
গত বছর অল্প সময়ের জন্যেও ছন্দপতন হয়নি বাবরের। ব্যাট হাতে ব্যক্তিগত কিছু রেকর্ড গড়েছেন তিনি। সব সংস্করণ মিলিয়ে গত বছর একমাত্র বাবরই দুই হাজার রানের মাইলফলকে পৌঁছেছেন। আড়াই হাজারের ওপরে রান তোলার পথে তার আটটি সেঞ্চুরি ও ১৭টি ফিফটি এক বর্ষপঞ্জিতে নিজের সর্বোচ্চ।
ব্যাট হাতে গত বছর বাবর টেস্ট খেলেছেন ৯টি। ১৭ ইনিংসে ৬৯.৬৪ গড়ে রান করেছেন ১১৮৪। চারটি সেঞ্চুরির পাশাপাশি করেছেন সাতটি ফিফটি। এরপরও অবশ্য টেস্টের বর্ষসেরা হতে পারেননি বাবর। এর একটা কারণ হয়তো টেস্টে তার দলের অতটা সফলতা না পাওয়া। গত বছর ৯টি টেস্ট খেলে একটিই জিতেছে পাকিস্তান। পাঁচটি ম্যাচ হেরেছে আর ড্র করেছে একটি। ২০২২ সালে ওয়ানডেতে ৩টি সেঞ্চুরিসহ ৮৪.৮৭ গড়ে ৬৭৯ রান করেছেন বাবর।
দুর্দান্ত এই ব্যাটিংই বাবরকে টানা দ্বিতীয়বারের মতো আইসিসির বর্ষসেরা ওয়ানডে খেলোয়াড়ের পুরস্কার এনে দিয়েছে। ২০২২ সালে বাবর ওয়ানডেতে ৯টি ম্যাচ খেলেছেন। তিনটি সেঞ্চুরির পাশাপাশি ফিফটি পাঁচটি। একটি ম্যাচেই শুধু বলার মতো রান করতে পারেননি তিনি। মুলতানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেই ম্যাচে আউট হয়েছিলেন ১ রান করে। ২০২২ সালে ওয়ানডেতে পাকিস্তানও দুর্দান্ত ছন্দে ছিল। একটি মাত্র ম্যাচ হেরেছে তারা। লাহোরে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৮৮ রানে হেরে যাওয়া সেই ম্যাচে বাবর করেছিলেন ৫৭ রান।
বাবর আজম এখন হয়ে উঠেছেন যেন রেকর্ডের প্রতিশব্দ। তিনি ব্যাট হাতে নামা মানেই রানের জোয়ার। তার একেকটি ইনিংস মানেই নতুন কোনো অর্জন বা মাইলফলক। তবে স্টাইলিশ এই ব্যাটসম্যানের নিজের কাছে এসব রান আরও মূল্যবান হয়ে উঠবে যদি জিততে পারেন বৈশ্বিক শিরোপা। বিদায়ী বছরে এএফপিকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে পাকিস্তান অধিনায়ক বললেন, নিজের এমন ফর্মের প্রবাহেই দলের সর্বোচ্চ সাফল্যের স্বপ্ন দেখছেন তিনি‘কোনো সংশয় নেই, নিজের ফর্ম আমি উপভোগ করছি।
তবে এই ফর্ম নিয়ে আমার মূল লক্ষ্য হলো পাকিস্তানের হয়ে বিশ্বকাপ জয়। যদি তা পারি, তাহলে বলব যে আমার রানগুলো সত্যিই মূল্যবান।’ আগামী নভেম্বরে ভারতে ওয়ানডে বিশ্বকাপের আসর। বাবর বলেন, ‘ছেলেবেলা থেকেই তার স্বপ্ন নিজে বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যান হয়ে দলকে বিশ্বসেরা করে তোলা। স্কুলের দিনগুলোয় যখন আমি ক্রিকেট খেলতে শুরু“করি, তখন থেকেই আমার স্বপ্ন পাকিস্তানের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা এবং এমনভাবে বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান হওয়া, যেন তা আমার দেশকে সব শিরোপা জয়ে সহায়তা করে।’
নিজের পারফর্মেন্স দেখে খুশি বাবব আজম আগামী দিনেও এমন পারফর্মেন্স চালিয়ে জেতে চান। পাকিস্তানের অধিনায়ক বলেন, ‘সবসময় ক্রিকেটের দিকে মনোযোগ রাখার চেষ্টা করি। কঠোর পরিশ্রম করি এবং সব কিছুকে সহজভাবে নেওয়ার চেষ্টা করি। এর ফলে দায়িত্ব পালন সহজ হয়ে যায়। সব পরিস্থিতিতেই নিজেকে প্রস্তুত রাখি। অটল থাকার চেষ্টা করি। এগুলোই আমার মূলমন্ত্র।’ পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান নাজাম শেঠি বাবরের প্রশংসা করে বলেন, ‘চার বছর আগে আমার এক বন্ধু আমাকে বলেছিল এই ছেলেটিকে দেখে রেখ। ভবিষ্যতে সে খুব ভালো করবে। সেই ছেলেটি হলো বাবর আজম।’
৪৭ টেস্টে প্রায় ৪৯ গড়ে ৯ সেঞ্চুরি এত বাবরের রান ৩৬৯৬। আর ৯৫ ওয়াানডেতে প্রায় ৬০ গড়ে রান ৪৮১৩। সেঞ্চুরি ১৭টি। ৯৯ টি২০তে রান ৩৩৫৫। গড় ৪১। সেঞ্চুরি ২টি। সুপার বাবর নিজেকে কোথায় নিয়ে যান, সেটিই দেখার অপেক্ষা।