ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভিডিও কনফারেন্সে যমুনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেল সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী

ঢাকা থেকে পায়রায় যাবে রেল

প্রকাশিত: ২১:২২, ৩০ নভেম্বর ২০২০

ঢাকা থেকে পায়রায় যাবে রেল

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ দেশের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী ও মজবুত করতে সরকার নৌ, রেল ও আকাশপথের সার্বিক উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচী বাস্তবায়ন করছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আমাদের আরও পরিকল্পনা রয়েছে যে, একেবারে ঢাকা থেকে বরিশাল, পটুয়াখালী হয়ে পায়রা বন্দর পর্যন্ত আমরা রেললাইন নিয়ে যাব। তারও সমীক্ষা আমরা শুরু করব এবং সেই উদ্যোগ আমরা নিয়েছি। রেলকে প্রায় গলাটিপে হত্যা করতে গিয়েছিল বিএনপি সরকার। আমরা ক্ষমতায় এসে তাকে জীবিত করেছি। এখন রেলই মানুষের সব থেকে বড় ভরসা। রবিবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতুর উজানে ১৬ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে পৃথক ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু নির্মাণ’ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের এই পরিকল্পনার কথা জানান। তিনি আরও বলেন, জাতির পিতা বলেছিলেন বাংলাদেশ হবে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড। অর্থাৎ বাংলাদেশ হবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে একটা সেতুবন্ধন। তিনি বলেন, সেই সেতুবন্ধন করতে গেলে আমাদের ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে সংযোগ করতে হবে। ট্রান্স এশিয়ান হাইওয়ে এবং ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে এই দুটোর সঙ্গে যদি আমরা সম্পৃক্ত হতে পারি তাহলে বাংলাদেশের গুরুত্ব অনেক বাড়বে। ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে, কর্মসংস্থান বাড়বে। মানুষের যোগাযোগ বাড়বে। কাজেই আমাদের জন্য একটা বিরাট সুযোগ সৃষ্টি হবে। সারাদেশে শক্তিশালী যোগাযোগ নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী এ সময় স্বল্প মূল্যে পণ্য ও জন পরিবহন নিশ্চিত করতে দেশব্যাপী রেল যোগাযোগ আরও সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ গ্রহণের কথা জানিয়ে বলেন, রেলকে আরও শক্তিশালী করার পরিকল্পনা রয়েছে। সারাদেশে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের জন্য রেলনেটওয়ার্ক আমরা সৃষ্টি করব। যাতে অল্প খরচে পণ্য পরিবহন এবং মানুষের যাতায়াতের অনেক সুবিধা হয়।’ প্রধানমন্ত্রী তার সরকারী বাসভবন গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমপাড় সিরাজগঞ্জের সয়দাবাদে আয়োজিত মূল অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। বাংলাদেশে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব সেলিম রেজা স্বাগত বক্তৃতা করেন। মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস গণভবন প্রান্ত থেকে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। গণভবন প্রান্তে এবং মূল অনুষ্ঠানস্থলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী, স্থানীয় সংসদ সদস্যবৃন্দ, উন্নয়ন সহযোগী জাপানের জাইকার উর্ধতন কর্মকর্তাসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রেলপথ মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাবৃন্দ, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এবং সাধারণ জনগণ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতুর ওপর একটি ভিডিও চিত্র প্রদর্শিত হয়। যমুনা নদীর ওপরে বঙ্গবন্ধু সেতুর ৩০০ মিটার উজানে নির্মিত হচ্ছে ডাবল লেনের ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতু। জাপান ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই রেল সেতুটি নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে জাইকা। ২০২৫ সাল নগাদ এর নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, সারা বাংলাদেশে আমরা রেলের নেটওয়ার্ক তৈরি করতে চাচ্ছি। একেবারে ঢাকা থেকে বরিশাল, পটুয়াখালী হয়ে পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেললাইন নিয়ে যাব। তার সমীক্ষা শুরু করব সে ব্যাপারে আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, সেখান থেকে কক্সবাজার ও টেকনাফ পর্যন্ত যাবে রেললাইন। রেলপথ, সড়ক পথ, আকাশ পথ এইসবগুলোর উন্নয়নেই আমরা ব্যাপক কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। তাতে আমাদের দেশের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে, মজবুত হবে। তাছাড়া ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যখন আমরা সংযুক্ত হয়ে যাব, এটাও আমাদের জন্য বিরাট কাজ হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিস্তা নদীর ওপর যে রেল সেতু সেখানে গাড়ি চলার কোন সেতু ছিল না। তিনি সরকারে আসার পর সেখানে পৃথক সড়ক সেতু করে দেন। নইলে আগে রেলসেতুর ওপর দিয়েই ঝুঁকিপূর্ণভাবে গাড়ি পারাপার চলত। এছাড়া ভৈরবে রেল লাইনের ওপর দিয়েও অপেক্ষমাণ থেকে একটা করে গাড়ি পার হতো। সেখানেও পৃথক সড়ক সেতু করা হয়েছে। কালুরঘাটেও রেল সেতুর পাশাপাশি পৃথক সড়ক সেতু হয়েছে। এভাবে সারা বাংলাদেশে রেল যোগাযোগকে উন্নত করা, আধুনিক করা এবং বহুমুখী করা যাতে মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখতে পারে। