ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ইংল্যান্ডের সাফল্যের নেপথ্যে

শাকিল আহমেদ মিরাজ

প্রকাশিত: ০০:৩১, ১৬ নভেম্বর ২০২২

ইংল্যান্ডের সাফল্যের নেপথ্যে

ফাইনালের নায়ক বেন স্টোকস

করোনার ধাক্কায় এলোমেলো শিডিউলি মেলাতে এক বছরেরও কম সময়ে দুটি টি২০ বিশ্বকাপ আয়োজন করে আইসিসি। ফলে অস্ট্রেলিয়া আসরের জনপ্রিয়তা ও সাফল্য নিয়ে ছিল বড় প্রশ্ন। অথচ ছোট্ট ফরম্যাটের ক্রিকেটে স্মরণকালের আকর্ষণীয় এক বিশ্বকাপ দেখল বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন। বৃষ্টির বাগড়া, অঘটন, চরম নাটকীয়তা, কী ছিল না তাতে। শুরুটাই হয়েছিল পুঁচকে নামিবিয়ার কাছে শ্রীলঙ্কার হার দিয়ে। অতঃপর প্রথম পর্ব থেকে দুইবারের চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিদায়। সুপার টুয়েলভ ছিল আরও আকর্ষণীয়।

জিম্বাবুইয়ের কাছে হারের পর খাঁদের কিনারা থেকে পাকিস্তানের ঘুরে দাঁড়ানো। হল্যান্ডের কাছে দক্ষিণ আফ্রিকার হারে জীবন পাওয়া বাবর আজমদের সেরা চারে উঠে আসা। সেখানে ফেবারিট নিউজিল্যান্ডকে উড়িয়ে ফাইনাল। আরেক সেমিতে মোড়ল ভারতের অহমিকা ধুলোয় মিশিয়ে শিরোপার মঞ্চে ইংলিশরা। অথচ আইরিশদের কাছে হারে তাদেরও সেরা চারের টিকিট পাওয়া নিয়ে তৈরি হয়েছিল সংশয়। ঐতিহাসিক মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাইন্ড। সেই একই মঞ্চ, একই প্রতিপক্ষ।

হোক না টি২০, ১৯৯২ সালে ইমরান খানের ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয়ের পুনরাবৃত্তি করতে চাইছিলেন বাবর আজম। কিন্তু পারেননি। ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ পাকিদের ৫ উইকেটে হারিয়ে অনন্য ডাবল অর্জন করল জস বাটলারের ইংল্যান্ড। ৩ শিকারে নায়ক স্যাম কুরান ১৩ উইকেট নিয়ে হয়েছেন টুর্নামেন্টসেরা। আর অপরাজিত ৫২ রানের দারুণ ইনিংসে ওয়ানডের পর টি২০’র শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চটাকেও স্মরণীয় করে রাখেন ‘ম্যান ইন ফাইনাল’ বেন স্টোকস। একদিকে ইনফর্ম বাটলার, এ্যালেক্স হেলস, ক্রেজি স্টোকস, তুখোড় মঈন অন্যদিকে শাহিন শাহ আফ্রিদি, নাসিম শাহ, হারিস রউফ, মোহাম্মদ ওয়াসিম।

মেলবোর্নের ফাইনালটাকে দেখা হচ্ছিল ইংলিশ ব্যাটিং বনাম পাকিস্তানের পেস বোলিংয়ের দ্বৈরথ হিসেবে। অথচ প্রতিপক্ষকে মাত্র ১৩৭ রানে বেঁধে রেখে দৃশ্যপট বদলে দিলেন স্যাম কুরান। টুর্নামেন্টজুড়ে দারুণ পারফর্ম করা ২৪ বছর বয়সী বাঁহাতি পেস- বোলিং অলরাউন্ডার ফাইনালেও ছিলেন অনন্য-অসাধারণ। ৪-০-১২-৩, কুরানের এই বোলিং টি২০ বিশ্বকাপের ইতিহাসে ফাইনালের তৃতীয় সেরা বোলিং ফিগার। ২০১২ বিশ্বকাপে ১২ রান খরচায় ৪ উইকেট পেয়েছিলেন শ্রীলঙ্কান স্পিনার অজন্তা মেন্ডিস।

একই ম্যাচে ৯ রান দিয়ে ৩ উইকেট নেন সুনীল নারিন। এবারের আসরে ৬ ইনিংসে ১১.৩৮ গড়ে কুরানের শিকার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৩ উইকেট। ৮ ম্যাচে ১৫ উইকেট নিয়ে শীর্ষে শ্রীলঙ্কার ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গা। ইনিংসের পঞ্চম ওভারে বল হাতে পেয়ে নিজের দ্বিতীয় ডেলিভারিতেই ওপেনার মোহাম্মদ রিজওয়ানকে (১৪ বলে ১৫) বোল্ড করেন কুরান। ১৭তম ওভারের তৃতীয় বলে শান মাসুদকে (২৮ বলে ৩৮) লিয়াম লিভিংস্টোনের হাতে ক্যাচ বানিয়ে পাকিস্তানর বড় রানের আশা কার্যত শেষ করে দেন।

