ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপে আলো ছাড়াচ্ছে জামালপুরের মেয়ে

নিজস্ব সংবাদদাতা, জামালপুর

প্রকাশিত: ২০:৪১, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপে আলো ছাড়াচ্ছে জামালপুরের মেয়ে

স্বর্ণা 

অনূর্ধ্ব-১৯ নারী বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের তিন ম্যাচে ঝকঝকে পারফরম্যান্সের নাম সাজিয়া আক্তার স্বর্ণা। তিন ম্যাচে ব্যাট হাতে উজ্জ্বল জামালপুরের এ নারী ক্রিকেটার। এ নারী ক্রিকেটারের ক্রিকেট জীবনের শুরুটা তার ভালো হয়নি। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় ক্রিকেট সরঞ্জাম কেনার ও উপায় ছিলনা। কিন্তু এ স্পিন অলরাউন্ডার জুয়েল নামের এক দুর-সম্পর্কের মামার সহযোগিতায় ক্রিকেটের সঙ্গে পথ চলা এগিয়ে নেন। এখন বিশ্ব মঞ্চে দেশের নাম উজ্জ্বল করে যাচ্ছেন তিনি। তাতে প্রশংসিত হচ্ছেন স্বর্ণার বাবা-মা সহপুরো জামালপুরবাসী। 

স্থানীয় ও স্বর্ণার পরিবার সুত্রে জানা যায়, স্বর্ণার ক্রিকেট জীবনের শুরুটা ছিল লড়াইয়ের। জামালপুর পৌর শহরের কাচারীপাড়া এলাকার দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম। বাবা বাদল হোসেন ও মা সনেখা বেগমের চার সন্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ সাজিয়া আক্তার স্বর্ণা। স্বর্ণার বাবা বাদল হোসেন পৌর শহরের দয়াময়ী মোড়ে একটি সেলুনে নাপিতের কাজ করতেন। সে মাদারগঞ্জ পৌর শহরে একটি সেলুনের দোকানে কাজ করেন । সেখানে দ্বিতীয় বিয়ে করে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সংসার পেতেছেন। 

এ অবস্থায় পরিবারের হাল ধরেন মা সখেনা বেগম। অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতেন স্বর্ণার মা। এক বেলা খেয়ে আরেক বেলা না খেয়ে চলত স্বর্ণাদের জীবন। বড় ভাই সজিব পরিবারে অভাব অনটনের কারনে পড়া লেখা করতে পারেনি। পরে তিনি ফ্রিজ ও এসি মেরামতের শিখে এটাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। স্বর্ণার বড় সোহেনা বেগম পরিবারের অভাবের কারনে পড়া লেখা করতে পারেনি। মাত্র ১৫ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায় সোহেনার। স্বর্ণার আরেক ভাই লেখাপাড়া করে না। কোন কাজকর্ম ও নেই তার। কিছুদিন আগে স্বর্ণার মা অন্যের বাসায় ঝিয়ের কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। 

তিনি এখন বাসায় বসে হস্তশিল্পের কাজ করে সংসার চালান। স্বর্ণা স্থানীয় সিংহজানী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণিতে পড়েন। ছোট বেলা থেকে ক্রিকেট পাগল স্বর্ণা কাঠের টুকরা দিয়ে ব্যাট বানিয়ে ক্রিকেট খেলতেন। পরিবারের কেউ ক্রিকেটার না হলেও ছোট বেলা থেকেই ক্রিকেটে মিশে ছিলেন তিনি। পড়া লেখাতেও বেশ মনোযোগী তিনি। স্বর্ণার খেলায় শুধু পরিবারই নয়, প্রতিবেশীরা ও গর্বিত স্বর্ণার মতো বাঘিনীর পারফরম্যান্সে। স্বর্ণা দেশের সুনাম কুড়িয়ে আনছে। 

