ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

অভিমানে অবসরে আনুচিং

রুমেল খান

প্রকাশিত: ০০:০৮, ২৫ জানুয়ারি ২০২৩

অভিমানে অবসরে আনুচিং

ট্রফি হাতে নারী ফুটবল লিগ চ্যাম্পিয়ন বসুন্ধরার আনুচিং মগিনি

দলীয় খেলার নিয়মই হচ্ছে- যতক্ষণ ফর্ম ও ফিটনেস আছে, ততক্ষণই সেই খেলোয়াড় দলের জন্য অপরিহার্য। তবে দলের স্বার্থে কখনো কখনো তাকে সুযোগ দেয়া হয় বা দলে রাখা হয়, যেন সে ফর্ম ফিরে পায়। তারপরেও যদি সেই খেলোয়াড় স্বীয় নৈপুণ্যে সমুজ্জ্বল হতে না পারে কিংবা দলের সাফল্যে কোন অবদান রাখতে না পারেন, তাহলে সেই খেলোয়াড় দলের জন্য বোঝা বা অপাংক্তেয় হয়ে পড়ে। ফলে তাকে দল থেকে বাদ পড়তে হয় তাকে। তার পরিবর্তে ইনফর্ম বা সম্ভাবনাময় কোন খেলোয়াড়কে সুযোগ দেয়া হয়। 
জাতীয় ফুটবল দলের ক্ষেত্রেও এই নিয়ম প্রযোজ্য। যুগে যুগে বিশ্বের অনেক নামকরা-সেরা ফুটবলারই ফর্ম বা ফিটনেসের কারণে দল থেকে বাদ পড়েছেন। পড়ছেন এখনো। যারা বাদ পড়েন, তাদের বেশিরভাগই এটাকে স্বাভাবিকভাবেই নেন এবং ঘরোয়া ফুটবলে ভালো পারফর্ম করে আবারও দৃষ্টি আকর্ষণ করে দলে ফিরে আসেন। তবে গুটিকয়েক ফুটবলার নিজেদের বাদ পড়াকে মেনে নিতে পারেন না। তখনই ঘটে বিপত্তি। কোচের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন। সংবাদমাধ্যমে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের ক্ষোভ উগড়ে দেন। 
এই যেমন আনুচিং মগিনির কথাই ধরা যাক। বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলে এই পাহাড়িকন্যা দাপটের সঙ্গে খেলেছেন অর্ধযুগ। বিভিন্ন বয়সভিত্তিক ও সিনিয়র দল যতগুলো শিরোপা জিতেছে, তার প্রায় সবটিতেই আনুচিং ছিলেন দলের সঙ্গে। গত বছর নেপালে অনুষ্ঠিত সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ঐতিহাসিক শিরোপা জেতে, সেই দলের গর্বিত সদস্যা ছিলেন ২০ বছর বয়সী ফরোয়ার্ড আনুচিং। সেই আনুচিং এবার বাদ পড়েছেন জাতীয় দলের ক্যাম্প থেকে। শৃঙ্খলাজনিত কারণে নয়, অফ ফর্মের কারণে। তার মতো বাদ পড়েছেন আরেক ফরোয়ার্ড সাজেদা খাতুন। এর ফলে সিনিয়র দলের সামনে যে অলিম্পিক বাছাইপর্বের খেলা রয়েছে (ইতোমধ্যেই এ উপলক্ষে অনুশীলন শুরু হয়ে গেছে), তাতে আর অংশগ্রহণ করতে পারবেন না আনুচিং-সাজেদা। উল্লেখ্য, কয়েক মিনিটের ছোট-বড় জমজ বোন আনাই মগিনি ঠিকই টিকে আছেন জাতীয় দলের ক্যাম্পে।   
দল থেকে বাদ পড়ার পর ময়মনসিংহের মেয়ে ১৯ বছর বয়সী সাজেদা কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি। তবে ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন খাগড়াছড়িরর মেয়ে আনুচিং। ইতোমধ্যেই বাফুফে ভবনে অবস্থিত নারী দলের ক্যাম্প থেকে নিজের ব্যাগ অ্যান্ড ব্যাগেজ নিয়ে নিজের জেলায় ফিরে গিয়ে ফেসবুক ওয়ালে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। লিখেছেন, ‘আজকের পর থেকে ফুটবলকে বিদায়।’
তার এই ঘোষণায় স্বভাবতই বিস্মিত হয় দেশের ফুটবলপ্রেমীরা। চলতে থাকে নানা জল্পনা-কল্পনা।