১৯তম ওভারের তৃতীয় বলেও সেই একই চিত্র, এবার তার শিকার ৫ রান করা নওয়াজ। টি২০ বিশ্বকাপের ইতিহাসে ইংল্যান্ডের হয়ে সর্বোচ্চ ১৩ উইকেট শিকারের রেকর্ড কুরানের। এর আগে ২০১০ বিশ্বকাপে রায়ান সাইডবটম ও গ্রায়েম সোয়ন এবং ২০১৬ সালে ডেভিড উইলি নিয়েছিলেন ১০ উইকেট। ১৩৮ রানের সহজ লক্ষ্যটাও কিন্তু ইংলিশদের জন্য কঠিন হয়ে উঠেছিল। নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছিল আস্কিং রান রেটের চাপ।

একপ্রান্তে স্বরুপে খেলে যাচ্ছিলেন ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপে জয়ের নায়ক বেন স্টোকস। শেষ পর্যন্ত অপরাজিত ৫২ রান করে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়েন ক্রেজি এ অলরাউন্ডার। টি২০ ক্যারিয়ারে এটিই তার প্রথম হাফসেঞ্চুরি। তাও আবার এমন মঞ্চে। ঠিক যেভাবে ২০১৯ বিশ্বকাপে ফাইনালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে করেছিলেন অপরাজিত ৮৪ রান। ফলে টাই ম্যাচের খেলা গড়িয়েছিল সুপার ওভারে। সেটিও টাই হলে বাউন্ডারি সংখ্যায় প্রথমবার বিশ্বকাপ জিতেছিল ইংল্যান্ড।

‘এমন পরিস্থিতিতে ও (স্টোকস) থাকলেই ধরে নেওয়া যায়, আমাদের দারুণ সম্ভাবনা আছে। ও সত্যিকার ম্যাচ উইনার।  সে ইংলিশ ক্রিকেটের অন্যতম কিংবদন্তি।’ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলছিলেন অধিনায়ক বাটলার। ফাইনালে ম্যাচসেরার পুরস্কার পাওয়া কুরান বলেন, ‘এটা আমার প্রাপ্য নয়। স্টোকসের পাওয়া উচিত ছিল। সে এমন একটা ইনিংস খেলল। এর আগেও কত বার আমাদের এমন ম্যাচ জিতিয়েছে।’
বার বার বড় ম্যাচ জেতানোর এই প্রেরণা স্টোকস কোথা থেকে পান? ‘ফাইনালের মতো মঞ্চে রান তাড়া করতে হলে পুরনো সব কথা ভুলে যেতে হয়। অল্প রানে পাকিস্তানকে আটকে রাখার পিছনে বোলারদের কৃতিত্ব দিতেই হবে।’ জীবনে ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া কথা জানিয়ে স্টোকস বলেন, ‘শুরুতে আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে হারের ধাক্কা ছিল, কিন্তু সেটা মনে রেখে এগিয়ে যাওয়া যেত না। সেরা দল সব সময় ঘুষি খেয়ে ফিরে আসে।

পরের পরীক্ষার জন্য তৈরি হয়। এটা দারুণ একটা সন্ধ্যা ছিল।’  ইংল্যান্ডের জার্সিতে স্টোকসের বার বার ‘বিগ বেন’ হয়ে ওঠার পিছনে অবশ্যই রয়েছে ঘুষি মেরে ফিরে আসার কাহিনী। যে ঘটনা জীবনটাই বদলে দিয়েছে স্টোকসের। সাল ২০১৭। রেস্তোরাঁর বাইরে মারপিট করে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন স্টোকস। সেই ঘটনায় সংবাদমাধ্যমে নিন্দার ঝড় উঠেছিল। কেউ লিখেছিলেন, ‘তাকে ক্রিকেট থেকে নির্বাসিত করা উচিত।’ অন্ধকার সময় গ্রাস করেছিল ক্রিকেটারকে। মানসিকভাবে  ভেঙে পড়েছিল পরিবার। ২০১৮ সালে ইংল্যান্ডের আদালত জানায় স্টোকস নির্দোষ। সেখান থেকে ফিরে এসে ইংল্যান্ড ক্রিকেটের মুকুট পরেছেন। সত্যিই ছাই থেকে উঠে আসা আগুন পাখি।
২০০৭ সালে প্রথম টি২০ বিশ্বকাপের ফাইনালে পাকিস্তানকে হারিয়ে শিরোপা জেতে ভারত। ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় পাকিস্তান। উইন্ডিজে ২০১০ সালের তৃতীয় আসরের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে হারায় ইংলিশরা। দুই দলের জন্যই এটি ছিল তৃতীয় ফাইনাল।

