ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৩ জুলাই ২০২৫, ৮ শ্রাবণ ১৪৩২

বিমান দুর্ঘটনার পরপরই নজর কেন ব্ল্যাক বক্সে?

প্রকাশিত: ০৭:৪১, ২৩ জুলাই ২০২৫

বিমান দুর্ঘটনার পরপরই নজর কেন ব্ল্যাক বক্সে?

ছবি: সংগৃহীত

যুদ্ধবিমান হোক বা যাত্রীবাহী, দুর্ঘটনার পর প্রাণহানির মতো অপূরণীয় ক্ষতির শোক কিছুটা সামলে ওঠার পরই শুরু হয় অঘটনের কারণ খোঁজার তরজোড়। দুর্ঘটনার দোষ চাপানোর প্রবণতা আর গুঞ্জন-গুজবের ডালপালা বিস্তারের পথ বন্ধ করতে চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বিমানের এক বিশেষ যন্ত্র—যা ব্ল্যাক বক্স নামে পরিচিত।

বাংলাদেশ-ভারত ছাড়াও গত কয়েক মাসে বিভিন্ন দেশে একাধিক বিমান দুর্ঘটনার পর আবার আলোচনায় এসেছে এই ব্ল্যাক বক্স। কেন দুর্ঘটনার পর সব সামর্থ্য দিয়ে এটি উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়েন তদন্তকারীরা? কী আছে এই যন্ত্রে?

ব্ল্যাক বক্স নামটি শোনায় একবচন হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি দুটি ভিন্ন যন্ত্রের সমন্বয়ে তৈরি। একটি হচ্ছে ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডার (FDR), যা বিমানে কম্পিউটারে দেয়া ইনপুট আর পাইলটের তাৎক্ষণিক নির্দেশনা রেকর্ড করে। এতে বিমানের গতি, অবস্থান, গতিপথসহ নানা কারিগরি তথ্য সংরক্ষিত হয়। অন্যটি হলো ককপিট ভয়েস রেকর্ডার (CVR), যা ককপিটে পাইলট ও কো-পাইলটের কথোপকথন এবং এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সঙ্গে আদান-প্রদানের শব্দ রেকর্ড করে।

নামে ব্ল্যাক বক্স হলেও এর রঙ কালো নয়—এটি উজ্জ্বল কমলা। প্রতিফলক ফিতা বা রিফ্লেক্টিভ টেপে মোড়ানো থাকে যন্ত্রটি, যাতে আলো পড়লে সহজেই শনাক্ত করা যায়। দুর্ঘটনার পর দ্রুত শনাক্ত করতে এই বর্ণবিন্যাস অত্যন্ত কার্যকর। বক্সের অবয়ব আসলে বাক্সের মতো নয়, বরং একটি সিলিন্ডারের মতো গঠনে তৈরি। সিলিন্ডারে থাকে মেমোরি ইউনিট এবং তার পাশেই থাকে ব্যাটারি।

ব্ল্যাক বক্সে বিমানের ফ্লাইটকালীন যাবতীয় তথ্য এবং ককপিটে থাকা ব্যক্তিদের কথোপকথন স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেকর্ড হয়। পাইলটদের হেডসেট এবং ককপিটের মাঝামাঝি স্থানে বসানো প্রায় চারটি মাইক্রোফোনের মাধ্যমে এসব রেকর্ডিং সংরক্ষিত হয়। ফলে দুর্ঘটনার পর ব্ল্যাক বক্সের বিশ্লেষণে বিমানের শেষ মুহূর্তের পরিস্থিতি স্পষ্ট হয়, যার মাধ্যমে দুর্ঘটনার কারণ নির্ধারণ করা সহজ হয় এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।

এই যন্ত্র প্রায় ২৫ ঘণ্টা ধরে নানা ধরনের কারিগরি তথ্য ও কথোপকথন রেকর্ড করতে সক্ষম। বিদ্যুৎ ছাড়াও এটি ৩০ দিন পর্যন্ত কাজ করতে পারে। যদি ব্ল্যাক বক্স কোথাও হারিয়ে যায়, তবে এটি ৩০ দিন ধরে উচ্চ শব্দের সঙ্গে ভাইব্রেশন তৈরি করে সংকেত পাঠাতে পারে। এমনকি এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৪ হাজার ফুট গভীর থেকেও তরঙ্গ নির্গত করতে সক্ষম, যা ২ থেকে ৩ কিলোমিটার দূর থেকে শনাক্ত করা সম্ভব।

প্রত্যেকটি দুর্ঘটনার তদন্তে ব্ল্যাক বক্স একটি অপরিহার্য উপাদান। ককপিটে কী ঘটেছিল, ফ্লাইট কন্ট্রোল ইনপুট ও ডেটা এন্ট্রির মাধ্যমে ঠিক কী নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল—এসব তথ্য সুনির্দিষ্টভাবে জানার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস এই যন্ত্র।

ব্ল্যাক বক্সের ইতিহাসও বেশ পুরনো। রাইট ব্রাদার্স প্রথম বিমানের পাখার ঘূর্ণনের তথ্য রেকর্ড করতে যন্ত্র ব্যবহারের ধারণা দেন। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে উন্নত ব্ল্যাক বক্স ব্যবহারের প্রচলন শুরু হয়। যন্ত্রটি সাধারণত বিমানের পেছনে রাখা হয়, যাতে এটি দুর্ঘটনার সময় তুলনামূলকভাবে নিরাপদ থাকে। শক্তিশালী টাইটানিয়াম ধাতু দিয়ে তৈরি এই যন্ত্র একটি সুরক্ষিত বাক্সে আবদ্ধ থাকে, যা আগুন, পানি, তাপমাত্রা ও চাপ সহ্য করতে পারে।

এই যন্ত্র এক ঘণ্টা ধরে প্রায় ১১,০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এবং দশ ঘণ্টা পর্যন্ত ২৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। ফলে দুর্ঘটনার পর বিমান যদি সম্পূর্ণ ভেঙে যায় বা আগুনে পুড়ে যায়, এমনকি পানিতে তলিয়ে গেলেও ব্ল্যাক বক্স সাধারণত অক্ষতই থাকে।

এইসব কারণেই একটি বিমান দুর্ঘটনার পর তদন্তকারীরা প্রথমেই যে জিনিসটির খোঁজ করেন তা হলো ব্ল্যাক বক্স—কারণ এর মধ্যেই থাকে সব প্রশ্নের উত্তর।

শেখ ফরিদ 

আরো পড়ুন  

×