১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকার রাজপথে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর হুকুমে পেটোয়া পুলিশ বাহিনীর গুলিতে ঢাকার রাজপথে জীবন দান করেছিলেন রফিক, জব্বার, সালাম, বরকতসহ অনেকে। মাতৃভাষার জন্য আত্মোৎসর্গের এমন ইতিহাস সমগ্র বিশ্বে অদ্বিতীয়। মহান একুশে ফেব্রুয়ারি-ভাষা দিবস বাঙালী জীবনে দেখা দিয়েছিল প্রভাত সূর্যের রক্তরাগে। অমর একুশের শহীদের স্মৃতি বিজড়িত মাতৃভাষা দিবস আজ বাংলা দেশের গন্ডি পেরিয়ে পালিত হচ্ছে বিশ্ব অঙ্গনে। অদ্যাবধি একুশে ফেব্রুয়ারি রাতের প্রথম প্রহরে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে সমগ্র দেশের গ্রাম-গঞ্জের ক্ষুদ্র ভাষা মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রত্যর্পণ শুরু হয় একটি বিষাদের গান দিয়ে- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি- আমি কি ভুলিতে পারি’।
বায়ান্ন সালের পর থেকেই ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা অর্পণ করেছে ছাত্র-জনতা। কিন্তু সেটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের মাধ্যমে অনন্য মাত্রা পায় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের ফেব্রুয়ারিতে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে তীব্র বাঙালী ও বাংলা বিদ্বেষ নিয়ে সেই রাতেই পাকিস্তানী সামরিক জান্তা বুলডোজার দিয়ে চূণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছিল সেই প্রাণের মিনার। সদ্য স্বাধীন দেশে সেটি আবার পুনর্নির্মিত হয়। বহু মানুষই মনে করতে পারেন এই গানটি বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী নগ্নপদে মিনারের বেদিতে অর্পণ করলেন পুষ্পমাল্য। ’৭২ সালের জানুয়ারি মাসে স্বদেশ প্রত্যাগত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর পর তাঁকে অনুসরণ করে শহীদদের স্মরণে পুষ্প শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেছিলেন নবনির্মিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদিমূলে। এরপর এগিয়ে গেলেন মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দল, দেশের খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব, বিদেশী কূটনীতিকবৃন্দ এবং ছাত্রছাত্রীসহ আপামর জনগণ। সারা দেশের গ্রাম-গঞ্জ ও শহরের মানুষ নগ্নপদে সেই একই গান গেয়ে বরণ করেছিলেন ২১ ফেব্রুয়ারিকে।
আজ বাংলাদেশের সেই স্বাধীনতার বয়স হলো প্রায় অর্ধশতাব্দী। তথাপি সেই একই গানের বাণী ও সুর হৃদয়ে ধারণ করে আছে বছরের পর বছর। চলতি বছরেও একুশ পালিত হতে যাচ্ছে একই প্রথায়। শুধু তাই নয়, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ যেখানে রয়েছে সেখানেই গেছে ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনার এবং একইভাবে গেছে গাফ্ফার চৌধুরী রচিত আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো অবিস্মরণীয় গান। এই গান এবং একুশ যেন একই বৃন্তে দুটি ফুলের মতো। জাতিসংঘ কর্তৃক একুশকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেবার পর ইংরেজী, জাপানী ও সুইডিশসহ অনূদিত হয়ে পৃথিবীর ১২টি ভাষায় একুশের সূচনায় গাওয়া হচ্ছে বাঙালীর এই গান।