
প্রাগৈতিহাসিক কাদায় পাওয়া একজোড়া ক্ষুদ্র ‘নখরযুক্ত’ পায়ের ছাপ বদলে দিতে পারে প্রাণীজগতের বিবর্তনকথা। অস্ট্রেলিয়ায় পাওয়া ৩৫৬ মিলিয়ন বছর পুরোনো একটি শিলাখণ্ডে এই ছাপ আবিষ্কারের ফলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, আগের অনুমানের চেয়ে প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ মিলিয়ন বছর আগেই পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিল আধুনিক সরীসৃপের পূর্বপুরুষেরা।
এই আবিষ্কার শুধু সরীসৃপ নয়, বরং পাখি এবং স্তন্যপায়ীরও পূর্বসূরি হিসেবে বিবেচিত অ্যামনিয়োট শ্রেণির উৎপত্তিকে আরও পেছনে নিয়ে যায়। সমুদ্রনির্ভর জীবন থেকে স্থলজ প্রাণীতে রূপান্তরের ইতিহাসে অ্যামনিয়োটরা ছিল গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ, কারণ তারা ছিল প্রথম চার-পায়ের (টেট্রাপড) প্রাণী যারা স্থলে ডিম দিয়ে বংশবিস্তারের উপযোগীভাবে বিবর্তিত হয়েছিল।
এর আগে কানাডায় পাওয়া অ্যামনিয়োট শ্রেণির দেহাবশেষ ও পায়ের ছাপ প্রায় ৩১৮ মিলিয়ন বছর পুরোনো বলে বিবেচিত হতো। কিন্তু ২০২৫ সালের ১৪ মে ‘নেচার’ জার্নালে প্রকাশিত এই নতুন গবেষণা সেই ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, পানিতে থাকা টেট্রাপড থেকে স্থলচারি প্রাণীতে বিবর্তনের রূপান্তর পূর্বে ধারণার চেয়ে অনেক দ্রুত ঘটেছিল।
গবেষণার সহলেখক ও সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পের এরিক আলবার্গ বলেন, “আমি স্তব্ধ। একটি মাত্র শিলাখণ্ড যা একজন মানুষ সহজেই তুলতে পারে আমাদের সব ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করছে, যা আমরা আধুনিক টেট্রাপডের বিবর্তন নিয়ে এতদিন ধরে জানতাম।”
এই ছাপের অবস্থান জানায়, অস্ট্রেলিয়া যা একসময় গন্ডওয়ানাল্যান্ড নামের বিশাল দক্ষিণী মহাদেশের অংশ ছিল হতে পারে প্রাচীন অ্যামনিয়োট ও সরীসৃপের উৎসস্থল। বর্তমান আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, আরব উপদ্বীপ, মাদাগাস্কার, অ্যান্টার্কটিকা ও ভারত তখন একই ভূমিখণ্ডে যুক্ত ছিল।
বিবর্তনের ইতিহাসে নতুন পৃষ্ঠা
ভিক্টোরিয়া প্রদেশের স্নোই প্লেইনস ফর্মেশনে শৌখিন জীবাশ্মবিদ ক্রেইগ ইউরি ও জন ইসন এই শিলাখণ্ডটি খুঁজে পান। এতে দেখা যায়, একই প্রাণীর দুটি আলাদা সেটের পায়ের ছাপ রয়েছে। এগুলোই এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে পুরোনো নখরযুক্ত পায়ের ছাপ।
প্রাণীটির পায়ের গড়ন অনেকটা আধুনিক পানিসাপের মতো। এর আকার পুরোপুরি নিশ্চিত না হলেও গবেষকরা বলছেন, এটি সম্ভবত একটি ছোট গুঁইসাপ বা গোয়ানা জাতীয় প্রাণী ছিল, যার দৈর্ঘ্য ছিল আনুমানিক ৮০ সেন্টিমিটার বা ৩১ ইঞ্চির মতো।
গবেষণার প্রধান লেখক ও ফ্লিন্ডার্স ইউনিভার্সিটির প্যালিয়নটোলজি বিভাগের অধ্যাপক জন লং বলেন, “এটি ছিল এমন একটি প্রাণী, যার নখরগুলি বাঁকানো ছিল,যা সরীসৃপের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এই নখর তাকে মাটি খনন বা গাছে ওঠার সক্ষমতা দিয়েছিল।”