সবারই প্রশ্ন, কেন এমন ঘোষণা দিলেন আনুচিং? পরে জানা যায় জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েছেন তিনি। সেক্ষেত্রে অনেকেই ধারণা করেন, আনুচিং হয়তো আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নিয়েছেন, চালিয়ে যাবেন ঘরোয়া ফুটবলে খেলা। তবে আনুচিং পরে জানান, সব ধরনের ফুটবল থেকেই তিনি অবসর নিয়েছেন। এটা জানার পর ফুটবলপ্রেমীরা আরও বেশি স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। সবারই প্রশ্নÑবয়স যেহেতু অনেক কম, সেহেতু আনুচিং কেন এমন আত্মঘাতী ও অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত নিলেন?
কেন আনুচিং-সাজেদাকে বাদ দিয়েছেন, সেটা পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা দিয়েছেন জাতীয় নারী ফুটবল দলের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন। এক্ষেত্রে তিনি এই দুজনের দীর্ঘমেয়াদি অফ ফর্মের কারণকেই চিহ্নিত করেছেন। 
অবশ্য বছর দেড়েক ধরেই আনুচিং-সাজেদার অফ ফর্ম চোখে পড়ছিল। ম্যাচের পর ম্যাচে সেভাবে ভালো খেলতে পারছিলেন না আনুচিং। পাচ্ছিলেন না গোল। ধীরে ধীরে প্রথম একাদশে খেলার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেন। ফলে ঠাঁই হয় সাইডবেঞ্চে। বদলি হিসেবেও তাদের দুজনকে একাধিক ম্যাচে খেলানো হয়। সেখানেও একই দশা। পরে দলে থাকলেও তাদের খুব একটা খেলাননি কোচ। সাফজয়ী দলে থাকলেও একটা ম্যাচও খেলেননি আনুচিং, আর সাজেদা তো দলেই ছিলেন না! তাছাড়া সাবিনা খাতুন, কৃষ্ণা রানী সরকার, সিরাত জাহান স্বপ্না, শামসুন্নাহার জুনিয়রদের ধারাবাহিক নৈপুণ্যের জন্য একাদশে সুযোগ পাওয়াটাও অনেক কঠিন ছিল তাদের জন্য। 
আনুচিং দল থেকে বাদ পড়ে জানিয়েছেন লিগ শেষে কিছুদিন জাতীয় দলের অনুশীলন করেছেন। তারপর একদিন তাকে ডেকে বাদ দেয়ার কথা জানানো হয়। কিন্তু কেন বাদ দেয়া হলো, তা নাকি পরিষ্কার করে জানানো হয়নি। 
তার কোন জায়গায় সমস্যা, সেটা জানতে পারলে ভুল শোধরাতে পারতেন। কিন্তু সেই সুযোগ আর পাননি। এখন দলে ফেরাও কঠিন। কেননা লিগ শেষ। ঘরোয়া কোন টুর্নামেন্টও নেই। কাজেই কোথায় নিজের পারফরম্যান্স দেখাবেন? কাজেই সবকিছু ভেবেই অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে ঘরোয়া ফুটবলে অবশ্য শর্তস্বাপেক্ষ খেলা চালিয়ে যাওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আনুচিং। বাংলাদেশ দলে থাকলে দাম আছে, না থাকলে নেই। ফেরার সুযোগ সেভাবে না থাকায় সিদ্ধান্ত নিয়েছি অবসরের। ভালো ক্লাব না পেলে ঘরোয়া ফুটবলেও আর খেলব না।’
কোচ ছোটন অবশ্য জানিয়েছেন, ‘নিকট অতীতে আনুচিং-সাজেদার তেমন অগ্রগতি নেই। বিপরীতে নতুনরা ভালো করছে। এই কারণেই তাদের বাদ দেয়া হয়েছে। বাদ দিলেও এখানেই শেষ নয়, ভবিষ্যতে তারা ঘরোয়া ফুটবলে ভালো করলে অবশ্যই ফেরার সুযোগ পাবে।’
তবে বাস্তবতা বলছে, আনুচিংয়ের ফেরার পথটা অনেক কঠিন। কেননা সর্বশেষ নারী লিগে সর্বোচ্চ গোল করা আকলিমা খাতুন জাতীয় দলে ডাক পাবার অপেক্ষায়। এছাড়া আছেন ২০২১ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৯ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের সর্বোচ্চ গোলদাতা ও সেরা খেলোয়াড় হওয়া শাহেদা আক্তার রিপাও। এদিকে বাংলাদেশ দলে প্রথমবারের মতো ডাক পেয়েছেন জাপানি বংশোদ্ভূত ফুটবলার মাতসুশিমা সুমাইয়া। 
আগামী ৩-১১ এপ্রিল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হবে অলিম্পিক বাছাইপর্ব। বাংলাদেশের গ্রুপে রয়েছে- ইরান, মিয়ানমার ও মালদ্বীপ। এখনো ঠিক হয়নি বাছাইপর্বের ভেন্যু । 
এখন দেখার বিষয়, শেষ পর্যন্ত আনুচিংয়ের ফুটবল ক্যারিয়ার কোন পথে গড়ায়।

×