ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আলোকিত অভিষেকে আলোচিত হৃদয়

শাকিল আহমেদ মিরাজ

প্রকাশিত: ০০:৪৫, ২২ মার্চ ২০২৩

আলোকিত অভিষেকে আলোচিত হৃদয়

তরুণ মেধাবী ক্রিকেটার তাওহিদ হৃদয়

বিপিএলে দারুণ পারফর্মেন্সের পর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি২০ সিরিজের দলে ডাক পান তৌহিদ হৃদয়। চট্টগ্রামে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বোলিংয়ের বিপক্ষে চার নম্বরে নেমে ১৭ বলে ২ চার ও ১ ছক্কায় করেন ২৪ রান। মিরপুরে দ্বিতীয় ম্যাচে ২ চারে ১৭। বড় জয় পাওয়া তৃতীয় ম্যাচ আর ব্যাটিং করতে হয়নি। ছোট দুটি ইনিংসে রনি তালুকদার ও হৃদয়ের সাহস, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, ইতিবাচক মানসিকতা দেখে দুজনকেই আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের দলে ডাকা হয়। কোচ হাতুরুসিংহে তখন বলেছিলেন, এমন ক্রিকেটারদেই দলে চান তিনি। যারা বুক চিতিয়ে ভয়ডরহীন ব্যাটিং করবে।

ছোট ইনিংসেও গড়ে দেবে পার্থক্য, সাহস সঞ্চার করবে গোটা দলের ওপর। সিলেটে জীবনের প্রথম ওয়ানতেই রাঙিয়ে দিয়েছেন ২২ বছর বয়সী হৃদয়। ৯২ রানের পথে গড়েছেন দেশের হয়ে অভিষেকে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংসের রেকর্ড। হয়েছেন ম্যাচসেরা। সেঞ্চুরির আক্ষেপের পর দ্বিতীয় ম্যাচে পুড়েছেন হাফ সেঞ্চুরির আক্ষেপে! এবার আউট ৪৯ রানে। তাতে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে অভিষেকে টানা দুই ম্যাচে ফিফটিবঞ্চিত হৃদয়। 
আট ইনিংসের ব্যবধানে পাঁচ হাফ সেঞ্চুরি, তেরো ম্যাচের বারো ইনিংসে রান তৃতীয় সর্বোচ্চ ৪০৩, স্ট্রাইক রেট ১৪০,৪১- ইনজুরি ধাক্কার মাঝেও ২০২৩ বিপিএলে তৌহিদ হৃদয়ের পারফর্মেন্স এটি। এরপরও ২২ বছর বয়সী তরুণ ব্যাটসম্যানকে ইংল্যান্ড সিরিজের দলে দেখে সিলেট স্ট্রাইকার্স অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা বলেছিলেন, একটু তাড়াতাড়িই হয়ে গেল। কিন্তু ফ্র্যাঞ্চাইজিটির ব্যাটিং কোচ রাজিন সালেহ জানিয়েছিলেন হৃদয় প্রস্তুত। ইংলিশদের বিপক্ষে টি২০ অভিষেকে ছোট্ট দুটি ইনিংসে আগামীর বার্তা দেওয়া তরুণ এবার ওয়ানডে আগমনে রাঙিয়ে দিলেন।

আফাসোস একটুর জন্য সেঞ্চুরি হলো না। আয়াল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডেতে ৮৫ বলে ৮ চার ও ২ ছক্কায় খেললেন ৯২ রানের দৃষ্টিনন্দন এক ইনিংস। চতুর্থ উইকেটে সাকিব আল হাসানের (৯৩) সঙ্গে গড়লেন ১৩৫ রানের জুটি। তাতেই বাংলাদেশ পায় ওয়ানডেতে ইতিহাসে নিজেদের সর্বোচ্চ ৩৩৮ রানের সংগ্রহ। আইরিশদের বিপক্ষে সিলেটে প্রথম ওয়ানডতে দর্শক মাতিয়ে হৃদয় ভেঙেছেন ১২ বছর আগের রেকর্ড। ২০১১ সালে হারারেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অভিষেক ওয়ানডেতে নাসির হোসেন খেলেছিলেন ৬৩ রানের ইনিংস।

টাইগারদের জার্সিতে অনেক ক্রিকেটারের অভিষেক হলেও গত এক যুগ ধরে এই রেকর্ড কেউই ভাঙতে পারেনি। অবশেষে সিলেটের নয়নাভিরাম স্টেডিয়ামের সবুজ গালিচায় সুন্দর ব্যাটিংয়ে সেই রেকর্ড ভেঙেছেন তৌহিদ হৃদয়। যখন ব্যাটিংয়ে নামেন, ক্রিজে ছিলেন সাকিব আল হাসান। বাংলাদেশ তখন ৮১ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে সংগ্রাম করছে। বড় তারকার সঙ্গে সাবলীল ব্যাটিং করে হৃদয় ১২৫ বলে ১৩৫ রানের জুটিতে অবদান রাখছেন। সাকিব ৯৩ রানে আউট হওয়ার পর মুশফিকের সঙ্গেও জুটি বেঁধে ৮০ রান যোগ করেন তিনি।

