ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

দক্ষিণ এশিয়ার সেরা প্রীতির এগিয়ে যাওয়ার গল্প

শেখ আব্দুল আওয়াল, গফরগাঁও

প্রকাশিত: ০০:২৯, ৩ এপ্রিল ২০২৪

দক্ষিণ এশিয়ার সেরা প্রীতির এগিয়ে যাওয়ার গল্প

ময়মনসিংহের নান্দাইলে গ্রামের বাড়িতে বাবা-মা ও বোনদের সঙ্গে সৌরভী আকন্দ প্রীতি

সে তখন তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। খুব সকালে ঘুম ভাঙে তার। সকালে ও বিকেলে দুই বেলা মাঠে যায়। কখনো হেঁটে আবার কখনো সাইকেলে চেপে। গায়ে  তার খেলার জার্সি। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষাÑ কোনো বিরাম নেই। ফুটবল মাঠে বারো মাসই চলে তার পরিশ্রম আর কঠোর অনুশীলন। ফুটবলই যেন হয়ে ওঠে তার পায়ের নূপুর। 
ফুটবল ঘিরে দু’চোখভরা স্বপ্ন, অথচ ঘরে নেই পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার। অভাব ক্রীড়া সাজ-সরঞ্জামের। আর আছে এর মাঝে চারপাশের অবহেলা, সমাজের কিছু মানুষের চোখ রাঙানি।  সবকিছু উপেক্ষা করেই তার এগিয়ে চলা।
তার দু’চোখে স্বপ্ন দেশসেরা ফুটবলার হওয়া। লাল-সবুজের পতাকাকে ফুটবল বিশ্বে জানান দেওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে ছুটে চলেছে। ফুটবলের মাঠে ঘাম ঝরিয়ে তিল তিল করে নিজেকে গড়ে তুলছে প্রীতি। এরই মধ্যে সাফল্য কুড়িয়ে এনেছে দেশে-বিদেশে নারী ফুটবলের নানা আসর থেকে। 
এ গল্প ময়মনসিংহ সদর থেকে ৬২ কিলোমিটার দূরের নান্দাইল উপজেলার অজপাড়াগাঁ জাহাঙ্গীরপুর ইউনিয়নের বারঘরিয়া গ্রামের আবুল কালাম আজাদের কন্যা সম্প্রতি সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ জয়ী ফুটবলকন্যা সৌরভী আকন্দ প্রীতিকে নিয়ে। ময়মনসিংহের বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক উদ্দিন ভুঁইয়া স্টেডিয়ামে অনুশীলন করেছে প্রীতি, যে এখন নারী ফুটবলার তৈরির আঁতুরঘর। নারী ফুটবলারদের জন্য আলাদা স্টেডিয়াম ময়মনসিংহে নেই। মাঝেমধ্যে বড় কোনো ম্যাচের আগে ওই স্টেডিয়ামে অনুশীলন করত সে।

নান্দাইল সদরসহ কয়েকটি মাঠে অনুশীলনের মধ্য দিয়েই খুদে নারী ফুটবলার হিসেবে গড়ে উঠেছে প্রীতি। সেই প্রীতি এখন দেশ-বিদেশ থেকে সাফল্য বয়ে নিয়ে আসছে দেশের জন্য। তৃণমূল পর্যায় থেকে নারী ফুটবলার তৈরিতে শুরু হয় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট। ২০১৮ সালে পাঁচরুখি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় দলের হয়ে এই আসরে অংশ নেয় প্রীতি। গাঁয়ের মেয়েদের এভাবে ফুটবল খেলতে নেমে যাওয়া ভালো চোখে দেখেনি অনেকে।