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা করে যাচ্ছি। সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা এ সময় দেশের উন্নয়নে সকলকে আন্তরিকতার সঙ্গে স্ব-স্ব দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পাবার জন্য যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টিও স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস যাতে আমাদের দেশের মানুষের ক্ষতি করতে না পারে, তার জন্য যা যা করা দরকার আমরা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে, আমি আবারও দেশবাসীকে আহ্বান জানাব, সকলেই স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিয়মগুলো মেনে চলবেন। সবাইকে মাস্ক ব্যবহারের প্রতি গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, নিজেকেও সুরক্ষিত করেন এবং অপরকেও সুরক্ষিত রাখেন। যাতে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে। প্রধানমন্ত্রী বলেন,‘আজকে আমি খুবই আনন্দিত, কেননা রেল সেতু করার ব্যাপার নিয়ে আমাকে অনেক তর্ক করতে হয়েছে, অনেক দেন দরবার করতে হয়েছে। আজকে একটা আলাদা সেতু হয়ে যাচ্ছে, যার ফলে আমি মনে করি দেশের অভ্যন্তরীণ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নতো হবেই, তেমনি আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিকভাবেও আমরা আরও সমৃদ্ধ হব। যা আমাদের দেশকে ভবিষ্যতে আরও উন্নত করবে। জাতির পিতা আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে গিয়েছেন। তার কাক্সিক্ষত উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলতে সক্ষম হব, ইনশাল্লাহ।’ প্রধানমন্ত্রী এ সময় দাতাগোষ্ঠীর প্রেসক্রিপশনে বিএনপি’র রেলবন্ধ করে দেয়ার প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করে বলেন, অথচ তিনি নিজের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু সেতুর সঙ্গে রেল সংযোগ প্রদান করেন। আর এখন দাতাগোষ্ঠীরাই সেখানে পৃথক একটি রেলসেতু করারও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন। একের পর এক রেলস্টেশন বন্ধ করে দিয়ে রেলকর্মচারীদের কর্মচ্যুতি ঘটানোর প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, রেলকে প্রায় গলাটিপে হত্যা করতে গিয়েছিল বিএনপি সরকার। আমরা ক্ষমতায় এসে তাকে জীবিত করেছি। এখন রেলই মানুষের সবথেকে বড় ভরসা। আমরা দেখতে পাচ্ছি সে সুযোগটা (রেল) সবকিছুতেই মানুষকে করে যাচ্ছি। যা অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখবে বলে আমি মনে করি। শেখ হাসিনা আরও বলেন, জাতির পিতাকে হত্যা করে যারা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছিল তারা দেশ ও দেশের মানুষের কথা কখনও চিন্তা করেনি। তাদের কোন দায়বদ্ধতা ছিল না। তারা নিজেদের সম্পদ গড়ার কাজে ব্যস্ত ছিল। তারা রেলকে ধ্বংসের পথে নিয়ে গেছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে সারাদেশে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করে নতুন রেল, বগি, ক্যারেজ, ইঞ্জিন আমদানির পাশাপাশি নতুন রেলপথের সৃষ্টি করলেও ২০১৩, ১৪ ও ১৫ সালে অগ্নিসন্ত্রাসের নামে বিএনপি-জামায়াত সবচেয়ে বড় আঘাতটা হানে এই রেলের ওপরেই। প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতার অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে বলেন, ‘জাপান আমাদের সত্যিকার পরীক্ষিত বন্ধু এবং জাতির পিতা ১৯৭৩ সালে জাপান সফরের সময়ই যমুনা নদীর ওপর সেতুর জন্য জাপানকে অনুরোধ করেছিলেন। ’৯৬ সালে জাপান যাওয়ার পর জাপানের প্রধানমন্ত্রীর জানতে চাওয়ার প্রেক্ষিতে খুলনা ও বাগেরহাটের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী রূপসা সেতু এবং পদ্মা সেতু নির্মাণে জাপানের সহযোগিতা চান তিনি। এ সময় জাপানের প্রধানমন্ত্রী রাজি হয়ে জানতে চান প্রথম কোনটা করা হবে। যেহেতু রূপসাটা তাড়াতাড়ি হবে, আর পদ্মা খরস্রোতা নদী, এটার সমীক্ষায় সময় লাগবে, ব্রিজ বানাতেও সময় লাগবে, তাই রূপসা সেতুর কথাই আগে বলেন বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাপান সরকার পদ্মা সেতুর বর্তমান স্থলে ফিজিবিলিটি স্টাডি শেষ করার পর তার সরকার ২০০১ সালে সেখানে ভিস্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেও পরবর্তী খালেদা জিয়া সরকার সে সেতুর নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয়। দুর্ভাগ্য যে বিএনপি ক্ষমতায় এসে সেটা বন্ধ করে দেয়। খালেদা জিয়া বলল, এখানে সেতু করা যাবে না! ২০০৮ সালে সরকারে আসার পর থেকে এ পর্যন্ত নিজেদের অর্থায়নে পদ্মাসেতুর নির্মাণ কাজ আল্লাহর রহমতে প্রায় শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। জাপানের অবদানের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি যখনই জাপান গিয়েছি তখন সবসময়ই জাপান সরকার আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এজন্য বিশেষভাবে আমি জাপান সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। সর্বশেষ আমি যখন জাপান সফর করি তখন শিনজো আবে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। যিনি দুহাত খুলেই বাংলাদেশকে সহযোগিতা করেছেন। তাই তাকে এবং জাপানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকেও আমি ধন্যবাদ জানাই তারা সবাই বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু।’
×