ইংল্যান্ড ছাড়া দুবার টি২০ বিশ্বকাপ জিতেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ (২০১২ ও ২০১৬ সালে)। বিশ্বকাপ জয়ের পর আরেকটি ওয়ানডে বিশ্বকাপ আসার আগেই টি২০ বিশ্বকাপ জেতা একমাত্র দল এখন ইংল্যান্ড। একইসঙ্গে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পর টি২০ ইতিহাসের মাত্র দ্বিতীয় দল হিসেবে দুটি বিশ্বকাপ শিরোপা জিতল ইংল্যান্ড। ২০১৯Ñএ ইংলিশদের প্রথম ওয়ানডে বিশ্বকাপের স্বপ্নপূরণ করে নায়ক বনে গিয়েছিলোন ইয়ন মরগান। তার হাতেই ছিল টি২০’র ব্যাটন। কিন্তু গত জুনে হঠাৎই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেন তিনি।

রঙিন পোশাকে দায়িত্ব পাওয়ার বছরেই রাঙিয়ে দিলেন জস বাটলার। স্বভাবতই গর্বের শেষ নেই বাটলারের। ‘ইংল্যান্ডের হয়ে টি২০ বিশ্বকাপের শিরোপা জিততে পেরে দলের সবাই গর্বিত। গত কয়েক বছর ধরে আমরা যে দীর্ঘ যাত্রা এবং কিছু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম, তার ফল এটি। এটি ছিল চমৎকার একটি টুর্নামেন্ট। অস্ট্রেলিয়ায় আসার আগে আমরা পাকিস্তানে গিয়েছিলাম, বিশ্বকাপের আগে সেটি ছিল অত্যন্ত মূল্যবান একটি সিরিজ।

বিশ্বকাপে আয়ারল্যান্ড ম্যাচের পর থেকে আমরা যে ক্রিকেটীয় চরিত্র দেখিয়েছি, তা আশ্চর্যজনক। কোচিং স্টাফে কয়েকজন অস্ট্রেলিয়ানকে পেয়েছিলাম, যাঁরা দুর্দান্ত কাজ করেছেন।’ বলেন তিনি। আয়ারল্যান্ডের কাছে অপ্রত্যাশিত হারের পর অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ম্যাচটা বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত হলে শঙ্কায় পড়েছিল ইংলিশদের সেমির ভাগ্য। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ডু অর ডাই শেষ ম্যাচ জিতে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে রান রেটে এগিয়ে থেকে শেষ চারে উঠে আসে ইংল্যান্ড।

আর সেমিতে ১৬৮ রান টপকে ১০ উইকেটের রেকর্ড গড়া জয়ের পথে মোড়ল ভারতের অহমিকা ধুলোয় মিশিয়ে দেন দুই পেনার বাটলার ও হেলস। এই অস্ট্রেলিয়াতেই ২০১৫ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কাছে হেরে গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পড়া ইংল্যান্ড বদলে যায় পরের আসরেই। ঘরের মাঠে জেতে ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপ। এবার টি২০ জিতে হলো ‘অনন্য ডাবল’। রঙিন পোষাকে ইংলিশরাই সময়ের সেরা বলে মনে করেন হার্ষা ভোগলে, ‘মরগান যে বিবর্তন নিয়ে এসেছিল তা এখনো শক্তভাবে বেঁচে আছে। ক্রিকেট বিশ্বে সাদা বলে সবার সেরা দল ইংল্যান্ড।

একসঙ্গে দুই সংস্করণের বিশ্বকাপ  জেতা অসাধারণ সাফল্য।’ সাবেক ইংল্যান্ড অধিনায়ক মাইকেল ভনও তার সঙ্গে একমত, ‘সাদা বলের ক্রিকেটে বিশ্বের সেরা দল ইংল্যান্ড। দুর্দান্ত সব খেলোয়াড় রয়েছে। রঙিন পোশাকে এখন দুটি শিরোপা তাদের হাতে। এটি পুরোপুরি প্রাপ্য। বেন স্টোকস এমন এক ক্রিকেটার যে জানে কিভাবে বড় মুহূর্ত জিততে হয়। সেরা দল হতে দলগুলোর সেরা খেলোয়াড় প্রয়োজন হয়, আর ইংল্যান্ডের এমন অনেক সেরা খেলোয়াড় আছে।’ মুগ্ধ গ্রেট শচীন টেন্ডুলকর,‘টি২০ বিশ্বকাপে দ্বিতীয় শিরোপা জেতায় ইংল্যান্ডকে অভিনন্দন। অসাধারণ অর্জন। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ফাইনাল ছিল। কী রোলার কোস্টার যাত্রার এক বিশ্বকাপ!’

×