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী সুদীর্ঘকাল ধরে টেমস নদীর তীরে ঐতিহ্যময় শহর লন্ডনে প্রবাসী। স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকার সময়ই তিনি পাড়ি দিয়েছিলেন। তারপর জাতির পিতার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর তিনি স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আর দেশে ফিরে আসেননি। শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানার মূল উপড়ানো দুঃসহ-করুণ প্রবাস জীবনে তার শুভাকাক্সক্ষী ও অন্যতম অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালনের কথা আমরা জানি। শুধু তাই নয়, দীর্ঘ এই প্রবাস জীবনে লন্ডনের বাঙালীদের সঙ্গে শুধু নয় দুনিয়ার বঙ্গভাষীদের সঙ্গে তার নাড়ির যোগ অবিচ্ছিন্ন।
ছুটির দিনে সময় পেলে এবং তাকে পাওয়া সম্ভব হলে গাফ্ফার ভাইয়ের নতুন লেখা নিয়ে এবং শরীরের খবরাখবর জানতে মাঝে মাঝে কথা হয় কখনও, গল্পও হয়। প্রায় দু’দশক পূর্বে নিউইয়র্কে আমি যখন কমিউনিটির প্রথম চাররঙা একটি পত্রিকা ‘সাপ্তাহিক কাগজ’ সম্পাদনা শুরু করলাম তখন তিনি এই পত্রিকার জন্য একটি আশীর্বাণী প্রেরণ করেছিলেন। নতুন সাপ্তাহিক নিয়ে তাঁর উপদেশ-পরামর্শ নিতাম।ওই দিনগুলোতেই বুঝেছিলাম তিনি অত্যন্ত নিরহঙ্কারী ও সোজাসুজি ধরনের মানুষ। তারপর মাঝে সুদীর্ঘ সময় তাঁর সঙ্গে কথা বলায় বিরতি ছিল বৈকি। কিন্তু আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কলম পাঠ করা থেকে কখনও বঞ্চিত থাকি না। কিন্তু সপ্তাহ কয়েক আগে একটা সময়ে তার উষ্ণ প্রস্রবণসম লেখনীর ভাষা স্তব্ধ দেখে ব্যাকুল হয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে ফোন করলাম। ইতোপূর্বে কদাচিত হয়ত আমাকে বলেছেন-‘মালেক মাঝে মাঝে শরীরটা একেবারে ভাল লাগে না।’ তারপরেও তিনি তাঁর কলম লেখনী চালিয়ে গেছেন অবিচ্ছিন্নভাবে।
যিনি দুই হাত সমানে চালনা করেন তাকে বাংলা ভাষায় বলা হয় সব্যসাচী। কিন্তু গাফ্ফার চৌধুরীকে যদি সব্যসাচী বিশেষণ দেয়া যায় তবে তার লেখনীর কণামাত্র মূল্যায়ন সম্ভব নয়। তিনি এমন একজন জাদুকর যিনি একদিকে কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার, নাট্য নির্দেশক, চলচ্চিত্রকার অন্যদিকে তার কলম থেকে নিঃসৃত হচ্ছে কিংবদন্তিসম ক্ষুরধার লেখনী। সাংবাদিক হিসেবে তার কলমের ক্ষুরধার ভাষা, উপমা, রসাত্মক রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ভাবনার খোরাকই শুধু যোগায় না দেয় নির্মল আনন্দ। দৈনিক জনকণ্ঠসহ বাংলাদেশের প্রধান প্রধান সংবাদপত্রে প্রায় প্রতিদিন তিনি যেসব কলম লেখেন, নিউইয়র্কের প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় বলা যায় প্রতি সংখ্যায় সেসব পুনঃমুদ্রিত হয়।