মুশফিক আউট হওয়ার পর হৃদয়ের নামের পাশে তখন ৯২ রান। সেঞ্চুরি থেকে মাত্র ৮ রান দূরে। তখনো ইনিংসে বল বাকি ২৭টি। হৃদয়ের জন্য সুবর্ণ সুযোগ ছিল পাঁচ নম্বরে নেমে সেঞ্চুরি করে বিশ্বরেকর্ড গড়ার। আউট হয়ে ফেরার পথে মুশফিক যেন সেই কথাই হৃদয়কে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন! যাওয়ার পথে হৃদয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে হয়তো বলেছেন সেঞ্চুরিটা করে আয়। কিন্তু পারেননি। ইয়াসির সিঙ্গেলস নিয়ে হৃদয়কে স্ট্রাইকে পাঠিয়েছিলেন। মুশফিক আউট হওয়ার এক বলের ব্যবধানে বোল্ড হয়েছেন গ্রাহাম হিউমের বলে।

দারুণ ছন্দে থাকা হৃদয় আইরিশ পেসারকে মিড উইকেটে খেলতে চেয়েছিলেন। ভাগ্য সহায় হয়নি। বল সরাসির লেগ স্টাম্প ভেঙে দিলে পরিষ্কার বোল্ডে সমাপ্তি ঘটে দারুণ এক ইনিংসের। তবে আউট হওয়ার আগে ৮৫ বলে ৮ চার ও ২ ছক্কায় ৯২ রানের ইনিংসে বাংলাদেশের হয়ে অভিষেকে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটি ঠিকই নিজের করে নেন। উল্লেখ্য, অভিষেকে পাঁচ নম্বরে নেমে সেঞ্চুরির রেকর্ড কারও নেই। সর্বোচ্চ ৯৯ রান করে রেকর্ড বুকে আছেন আরব আমিরাতের স্বপ্নিল পাতিল।

হৃদয় যেখানে দুই নম্বরে। সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে মাত্র ১ রানের জন্য বাংলাদেশি হিসেবে ওয়ানডেতে নিজেদের প্রথম দুই ইনিংসে ফিফটি পাওয়া হয়নি হৃদয়ের। মার্ক অ্যাডায়ারের বলে কট বিহাইন্ড হয়েছেন ৪৯ রান করে। ব্যাটের ভেতরের কানায় লেগে বল জমা পড়ে কিপার লরকান টাকারের গ্লাভসে। অনিশ্চয়তা নিয়েই রিভিউ নেন। তাতে লাভ হয়নি। ৩৪ বলের ইনিংসে ৪ চারের সঙ্গে মেরেছেন ১টি ছক্কা। আফিফ হোসেন ও মামমুদুল্লার মতো দুই ক্রিকেটারের অনুপস্থিতিতে অভিষেকেই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বার্তা দিলেন বগুড়া থেকে উঠে আসা ডানহাতি এ ব্যাটসম্যান।

‘আমার আসল নাম হচ্ছে তাওহিদ হৃদয়। তবে সবাই আমাকে তৌহিদ বলে। তাওহিদ ডাকলে আমার ভালো লাগে। তাওহিদের সুন্দর একটা অর্থ আছে তো’- স্মরণীয় অভিষেকের দিন ম্যাচসেরা হয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলছিলেন হৃদয়। নামের মতো গল্প আছে তার ক্রিকেট জীবনেরও। প্রতারিত হয়ে, বিরক্ত হয়ে, হতাশায় খেলা ছেড়েই দিতে চেয়েছিলেন একটা সময়। সেই হৃদয় এখন দেশের ক্রিকেটের আলোচিত একজন। বগুড়ার সন্তান হৃদয়ের ইচ্ছে ছিল বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার।

সেই শখ পূরণ হয়নি। পরে তিনি ভর্তি হন ঢাকার বনশ্রীর একটি ক্রিকেট একাডেমিতে। বাবাকে না জানিয়ে জমি বন্ধক রেখে টাকা জোগাড় করে দিয়েছিলেন তার মা। কিন্তু সেই একাডেমি ছিল আসলে ভুয়া। বড় চোট লাগে হৃদয়ের হৃদয়ে। কষ্টের টাকা গচ্চা দিয়ে ভাঙা মন নিয়ে তিনি ফিরে যান। বছর তিনেক পর তাকে রাজশাহীর বাংলা ট্র্যাক একাডেমিতে নিয়ে যান বিসিবি পরিচালক ও ওই একাডেমির কোচ খালেদ মাহমুদ। হৃদয়ের ক্রিকেটার হয়ে ওঠার অভিযান শুরু হয় আবার। ক্রিকেটার হয়ে ওঠার ইচ্ছেটা তার মনে গেঁথে যায় আরও অনেক আগে।

২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে স্মরণীয় জয়ের পর যখন বগুড়ায় যান মুশফিকুর রহিম, তখন তাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান হৃদয়।  সেদিনের ঘটনা আজও দোলা দেয় তার মনে। জীবনের নানা বাঁক পেরিয়ে, প্রতিবন্ধকতা আর প্রতিকূলতার নানা পথ পেরিয়ে সেই মুশফিকের কাছ থেকেই পেয়েছেন তিনি ওয়ানডে ক্যাপ। অভিষেকে সেঞ্চুরি আর পরের ম্যাচে একটুর জন্য হাফ সেঞ্চুরি পাওয়া হয়নি, ‘আমি তো শুরুতেও আউট হতে পারতাম।

যেটা হয়েছে সেটা আলহামদুলিল্লাহ। সবসময় আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। যেটা পেয়েছি, এটাই হয়তো আমার রিজিকে ছিল। যা পেয়েছি, এতেই আলহামদুলিল্লাহ। পরেরবার হবে ইনশাল্লাহ। আসলেই কোনো আক্ষেপ নেই। অভিষেকে এত রান ওভাবে চিন্তা করিনি। ভবিষ্যতে যাদের অভিষেক হবে, তাদের জন্য শুভকামনা, তারা যেন আরও ভালো কিছু করে।’ বলেন হৃদয়।

×