সরকার যেন দরিদ্র স্বর্ণার পরিবারের দিকে সুনজর দেন, এমন প্রত্যাশা স্থানীয় ও স্বজনদের। নারী ক্রিকেটার স্বর্ণার মা মেয়ের ক্রিকেট জীবন সম্পর্কে বলেন, ছোট থেকেই স্বর্ণার ক্রিকেটের প্রতি খুবই আগ্রহ ছিল।  নারিকেলের ডাগিয়া (পাতা ছাড়া ডালের অংশ) দিয়ে ব্যাট বানিয়ে ক্রিকেট খেলত। কিংবা ছোট কাঠের টুকরা পাইলে সেই টুকরা দিয়ে ব্যাট বানিয়ে খেলত। ওর ভাই সজীব হোসেন কে বল এনে দিতে বলতেন। এমন করেই তার খেলা শুরু। স্কুল ছুটির পরেই মাঠে নেমে পড়তো। বাড়ি সাথে মাঠ হওয়ায় সারাদিন মাঠেই খেলতো। এ নিয়ে পাড়া-প্রতিবেশীরা নানা কথা শুনাতো। 

প্রতিবেশীদের কথার কারনে স্বর্ণার বড় বোন মাঝে মধ্যে ওকে মারধর করতো। তবুও সে খেলা ছাড়েনি। অনেক কষ্ট করে সে ক্রিকেট খেলা শিখেছে। তবে তার খেলার প্রতি আগ্রহ দেখে ওর এক দুর-সম্পর্কের মামা (আমার ফুফাতো ভাই ) খেলার বিষয়ে সহযোগীতা করতো। তাঁর সহযোগীতায় স্বর্ণা বিভিন্ন বয়স ভিত্তিক খেলায় অংশ গ্রহন করতেন। অনেক সময় বয়স ভিত্তিক খেলায় স্বর্ণার শারীরিক গঠন দেখে নিতে চাইতো না। তখন ওর মামার (আমার ভাইয়ের) সহযোগিতায় ও অনুরোধে খেলার সুযোগ পেতেন। এভাবেই তিনি ক্রিকেট খেলায় এগিয়ে যায়। স্বর্ণার ভাই সজীব বোনের ব্যাটে রান দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন, আমি অনেক খুশি। আমি চাই আমাদের স্বর্ণা সব সময়ই ভালো করুক এবং বাংলাদেশ দল চ্যাম্পিয়ন হোক। স্বর্ণা কে ঘিরে অনেক স্বপ্ন আমাদের পরিবারের। ভবিষ্যতে বোন কে জাতীয় দলে দেখতে মুখিয়ে ছিলেন ভাই সজীব। তাদের স্বপ্ন সার্থক হয়েছে। নিজেদের স্বপ্নের কথা শোনালেন সজীব, স্বর্ণা বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পেয়েছে, এটা আমাদের চাও ছিলো। 

স্বর্ণার চাচা রফিক মিয়া জানান, অভাব-অনটনের সংসারে স্বর্ণারা কখনো ঠিক মতো খেতে পারেনি। যখন থেকে স্বর্ণা জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে ভালো খেলতে শুরু করেছে, তারপর থেকে ওর আয়ের টাকা-পয়সা দিয়ে বাসা ভাড়া পরিশোধ করেছে তার পরিবার। নিজেরাও ভালো মন্দ কিছু খাচ্ছে। স্বর্ণার চাচা, প্রতিবেশী ও স্বজনদের প্রত্যাশা, সরকার যেন দরিদ্র স্বর্ণার পরিবারের দিকে সুদৃষ্টি দেন। স্বর্ণার বাবা বাদল হোসেন বলেন, মেয়েকে কোন দিনও কোন খেলার জিনিস কিনে দিতে পারি নাই। যা সামান্য উপার্জন ছিল তাদিয়ে কোন রকমে সংসার চলত। মেয়েকে ঘিরে তারও স্বপ্নটা অনেক বড়। তিনি আরও বলেন, স্বর্ণা একদিন দেশের সুনাম বয়ে আনবে। সে খুব ভালো খেলবে।

এমএস

সম্পর্কিত বিষয়:

×