বাংলাদেশ ও ভারতসহ বিশ্বের বাংলা সাংবাদিকতায় জনপ্রিয়তা ও শ্রেষ্ঠত্ব তার শিরে শোভা পাচ্ছে শ্রেষ্ঠ কলামিস্টের মুকুট। চৌধুরী তার সৃজনশীল ও বস্তুনিষ্ঠ কলামের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন অগুনতি পদক। তার মধ্যে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সম্মানজনক একুশে এবং স্বাধীনতা পদক উল্লেখযোগ্য।
এত সবের পরও দেখা গেল তিনি যেন অর্জন করেছেন এক ফকিরীও। তাঁর এবারের নির্বাচন নিয়ে লেখাগুলোর সত্যতা দেখে কিছু পাঠক তাঁকে নতুন এক আখ্যা দিয়েছিলেন ‘ফকির’ হিসেবে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে নিজেকে নিয়েই রসিকতা করেছিলেন তিনি-ঝড়ে বক মরে ফকিরের কেরামতি বাড়ে। তবে আমাদের মতো পাঠক বার বার তাঁর লেখার মধ্যে দেখেছিলাম ঝড়ের নয়, দরবেশ ফকিরের কেরামতি। কারণ, ঝড়ে একবারই বক মরতে পারে কিন্তু বার বার তো নয়।
যাহোক, কয়েক সপ্তাহ আগে দেশের খবরের কাগজে অভূতপূর্বভাবে তাঁর কলম প্রকাশিত হওয়ার নির্ধারিত দিনগুলোতে তাঁকে চুপচাপ দেখলাম। তিনি যে ক’টা দিন লিখতে পারলেন না সে ক’টা দিন অসংখ্য পাঠকের সঙ্গে আমারও দিন কাটল উদ্বিগ্নতায়। এরপর লিখতে না পারার অক্ষমতা জানিয়ে তিনি কয়েকটি লাইন লিখলেন ইত্তেফাকের পাতায়। কিন্তু এরই সঙ্গে অবাক হয়ে দেখলাম, তিনি পরক্ষণেই সেখানে লিখে ফেলেছেন সম্পূর্ণ কলাম।
আমাকে বললেন, লন্ডনে এখন এত শীত পড়েছে যে বাড়ির হিটিং সিস্টেমকেও মনে হচ্ছে অকার্যকর। ঠান্ডায় শরীর এমন অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল যে লেখা সম্ভব হচ্ছিল না। সে দিনেই আমার বহু দিনের জমিয়ে রাখা আর এক আগ্রহকে মুক্তি দিলাম সুযোগ পেয়ে।
-আপনি কোন্ সময়টায় লেখলেখি করেন গাফ্ফার ভাই? কম্পিউটারে টাইপ করেই কি লেখেন?
তিনি জানিয়েছিলেন, প্রতিদিন সকালে লিখি এবং হাতে লিখেই ফ্যাক্স করে দেই।
তারপর এই ফেব্রুয়ারি মাসেই তিনি একদিন বললেন, মালেক আমি দুঃখিত আজ দেশী কথা বলতে পারব না। কারণ, গত তিন দিনে আমি দেশের কাগজের জন্য ছটি লেখা সম্পন্ন করে পাঠিয়ে দিয়েছি। কিছুক্ষণের মধ্যে শহীদ দিবসের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে রওনা হব।
মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হলাম, এরকম জীবনীশক্তি, লেখনীশক্তির কারণে তিনি একজন অদ্বিতীয় ব্যক্তি; যার নাম গাফ্ফার চৌধুরী।
তারপর ফেব্রুয়ারি মাসে এক ফোনালাপের ফাঁকে এই অবিস্মরণীয় গানটি সম্পর্কে গীতিকার নিজে কি বলেন জানতে দারুণ ইচ্ছে হলো। আমার আগ্রহের নিবৃত্তি ঘটাতে তিনি কোন বিলম্ব না করে বলে গেলেন সেই অক্ষয় দিবসটির কথা। গাফ্ফার ভাই সেদিন বলেছিলেন, ঢাকা কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র থাকাকালীন ’৫২ সালের একুশের দিনে তিনি সেটি কবিতা হিসেবে রচনা করতে শুরু করেছিলেন। সেদিন এ বিষয়ে কথোপকথন আর এগোয়নি।
