ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ...

জাহিদুল আলম জয়

প্রকাশিত: ২১:১৮, ৪ অক্টোবর ২০২২

সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ...

নেপালের কাঠমান্ডুকে অনুষ্ঠিত সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয়ী বাংলাদেশের নারী ফুটবলারদের উল্লাস

অপ্রতিরোধ্য ছন্দে গৌরবময় কীর্তিগাথা রচনা করেছে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। গত ১৯ সেপ্টেম্বর নেপালে ‘হিমালয় জয়’ করার মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের ট্রফি নিজেদের করে নিয়েছেন বাংলার অদম্য মেয়েরা। ২০০৩ সালের পর কি পুরুষ কি নারী যে কোন ধরনের ফুটবলে এটি দেশের সেরা সাফল্য। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা সাফল্য মেয়েদের সাফ জয়।
দেশের ক্রীড়াঙ্গনের অন্যতম সেরা সাফল্যের পর এখন সোনার মেয়েদের নিয়ে চলছে বাধভাঙ্গা আনন্দ-উচ্ছ্বাস। ইতোমধ্যে ইতিহাস গড়া দলটিকে ঐতিহাসিক সংবর্ধনা দেয়া হয়েছে ছাদখোলা বাসে। একের পর পুরষ্কারে ভাসছেন সাবিনা-সানজিদা, স্বপ্নারা। তবে ফুটবল বিশেষজ্ঞদের মতে, সোনাঝরা সাফল্যের পর আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই।

দক্ষিণ এশিয়ার গণ্ডি পেরিয়ে এশিয়া মানে যেতে হলে আরও কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায় করতে হবে মেয়েদের। এজন্য এ সাফল্যকে ধরে রেখে আরও এগিয়ে যেতে এখনই করণীয় ঠিক করতে হবে দেশের ফুটবলের অভিভাবক সংস্থা বাফুফেকে। প্রত্যয়ী মেয়েরা যেন ক্যারিয়ারের মাঝপথে ঝরে না পড়ে এজন্য সঠিক নিকনির্দেশনার মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হবে। এমনই বলছেন ফুটবল সংশ্লিষ্টরা।
বাংলার মেয়েদের এমন স্বর্ণসাফল্য আচমকা আসেনি। হাঁটি হাঁটি পা পা করে এতদূর এসেছে বাংলাদেশের নারী ফুটবল। দীর্ঘ এই পথের বেশিরভাগ সময়টা ছিল বন্ধুর। অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে, সংগ্রাম করে আজকের অবস্থানে আসতে হয়েছে বাংলার বাঘিনীদের। রক্ষণশীল সমাজের হুমকি আর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ২০০২ সালে বাংলাদেশে মেয়েদের ফুটবলের পথচলার শুরু। তখন এই পথে কিছু ফুল ফোটানো সম্ভব হয়েছিল। অনেকগুলো ফুল ফুটে আজ কাঠমা-র দশরথ স্টেডিয়ামে সৌরভ ছড়িয়েছে।

মূলত বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট দিয়ে নারী ফুটবলের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। সরকারের এমন উদ্যোগের সুফল পাচ্ছে মেয়েদের ফুটবল। বিভিন্ন অনুর্ধ পর্যায়ে দীর্ঘদিন খেলা মেয়েরাই আজ একসঙ্গে খেলছেন জাতীয় দলে। একসঙ্গে খেলতে খেলতে মেয়েরা ফুটবলের সঙ্গে দারুণভাবে মানিয়ে নিয়েছেন। দীর্ঘদিন তারা একই ট্রেনিং পাচ্ছে, একই খাবার খাচ্ছে, একই ছাদের নিচে থাকছে। নিজেদের সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দ ভাগাভাগি করে নিচ্ছে।
এসব মেয়েরা গত নয় বছর মতিঝিলের বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) ভবনে এক ছাদের নিচে আছেন। অর্থাৎ ?বাফুফে ভবনের আবাসিক ক্যাম্পই মেয়েদের বাড়ি। তাদের দিনের শুরু হয় সবুজ গালিচায়। গোধূলি বেলাতেও তাঁদের প্রিয় প্রাঙ্গণ আর্টিফিসিয়াল টার্ফ। সেই ১২ থেকে ১৩ বছর বয়সেই পরিবার ছেড়ে এখানে আছেন মনিকা, সানজিদা, মারিয়ারা। এক ছাদের নিচে একসঙ্গে ফুটবল নিয়ে মেতে উঠেছেন আঁখি-কৃষ্ণারা।