অধ্যাপক আলবার্গ বলেন, এই ছাপ ফেলা প্রাণীটিই এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে প্রাচীন অ্যামনিয়োট ও সরীসৃপ। এটি আধুনিক টেট্রাপডের বিবর্তনের রহস্য উন্মোচনে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হতে পারে।
‘ফিশাপড’ থেকে স্থলজ প্রাণী
অধ্যাপক লং জানান, এই আবিষ্কার ইঙ্গিত দেয়, আধুনিক উভচর প্রাণীর পূর্বপুরুষ ও সরীসৃপ–স্তন্যপায়ী–পাখির পূর্বসূরিরা একে অপর থেকে আরও আগে, সম্ভবত ডেভোনিয়ান যুগে, প্রায় ৩৮০ মিলিয়ন বছর আগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল।
এখন পর্যন্ত ধারণা ছিল, ডেভোনিয়ান যুগে ছিল কেবল মৎস্য সদৃশ প্রাণী বা তথাকথিত ‘ফিশাপড’ যেমন টিকটালিক, যারা সাগর ও স্থলের সংযোগস্থলে সীমিত বিচরণ করত। কিন্তু নতুন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, সে সময়েই স্থলে বসবাসকারী এবং জলে বসবাসকারী উভয় ধরনের টেট্রাপড একসাথে বাস করত এবং ছিল বিভিন্ন আকার ও অভিযোজনের।
অধ্যাপক আলবার্গ বলেন, “আমাদের গবেষণা বলছে, সেই সময়েই টেট্রাপডদের বৈচিত্র্য অনেক বেশি ছিল, এবং তাদের মধ্যে অনেক উন্নত গঠনের জীবও ছিল।”
অধ্যাপক লং বলেন, “জীবন যেভাবে পুরোপুরি জলনির্ভরতা থেকে সরে স্থলভূমিতে চলে আসে, সেটি জীবজগতের বিবর্তনের এক বিরাট ধাপ। অ্যামনিয়োটদের ডিমে শক্ত খোলস থাকার ফলে তারা পানির ওপর নির্ভর না করেই বংশবিস্তার করতে পেরেছিল, এবং এভাবেই স্থলচারি জীবের যাত্রা শুরু হয়।”
অ্যালবার্গ আরও যোগ করেন, “এই বিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ ধাপের অংশ হিসেবে অ্যামনিয়োট ডিমের আবির্ভাব যা সরীসৃপ ও স্তন্যপায়ীর একক পূর্বপুরুষদের মধ্যে দেখা যায় পৃথিবীর ইতিহাস এবং আমাদের নিজস্ব পূর্বপুরুষদের বিবর্তনের গল্পেরও একটি কেন্দ্রবিন্দু।”
অনুসন্ধান এবার দক্ষিণ গোলার্ধে
এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক ও ভার্টেব্রেট প্যালিওনটোলজি সোসাইটির সভাপতি স্টুয়ার্ট সুমিডা বলেন, এই আবিষ্কার অ্যামনিয়োটদের বিবর্তনের সময়কালকে কার্বনিফেরাস যুগের আরও গভীরে নিয়ে যাচ্ছে, যা ২৯৯ থেকে ৩৫৯ মিলিয়ন বছর আগে ছিল। এটি প্রাচীন সরীসৃপদের বিবর্তনে আরও সময় দিতে পারে।
জন লং আরও জানান, তিনি ১৯৮০ সাল থেকে অস্ট্রেলিয়ার ম্যানসফিল্ড এলাকার জীবাশ্ম নিয়ে কাজ করছেন। এখানকার প্রাচীন মাছ ও হাঙরের জীবাশ্ম বহু আগেই বিশ্বখ্যাত। কিন্তু স্থলজ প্রাণীর চিহ্ন পেয়ে গবেষকরা সত্যিকারের এক ‘পবিত্র গ্রেল’ আবিষ্কার করেছেন বলে মনে করছেন।
এর আগে ম্যানসফিল্ড এলাকার একটি জীবাশ্ম থেকেই বিজ্ঞানীরা জেনেছিলেন, কীভাবে প্রাচীন বর্মযুক্ত মাছদের যৌন অঙ্গ বিবর্তিত হয়েছিল। এবার গবেষকরা জানতে চান, গন্ডওয়ানার সেই যুগে এই প্রাচীন সরীসৃপের পাশে আর কী প্রাণী বাস করত।
স্টুয়ার্ট সুমিডা বলেন, “আমরা এতদিন অ্যামনিয়োটদের দেহাবশেষ শুধু উত্তর গোলার্ধের প্রাচীন মহাদেশীয় অংশেই খুঁজেছি। কিন্তু এখন পরিষ্কার, দক্ষিণ গোলার্ধ বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা এবং আফ্রিকায় আরও অনুসন্ধান চালাতে হবে।”
সূত্র:https://tinyurl.com/y5hhjupz
আফরোজা