হঠাৎ করে সপ্তাহের পরবর্তী দিনগুলোতে মনের অন্তরালে সাংবাদিকতার কেমন একটা ইচ্ছা নাড়া খেয়ে যেতে লাগল। গাফ্ফার ভাইয়ের একটি সাক্ষাতকার নিলে কেমন হয়? ব্যাপারটা জানালাম জনকণ্ঠের উপদেষ্টা সম্পাদক শ্রদ্ধেয় তোয়াব খান সাহেবকেও। পরের সপ্তাহে ফোন করাকালে এ বিষয়ে গাফ্ফার ভাইকে অনুরোধ জানাতেই তিনি সহৃদয়তার সঙ্গে আমার মতো অভাজনকেও খালি হাতে ফেরালেন না।
আজ থেকে ৬৭ বছর আগে গাফ্ফার চৌধুরীর অমর রচনা আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটি সম্পর্কে তার বর্তমান ভাবনা এবং মূল্যায়ন নিয়ে আমি মূলত গ্রহণ করেছিলাম তার এক টেলিফোন সাক্ষাতকার। সেখানে তিনি ব্যক্ত করেছিলেন তার সারা জীবনের যা কিছু অর্জন সব কিছুকেই অতিক্রম করেছে তার এই গানটি।
এই নিয়ে স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে সেদিন তিনি বললেন, আমি যখন গানটি লিখি তখন আমার বয়স মাত্র ১৮ বছর। পড়ছি ঢাকা কলেজে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন শুরু করার পর থেকেই সকল নগরবাসি, মানুষের মতো এই দাবির সঙ্গে আমিও একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাম। পাকিস্তান সরকার ছাত্রদের এই দাবিকে নস্যাত করার জন্য নানারকম দমন ও নিপীড়নের নির্যাতনমূলক কর্মকান্ড শুরু করে। তারা ১৪৪ ধারা জারি করে ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচীতে বাধা দিতে থাকে। এক পর্যায়ে মুসলিম লীগ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন ছাত্র-ছাত্রীদের নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ মিছিলে গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হলো তাদের শোণিত ধারায়।
আপনি কখন এই গানটি রচনার জন্য উদ্বুদ্ধ হলেন?
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : চারদিকে উত্তেজনা ও থমথমে পরিস্থিতি উপেক্ষা করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে চলে গেলাম। আমি শুনেছিলাম সেখান শহীদদের লাশগুলো রাখা আছে। আউটডোরে গিয়ে দেখলাম ভাষার দাবিতে খুন হওয়া রফিকের রক্তাক্ত লাশ। সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো এ আমার ভাই। দুঃখ ভারাক্রান্ত এক বেদনায় আরও ভাবলাম আজকের একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখটি রক্তে রাঙানো হয়ে গেছে আমার এই ভাইয়ের শোণিত ধারায়। তারপর সে রাতেই আমি লিখতে শুরু করলাম কবিতাটি।
আপনি বললেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে রক্তাক্ত ভাষাসৈনিক রফিকের মরদেহটি দেখে আপনার মাথায় ২১ শের চিরকালের গানটির প্রথম চরণটি কবিতা হিসেবে এসে গিয়েছিল। তাহলে সম্পূর্ণ গানটি আপনি কি ঐদিনেই লিখেছিলেন?
