ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ইতিহাস গড়ে মরক্কানদের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস

রুমেল খান

প্রকাশিত: ০০:৩০, ৮ ডিসেম্বর ২০২২

ইতিহাস গড়ে মরক্কানদের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস

দলের জয়ে উল্লাস দুই মরক্কান দর্শকের

মরক্কোর আরবি নামের অর্থ ‘পশ্চিমের রাজ্য’। মরক্কো নামটি এসেছে দেশটির পূর্বের রাজধানী মারাক্কেশ হতে। আমাজিগ ভাষায় এর অর্থ হলো ‘স্রষ্টার দেশ’। তবে মঙ্গলবার রাতে কাতারের আল রাইয়ানের এডুকেশন সিটি স্টেডিয়ামে যা ঘটল, তাতে মরক্কো এখন নিঃসন্দেহেই বাধভাঙা আনন্দ-উচ্ছ্বাসের দেশ!
আর হবেই বা না কেন, ২২ নম্বর ফিফা র‌্যাঙ্কিংধারী এবং ‘দ্য এটলাস লায়ন্স’ খ্যাত মরক্কো যে চলমান কাতার বিশ্বকাপে নিজের ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে সেরা কীর্তিটি গড়ে ফেলেছে, গড়েছে অবিস্মরণীয় এক ইতিহাস। দ্বিতীয় রাউন্ডে তারা ২০১০ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন স্পেনকে টাইব্রেকারে ৩-০ (০-০) হারিয়ে নাম লিখিয়েছে শেষ আটে, অর্থাৎ কোয়ার্টার ফাইনালে।

এ নিয়ে ফিফা বিশ্বকাপের মূলপর্বে ষষ্ঠবারের মতো খেলছে আফ্রিকার দেশ মরক্কো। আগের পাঁচবার খেলে তাদের সেরা সাফল্য ছিল ১৯৮৬ আসরে দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলা। এরপর তিনবার (১৯৯৪, ১৯৯৮ ও ২০১৮) খেললেও প্রতিবারই প্রথম রাউন্ডের গ-ি পেরুতে পারেনি। মঙ্গলবার স্প্যানিশদের বিদায়ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়ে তিন যুগ আগের সাফল্যকে ছাপিয়ে যায় তারা। চতুর্থ আফ্রিকান দল হিসেবে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার কৃতিত্ব দেখাল তারা। এর আগের কীর্তিগুলো ক্যামেরুন (১৯৯০), সেনেগাল (২০০২) ও ঘানার (২০১০)।  
চিৎকার, গান, এবং কান্নার সঙ্গে, মরক্কানরা মঙ্গলবার আনন্দে বিস্ফোরিত হয়েছিল কারণ তাদের জাতীয় ফুটবল ফুটবল স্পেনবধ করে এক অবিস্মরণীয় রূপকথা রচনা করেছে। ‘মরক্কোর পেছনে লাখো ভক্ত-সমর্থক-অনুরাগীর সমর্থক ছিল। এই দলটি একটি চেতনা, একটি আফ্রিকান দেশের প্রতিনিধিত্ব করে।’ মরক্কোর উপকূলীয় শহর কাসাব্লাঙ্কার একটি কোলাহলপূর্ণ জনাকীর্ণ রেস্তরাঁয় বসে কথাগুলো বলেন মরক্কোন ভক্ত ইমাদ আইত ওনেজার।

‘এই জয়টি মরক্কো, আফ্রিকা, আরব বিশ্ব এবং সমস্ত দেশ যারা আমাদের বিশ্বাস করেছিল, তাদের সবার জন্য। আমরা মরক্কোর নাগরিক হতে পেরে গর্বিত।’ যোগ করেছেন এই যুবক, যিনি একজন প্রকল্প ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করেন। চলমান কাতার বিশ্বকাপে মরক্কো হলো আফ্রিকার একমাত্র, শেষ অবশিষ্ট কাতারে থাকা একমাত্র আরব দল, যারা আগামী শনিবার শেষ আটের লড়াইয়ে পর্তুগালের মুখোমুখি হবে। ‘আমি এটা বিশ্বাস করতে পারছি না, এই দলটি অলৌকিক কাজ করেছে! এটা খুব সুন্দর!’

২৪ বছর বয়সী মরক্কান যুবতী লামিয়া আফ্রিয়া বলেন। ‘আমি গর্বিত বোধ করছি, কারণ আমরা একটি অকল্পনীয় কাজ করেছি।’ যোগ করেন লামিয়া। দীর্ঘ অপেক্ষা ও হতাশার পর একটি স্বপ্নের বাস্তবায়নের পর মরক্কান সমর্থকরা (পুরুষ এবং মহিলা উভয়ই) লাল জাতীয় পতাকায় মোড়ানো বা টিম স্ট্রিপ পরে, তাদের ফুটবল নায়কদের সমর্থনে বিভিন্ন শহরের রাস্তায় বিজয় মিছিল করে এবং সেøাগান দিয়ে চারপাশের পরিবেশ মুখরিত করে রাখে। বিভিন্ন সেøাগানের একটি হলো, ‘পরবর্তী! এবং তারপর সর্বদা মরক্কোর সঙ্গে।’
আচরাফ হাকিমি পেনাল্টিতে গোল করার পর, মরক্কোর সমর্থকরা বন্ধু এবং পরিবারের সঙ্গে আলিঙ্গন ও লাফাচ্ছিল। ‘আমি এটা বিশ্বাস করতে পারছি না। এটি আমার জীবনের অন্যতম সেরা মুহূর্ত,’ ২৭ বছর বয়সী আমাল গালিদি আল জাজিরাকে বলেছেন। ফেজের বাসিন্দা বলেছিলেন ‘আরব এবং আফ্রিকান উভয়ই আজ সবচেয়ে সুখী মানুষ হবে।