দীর্ঘদিন একসঙ্গে থাকার সুফলটা বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে পেয়েছে বয়সভিত্তিক পর্যায়ে। ২০১৫ সালে এএফসি অনুর্ধ-১৪ আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জিতে সাফল্যের সূচনা করে মেয়েরা। আর ২০১৭ সালে ঢাকায় অনুর্ধ-১৫ নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জেতার পরই এই মেয়েদের নিয়ে বাড়তি মনোযোগী হয় দেশের ফুটবলের অভিভাবক সংস্থা বাফুফে।
এরপর পালাক্রমে অনুর্ধ-১৬, অনুর্ধ-১৮ সাফেও বিজয়ের কেতন উড়িয়েছেন বাংলার অদম্য মেয়েরা।

মূলত গত আট দশ বছরে ছোট ছোট সাফল্যের কারণেই এখন সিনিয়র পর্যায়ে ইতিহাসের পাতায় সাবিনা, স্বপ্নারা। হিমালয় জয় করা এই মেয়েরা অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। আর্থিকভাবে অসচ্ছল অনেক মেয়েই জীবিকার তাগিদে ফুটবলে নাম লিখিয়েছেন। সামাজিক প্রতিবন্ধকতাও ছিল। কিন্তু এই মেয়েরা যে অদম্য। সব বাধা পেরিয়ে আসা সানজিদা-শিউলিরা জানেন কিভাবে জীবন যুদ্ধে জিততে হয়। নেপালকে তাদেরই মাঠে হারানো যুদ্ধ জয়ের মতোই। সেই যুদ্ধ জয়ে প্রতিটি নাম খোদাই করা থাকবে বাংলাদেশের ফুটবলের ইতিহাসের পাতায়। বেশিরভাগ মেয়েরাই উঠে এসেছেন অসচ্ছল পরিবার থেকে। যে কারণে এখন এই মেয়েদের দেখভালের দায়িত্ব সরকারের নেয়া উচিত বলে মনে করেন ফুটবল সংশ্লিষ্টরা।
বছর কয়েক আগেও এ দেশের মহিলা ফুটবল নিয়ে হাসাহাসি করা হতো! অথচ এখন চারদিকে প্রশংসা। দেশের নারী ফুটবলের প্রসারে অসামান্য অবদান রেখে চলেছে দৈনিক জনকণ্ঠও। সেই শুরু থেকে নারী ফুটবলকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে কাভারেজ দিয়েছে দেশের শীর্ষ এই দৈনিক। অনুর্ধ পর্যায়ের সাফল্যের খবরগুলো পত্রিকার প্রথম পাতায় গুরুত্ব সহকারে পরিবেশন করা হয়েছে। জনকণ্ঠের দেখাদেখি পরে অন্যরাও মেয়েদের সাফল্যের খবরকে গুরুত্ব দিতে থাকেন। আর আজ দক্ষিণ এশিয়া জয় করার পর দেশের সমস্ত মিডিয়ার প্রধান খবরের শিরোনাম হয়েছেন সাবিনা, স্বপ্না, সানজিদারা।
বাংলাদেশে মহিলা ফুটবলের শুরু ২০০২ সালে। ওই সময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ মহিলা ফুটবল দল বাংলাদেশ সফরে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে আসে। মিরপুর আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ওই ম্যাচে বাংলাদেশ হেরেছিল ১-০ গোলে। সেটাই ছিল বাংলাদেশ দলের যে কোন পর্যায়ের প্রথম কোন ম্যাচ। এছাড়া দেশে বাংলাদেশের প্রথম অফিসিয়াল লোকাল ম্যাচ ছিল বাংলাদেশ আনসার ও ঢাকা একাদশের মধ্যে। ২০০৪ সালে ম্যাচটি হয় কমলাপুর স্টেডিয়ামে। মৌলবাদীর হুমকির কারণে চারদিকে কড়া পুলিশ প্রহরার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত ওই ম্যাচে প্রতিপক্ষ আনসারকে ১-০ গোলে হারায় ঢাকা একাদশ। ২০০৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে ইন্দো-বাংলা গেমসে বাংলাদেশ দল তাদের প্রথম অফিসিয়াল ম্যাচ খেলে। বিদেশে গিয়ে বাংলাদেশ দল প্রথম ম্যাচ খেলে ২০০৫ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। ম্যাচটি গোলশূন্য ড্র করেছিলেন বাংলার মেয়েরা।
আগে সাতক্ষীরা, যশোর, রাঙামাটি ছাড়া আর কোন জেলা থেকে মেয়েরা খেলতে আসত না। আর এখন কমপক্ষে ৩০ জেলা থেকে মেয়েরা খেলতে আসে। এ থেকেই বোঝা যায়, দেশে মহিলা ফুটবলের বিস্তার ঘটেছে বেশ ভালভাবেই। সমৃদ্ধ হচ্ছে পাইপলাইন। যার ফল এখন দক্ষিণ এশিয়ার সেরা বাংলার মেয়েরা। মহিলা ফুটবল উন্নতির পথটা তৈরি হয়েছে মূলত দেশজুড়ে অনুষ্ঠিত বঙ্গমাতা বেগম ফজিলতুন নেছা বালিকা প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টের বদৌলতে।