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : নাহ, সেদিনই নয়। কবিতাটি সম্পন্ন করতে সময় লেগেছিল বেশ কয়েকদিন। গায়ক ও সুরকার আব্দুল লতিফ গান হিসেবে এতে সুর দেন এবং এই গান ঢাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাওয়া হতে থাকে। তবে পরবর্তী সময়ে এই গান গাওয়া হতে লাগল আলতাফ মাহমুদের সুরে। স্বাধীনতা আন্দোলনের সেই অগ্নিঝরা দিনে নির্মিত জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেওয়া’ চলচ্চিত্রেও এই গানটি ব্যবহার করা হয়েছিল। শহীদ দিবসের প্রধান গান হিসেবে আমার গানটির প্রচলন শুরু হয় ১৯৫৪ সাল থেকে।
এরপর আমি বিষয়ান্তরে গিয়ে এক রকম রসিকতা করেই বললাম আপনি নিজেই অনেকবার বলেছেন আপনার লেখাপড়ার সূচনা ঘটেছিল মাদ্রাসায়। কিন্তু তারপরেও বাংলা ভাষার এমন দরদী আপনি কি করে হলেন। শুধু দরদী নয়, আপনি লেখালেখি পর্যন্ত শুরু করলেন সেই ভাষায়।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : ১৯৪৬ সালে মাদ্রাসার পাঠ চুকিয়ে বালক বয়সেই আমি স্কুলে ভর্তি হই। আর কবিতা লিখতে শুরু করি যখন চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি। বালক বয়সে এই কবিতা রচনার কারণ হিসেবে বলা চলে আমাদের পারিবারিক সাহিত্য চর্চার ঐতিহ্য। আমার দুই চাচাত ভাই ফজলুল রহিম চৌধুরী ও নুরল হক চৌধুরী ছিলেন নামী সাহিত্যিক। তাদের লিখিত বইপত্র সে সময় প্রকাশিত হয়েছিল সে সময়ের কলকাতা থেকে। নুরল হক চৌধুরীর ‘বঙ্গের জমিদার’ ও ‘কালা পাহাড়’-এর নাম আজও আমি মনে করতে পারছি।
প্রবাদতুল্য সাংবাদিক জীবনে সম্পর্কে আমার আগ্রহের অন্ত নেই। এবার সুযোগ পেয়ে সেটি নিবৃত্ত করতে চাইলাম।
আপনি সাংবাদিকতায় এলেন কখন এবং কিভাবে ?
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : আমার যখন জন্ম হয়েছিল ১৯৩৪ সালে বরিশালে। তখন আমাদের পরিবার ছিল সচ্ছল। কিন্তু কৈশোর বয়সে এক সময় আর্থিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ায় আমাকে নিতে হলো তার কিছু দায়িত্ব। ১৯৪৮ সালে স্থানীয় এক পত্রিকা যার নাম ছিল ‘সাপ্তাহিক বরিশাল হিতৈষী’ সেখানে কাজ নিলাম প্রুফ রিডার হিসেবে। কাজকর্মের ফাঁকে পাশাপাশি শুরু হলো আমার লেখালেখি। যখন ম্যাট্রিক ক্লাসে পড়ি তখন থেকে ঐ পত্রিকার নিউজ ডিপার্টমেন্টে শুরু হলো সাংবাদিকতার পেশা।
আপনার সাংবাদিকতা জীবনে কি কাউকে গুরু বলে বিশ্বাস করেন ?
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : হ্যাঁ, করি তবে একজন নন আমার গুরু হলেন তিন জন। বরিশালের দুর্গা মোহনসেন, নূর আহমেদ ও ইত্তেফাকের তোফাজ্জ্বল হোসেন মানিক মিয়া। পারিবারিক পরিচয় হিসেবে জানিয়েছিলেন তাঁর পিতার নাম হাকীম ওয়াজেদ রেজা চৌধুরী ও মাতা জোহরা খাতুন। ভাই ছিলেন দুই এবং বোন তিন জন। তার নিজের রয়েছে এক ছেলে ও চার মেয়ে। তারা কেউ সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেননি। কিন্তু কনিষ্ঠ কন্যা সাহিত্য অনুরাগী। তিনি ইংরেজী সাহিত্যে পিএইচডি করেছেন ।
আচ্ছা গাফ্ফার ভাই একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে হয় যে, আপনি জীবনে কখন প্রথম বঙ্গবন্ধুকে দেখেছিলেন এবং আপনার সঙ্গে কিভাবে পরিচয় সেটা মনে আছে ?
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : আমি যখন স্কুলছাত্র ১৯৪৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমান এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছিলেন বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে। সেখানে তিনি একটি ভাষণ দেন। আমি সেই অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম যখন স্কুলে ক্লাস সিক্সের ছাত্র।
সেটি কেবল তাকে দেখতে যাওয়া?