ফলে শুরু হয় নানা সমালোচনা। তবে ব্যাপারটা ভালোভাবেই সামলে নেন পাঁচরুখি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষক। তিনি সবাইকে বোঝাতে সক্ষম হন মেয়েদের ফুটবল খেলার প্রয়োজনীয়তা। এরপর স্কুলের মেয়েরা স্বাচ্ছন্দ্যে অনুশীলনসহ টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়। ওই বছর জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয় পাঁচরুখি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ফলে সারাদেশে নাম ছড়িয়ে পড়ে ময়মনসিংহের পাঁচরুখি মেয়েদের। 
কৃতী ফুটবলার কে এই প্রীতি ॥ নান্দাইল উপজেলার জাহাঙ্গীরপুর ইউনিয়নের বারঘরিয়া গ্রামের কৃষক মো. আবুল কালাম আকন্দের মেয়ে সৌরভী আকন্দ প্রীতি। উত্তর জাহাঙ্গীরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে সে। ওই বিদ্যালয়ের হয়ে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছিল, কিন্তু বিদ্যালয়টি ওই টুর্নামেন্টে ভালো করতে পারেনি।

তবে প্রীতির খেলা অনেকের নজর কাড়ে। পরে তাকে পাশের নান্দাইলের পাঁচরুখি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়। ওই বিদ্যালয় বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টে উপজেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। পরে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে প্রথম স্থান অধিকার করে। প্রীতি প্রতিটি আসরে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার লাভ করে। পরে জাতীয় পর্যায়ে রংপুর বিভাগকে হারিয়ে পাঁচরুখি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল দল বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়। সেই খেলায়ও গোল পায় প্রীতি। তার নৈপুণ্য নজরে পড়ে জাতীয় দলের কর্মকর্তাদের।

এরপর আর তাকে কে ঠেকায়? শুরু হয় সাফ অনূর্ধ্ব ১৫ নারী চ্যাম্পিয়নশিপ। বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানকে নিয়ে অনুষ্ঠিত অভিষেকে আসরেই বাজিমাত করে প্রীতি। ভুটানকে গোল বন্যায় ভাসিয়ে দেয় বাংলাদেশ। প্রথম খেলায় হ্যাটট্রিক এবং পরের খেলায় ডাবল হ্যাটট্রিকÑ মোট নয় গোল দিয়ে তাক লাগিয়ে দেয় প্রীতি। এরপর অনূর্ধ্ব ১৭ সাফ ফুটবল অংশ নিয়ে ১০টি গোল করে এই কৃতী ফরোয়ার্ড। এরপর চলে আসে অনূর্ধ্ব ১৯ সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ। 
চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি শক্তিশালী নেপালকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশের মেয়েরা। এই ম্যাচেও গোল করে প্রীতি। তার আগে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৭ উইমেন্স এশিয়ান কাপ-২০২৩ বাছাই পর্ব অনুষ্ঠিত হয় এপ্রিলে সিঙ্গাপুরে। সেখানে প্রথম খেলায় তুর্কমেনিস্তানের বিরুদ্ধে ৬-০ গোলে জয়লাভ করে বাংলাদেশ। পরের খেলায় স্বাগতিক সিঙ্গাপুরকে ৩-০ গোলে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন হয় প্রীতিরা।

এই খেলায় প্রীতির পা থেকে আসে দুই গোল। দেশে ফিরে প্রস্তুতি শুরু করে দ্বিতীয় পর্ব খেলার জন্য। প্রীতি বলেন, আমার পরিবার দরিদ্র, আমরা এক ভাই ও চার বোন। আয়-রোজগার করার মতো তেমন কেউ নাই। আমি ফুটবল খেলে যা পাই এবং নিজের অল্প জমিতে চাষাবাদ করে যা পাওয়া যায় তা দিয়েই চলে আমাদের সংসার। আমার বড় ভাই বেকার। এ অবস্থায় কষ্ট করেই লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছি। আশঙ্কা ছিল বোধহয় লেখাপড়া আর করতে পারব না।

ফুটবল খেলে যা উপার্জন করি তা দিয়েই বাবার সংসার এবং লেখাপড়া চলছে। আমার প্রত্যাশা একদিন বাংলাদেশ মূল জাতীয় দলে খেলার। অনেক বড় খেলোয়াড় হতে চাই। প্রীতির ভাই জীবন আকন্দ বলেন, আমাদের পরিবার অত্যন্ত অসহায়। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। ছোট বোন প্রীতিকে নিয়ে অনেক আশা, স্বপ্ন। সরকারপ্রধান তথা সংশ্লিষ্টদের কাছে আবেদন যেন আমাদের দিকে একটু সুদৃষ্টি দেন।

×