ঈশ্বর আমাদের প্রার্থনা শুনেছেন।’ তিনি ঘোষণা করেছিলেন। আনাস বুমলেক (বয়স ২৬), বলেছেন ‘আমি খুব, খুব খুশি। এই জয় পুরো আরব বিশ্বের পুরো আফ্রিকার।’ দোহায় বসবাসকারী বুমলেক বলেছেন যে মরক্কো এবং কাতারে একটি ‘পার্টি পরিবেশ’ থাকবে।
মরক্কোর এই জয়ে সিরিয়া, সৌদি আরব এবং গাজার ফিলিস্তিনি ছিটমহলে উল্লাসের দৃশ্য দেখা গেছে। এমনকি ফিলিস্তিনি সমর্থকরা মরক্কোর দলের সম্মানে একটি গানও তৈরি করেছিল। মরক্কো দল বিজয়ের পর মাঠে উদযাপনের সময় ফিলিস্তিনের পতাকাও উড়িয়েছে। এমনকি মরক্কো এবং প্রতিবেশী উত্তর আফ্রিকার দেশ আলজেরিয়র মধ্যে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনার পরও এই জয়ে মরক্কোকে অভিনন্দন জানিয়েছে আলেজিরয়ার সাধারণ জনতা। ‘আপনার ভাই এবং প্রতিবেশীরা আপনার সঙ্গে আছে।’

লিখেছেন আলজেরিয়ার ডিজেডফুট টুইটার অ্যাকাউন্ট, যার এক মিলিয়নেরও বেশি ফলোয়ার রয়েছে। ‘সামাজিক নেটওয়ার্কের সমস্ত ঘৃণ্য এবং দূষিত ট্রল থেকে অনেক দূরে, আলজেরিয়ার জনগণ মরক্কোর জনগণের পেছনে রয়েছে,’ ডিজেডফুট যোগ করেন।
মরক্কো যদিও ভৌগোলিকভাবে আফ্রিকা মহাদেশে অবস্থিত। কিন্তু তাদের মূল ভূখ- থেকে ইউরোপের স্পেন মাত্র ১৪ কিলোমিটার (নয় মাইল) দূরে অবস্থিত (মাঝখানে আাছ ভূমধ্যসাগরের প্রবেশপথে জিব্রাল্টার প্রণালী! এত কাছে স্পেন, ফলে অর্থনৈতিকসহ অভিন্ন স্বার্থ আছে এই দুই দেশের।

সাহারা মরুভূমির বেশিরভাগ অংশ মরক্কোরই দখলে। এটা নিয়ে একসময় বছরখানেক কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব ছিল স্পেনের। মরক্কো দলের গোলরক্ষক ইয়াসিন বউনু ও ফরোয়ার্ড ইউসেফ এন-নেসাইরি স্প্যানিশ ক্লাব সেভিয়তে, ডিফেন্ডার জাওয়াদ এল ইয়ামিক ভালাদোলিদে, ফরোয়ার্ড আবে এজ্জালজোলি ওসানুনায় খেলেন। এছাড়া দলের অন্যদের বেশিরভাগই ইউরোপের বিভিন্ন দেশের লিগে খেলেন।
দলের অন্যতম তারকা আচরাফ হাকিমি, যার চিপ করা কিক মরক্কোর হয়ে পেনাল্টি শুটআউটের নিষ্পত্তি করেছিল, তার জন্ম মাদ্রিদে। একসময় তিনি রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে খেলেছেন। বিশ্বকাপের প্রথম সাত আসরে (১৯৩০-১৯৬২) বিশ্বকাপের মূলপর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে না পারা মরক্কো প্রথম মূলপর্বে খেলার সুযোগ পায় অষ্টম আসরে (১৯৬৬), আফ্রিকান জোন থেকে। তবে মজার ব্যাপার-১৯৬১ সালে মরক্কো কিন্তু বাছাইপর্ব খেলেছিল ইউরোপিয়ান জোনে!

অষ্টম আসরে মূলপর্বে খেলার সুযোগ পেলেও মরক্কো খেলতে অস্বীকার করে এবং সেই আসর বয়কট করে তারাসহ মোট ৩১ আফ্রিকান দেশ! ১৯৬৪ সালের ফিফার একটি রায়ের প্রতিবাদে ছিল এই বয়কট। ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত নবম আসরে মরক্কো মূলপর্বে প্রথমবারের মতো অংশ নেয় (১৯৩৪ সালে মিসরের পরে দ্বিতীয় আফ্রিকান দেশ হিসেবে)। সেবার গ্রুপ পর্ব থেকেই তারা বিদায় নেয়। এরপর টানা তিন আসরে (১৯৭৪, ১৯৭৮, ১৯৮২) মূলপর্বে খেলতে পারেনি মরক্কো।

১৯৮৬ আসরে খেলতে গিয়ে দারুণ খেলে। এবার তারা বিদায় নেয় দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে। এরপর এক আসর বিরতি দিয়ে ১৯৯৪ ও ১৯৯৮ আসরে খেলে আবারও প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায়। এরপর লম্বা বিরতির পর (২০০২, ২০০৬, ২০১০, ২০১৪) ২০১৮ আসরে ফিরে আবারও প্রথম রাউন্ড থেকে আউট। আর এবার তো ইতিহাসই গড়েছে তারা।

সম্পর্কিত বিষয়:

×