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : না আমি তার ভাষণ শুনেছি এবং এরপর কিশোর সাংবাদিক হিসেবে তার সঙ্গে কথাও বলেছি। সেই থেকে পরিচয়। এরপর থেকে তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন।
এক সময় আপনার লেখায় পড়েছিলাম, দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু গণভবনের অফিসে দুপুরের আহারের পর আপনাকে তাঁর একটি আত্মজীবনী লেখার জন্য ডিকটেশন দিতেন। সেটি শেষ হওয়ার আগেই আপনি অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে ’৭৫ সালের গোড়ায় লন্ডনে চলে গেলেন। তারপর তো সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর জীবনকে স্তব্ধ করে দিল স্বাধীনতার শত্রুরা। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, আপনি যতটুকুই লিখতে পেরেছিলেন সেটি কি হারিয়ে গেছে?
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : না সেটি হারায়নি। আমি লন্ডনে যাবার সময় পাণ্ডুলিপিটি আমার সঙ্গেই নিয়ে গিয়েছিলাম। পরবর্তীকালে সেটি বই আকারে প্রকাশের ইচ্ছে পোষণ করতাম। কিন্তু যখন দেখলাম বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা পিতার হস্তলিখিত একটি খাতায় অসমাপ্ত আত্মজীবনী পেয়ে সেটি প্রকাশ করলেন তখন আমি আর অগ্রসর না হয়ে উদ্যোগ পরিত্যাগ করি ।
সেটির সঙ্গে কি আপনার পাণ্ডুলিপির মিল আছে ?
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : হ্যাঁ আছে।
গাফ্ফার চৌধুরী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছিলেন মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত তদানীন্তন জয়বাংলা পত্রিকাটির। এছাড়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত প্রচারিত হতো তার লিখিত রাজনৈতিক বিশ্লেষণধর্মী কথিকা। এরই পাশাপাশি কলকাতার খ্যাতনামা দুটি দৈনিক আনন্দ বাজার ও দৈনিক যুগান্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘটনাবলী নিয়ে অত্যন্ত জনপ্রিয় নিয়মিত কলম লিখতেন।
সারা বিশ্বের দেশে দেশে নানা ভাষায় আজ যখন গান গাওয়া হয় তখন আপনার
অনুভূতিটা বলবেন কি ?
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : ভাল লাগে- আমি গর্ববোধ করি।
সবশেষে আমার জিজ্ঞাসা ছিল, রবীন্দ্রনাথ একবার তার নিজের সৃষ্ট গান সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেনÑবাঙালী সুখে-দুঃখে, হাসি-কান্নায় তার গান না গেয়ে পারবে না। এত বছর ধরে আপনার সেই গানের এমন অসাধারণ জনপ্রিয়তার কথা আপনি নিশ্চিয়ই সেই কৈশোর উত্তীর্ণ বয়সে ভাবতে পারেননি। কিন্তু আজ এই বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের মতো আপনার নিজের মূল্যায়ন কি? আপনি কি মনে করেন এই পৃথিবীতে যতদিন বাঙালী জাতি বেঁচে থাকবে, বাংলা ভাষা থাকবে ততদিন। তারা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’ গানটি একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে না গেয়ে পারবে না? আবদুল গাফফার চৌধুরী : কবিগুরু একজন বিশাল সাহিত্যিক-সুবিশাল তার কর্ম। তুলনায় আমি সামান্য মানুষ। তারপরেও আমি মনে করি, যাঁরা এই গানের উৎস রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত ১৯৫২ সালের সেসব ভাষা শহীদরা যেমন আজও মানুষের হৃদয়ের আবেগের সঙ্গে জড়িত হয়ে চিরজাগরূক হয়ে আছেন, তেমনি করে চিরকাল বেঁচে থাকবে আমার এই একুশের গানটিও।
সাক্ষাতকার গ্রহণ : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
লেখক : আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]