এছাড়া জেএফএ অ-১৪ কাপ ও প্ল্যান অ-১৫ বালিকা ফুটবল কার্যক্রমের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। তবে বঙ্গমাতা ফুটবল আসরের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০১১ সাল থেকে শুরু হয় বহুল আলোচিত এই টুর্নামেন্টটি। সহযোগিতা করছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। বাফুফে সভাপতি কাজী মোঃ সালাউদ্দিনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মেয়েদের ফুটবল এখন এশিয়া মানে। আরেকজনের নাম না বললেই নয়, তিনি মহিলা ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ।

ফিফার কার্যনির্বাহী এই সদস্য মেয়েদের মায়ের মমতা দিয়ে গড়ে তুলেছেন। একসময় দেশীয় ফুটবলের উজ্জ্বল অতীত ঐতিহ্য ছিল। তা ছেলেরা ফিরিয়ে আনতে না পারলেও মেয়েরা পেরেছে। নিঃসন্দেহে এটি বড় অর্জন। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি, দলের অধিকাংশ মেয়ে উঠে এসেছে অবহেলিত গ্রামগঞ্জ ও প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। তাদের পরিবারগুলো একেবারেই হতদরিদ্র। তাদেরকে এখন প্রয়োজনীয় দেখভাল সরকারের করা উচিত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ নারী ফুটবলারদের বর্তমান বেতনভাতার কথা জানলে সবারই আঁতকে ওঠার কথা।
‘এ’ ক্যাটাগরির ফুটবলারদের মাসিক বেতন ১২ হাজার। ‘বি’ এবং ‘সি’ ক্যাটাগরির খেলোয়াড়দের বেতন ১০ হাজার ও ৮ হাজার। অথচ দীর্ঘ সময় কোন ফল আনতে না পারলেও চড়া বেতন পাচ্ছেন পুরুষ দলের ফুটবলাররা। এখন এই বৈষম্য দূর হওয়া সময়ের দাবি বলে মনে করছেন ক্রীড়াপ্রেমীরা।  মেয়েদের ফুটবলের আনন্দ-বেদনার কাব্যের সঙ্গে ওতপ্রোতোভাবে জড়িয়ে আছে কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের নাম। নারী ফুটবলারদের সাফল্যের মূল নেপথ্য কারিগরকে পাড়ি দিতে হয়েছে বন্ধুর পথ। অথচ একটা সময় ‘মহিলা কোচ’ বলে অনেক তাঁকে তাচ্ছিল্য করতেন!

×