ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

১৮ বছরে যেসব ভূমিকা রাখছে ইউটিউব

প্রকাশিত: ১৬:২৯, ৩১ মে ২০২৩

১৮ বছরে যেসব ভূমিকা রাখছে ইউটিউব

ইউটিউব

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার সান ডিয়েগো চিড়িয়াখানায় ঘুরতে গিয়ে হাতির দীর্ঘ শুঁড় নিয়ে লাজুক মুখে একটি ভিডিও রেকর্ড করেছিলেন জাওয়াদ করিম নামের এক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তরুণ। হাতির খাঁচার সামনে দাঁড়ানো অবস্থায় মাত্র ১৯ সেকেন্ডের ভিডিওটিতে ওই তরুণ বলছিলেন, এদের সবচেয়ে বড় ব্যাপারটি হচ্ছে- তাদের অনেক দীর্ঘ শুঁড় আছে। তাদের সম্পর্কে মোটামুটি এটাই বলা যায়। 

২০০৫ সালের ২৪ এপ্রিল ভিডিওটি ইউটিউব নামের একটি ওয়েবসাইটে আপলোড করেন জাওয়াদ। তখন কি কেউ ভেবেছিল কী বিশাল ইতিহাসের শুরু হয়েছিল সেদিন! এই ইউটিউব একদিন বিশ্বের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি ও বিনোদনের জগতটাই পুরোপুরি পাল্টে দেবে, সেটি কী কেউ ভেবেছিল!

জাওয়াদ করিম, চ্যাড হার্লি ও স্টিভ চ্যান- এই তিন জন মিলে ইউটিউব প্রতিষ্ঠা করেন। তারা ইন্টারনেটে ভিডিও দেখার প্ল্যাটফর্মের ঘাটতি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। খুব দ্রুত ইউটিউবের জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করে। মাত্র এক বছরের মাথায় ওয়েবসাইটটিতে দৈনিক ২৫ মিলিয়ন ভিডিও প্রদর্শিত হচ্ছিল। আর ১০ বছরের মাথায় ওয়েবসাইটির মাসিক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০০ কোটি ছাড়িয়ে যায়। শখের নির্মাতা থেকে শুরু করে প্রফেশনাল নির্মাতা ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ভিডিও স্থান পাচ্ছে এই প্ল্যাটফর্মে। হাসির, মজার, সামরিক, দুর্ধর্ষ, ভয়ঙ্কর, শিক্ষণীয় থেকে শুরু করে এমন কোনো বিষয় নেই, যে বিষয়ের কোনো ভিডিও ইউটিউবে নেই। 

কম খরচে তৈরি ভিডিওর জনপ্রিয়তা
ইউটিউব প্রমাণ করেছে, দর্শকপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য উচ্চ মানসম্মত ভিডিও হওয়ার প্রয়োজন নেই। ভিডিওর প্রোডাকশন এবং অডিওর পেছনেও অনেক খরচের দরকার নেই। বরং অল্প খরচে কিংবা বিনা খরচে তৈরি ভিডিওগুলোরও অনেক জনপ্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এই ধরনের ভিডিওই ইউটিউবের জন্য উত্তম। 

সাধারণ ও অপেশাদারভাবে তৈরি এসব ভিডিওর যে বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল, ক্যাবল টিভি বা অন্যান্য বড় বড় প্রোডাকশন হাউজের ভিডিওতে তা খুঁজে পাওয়া যেত না। এখনো ক্ষুদ্র নির্মাতারাই ইউটিউবের প্রাণ। অনেক বড় বড় ইউটিউবারও অল্প সংখ্যক কর্মীর সাহায্যে ভিডিও নির্মাণ করছেন। এর পাশাপাশি আছে অপেশাদার ও সৌখিন ইউটিউবার। এরাই ইউটিউবকে জনপ্রিয়তার শিখরে রেখেছে। 

দর্শকরাই ইউটিউবের চালিকাশক্তি
ইউটিউবের জনপ্রিয়তার পেছনে ভিডিও নির্মাতাদের অনেক বড় ভূমিকা আছে সত্যি। এখানে দর্শকরাই শেষ কথা। ইউটিউবে ভিডিও আপলোড করার উদ্দেশ্য একটাই- ভিউ পাওয়া। যত বেশি ভিউ, তত বেশি লাভ। ক্যাবল টিভিতে প্রাইম টাইম স্লট থাকে, যখন সবচেয়ে বেশি দর্শক নির্দিষ্ট টিভি চ্যানেল দেখতে বসেন এবং প্রতিটি অনুষ্ঠানের রেটিং করা হয়। যাতে বোঝা যায় কোন অনুষ্ঠান কত সংখ্যক দর্শক দেখছেন। ইউটিউবের হিসাব অনেক সহজ। ভিডিও আপলোড করার পর দর্শকরা চাইলে যে কোনো সময় সেটি দেখতে পারেন আর ভিডিওর সফলতা নির্ভর করে সেটি কত দর্শক দেখলো আর কত শেয়ার হলো, তার ওপর। ইউটিউবের ভিডিওর দর্শকসংখ্যা জানতেও কোনো রেটিং প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হতে হয় না, ভিডিওর নিচেই ভিউ কাউন্ট থাকে। ফলে নির্মাতাদের পাশাপাশি দর্শকরাও বুঝতে পারেন ভিডিওটি তার আগে কত মানুষ দেখেছেন। 

ইউটিউবের অ্যালগরিগম
২০১০ সালে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্সের ওপর পিএইচডি ডিগ্রিধারী গিউম শালো গুগলে যোগ দেন। তিনি যখন গুগলে যোগ দেন, তখনো জানতেন না তাকে কোন কাজটি করতে হবে। কয়েক দিন পর ইউটিউবের 'রিকমেন্ডেড ভিডিও এঞ্জিন' তৈরি করতে বলা হয় তাকে। 

এই ইঞ্জিনটি মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে দর্শকের পছন্দ-অপছন্দ মূল্যায়ন করতে পারবে এবং একটি ভিডিও দেখা শেষ হলে সেই মূল্যায়ন অনুসারে পরবর্তী ভিডিও দেখার পরামর্শ দেবে। রিকমন্ডেশন এঞ্জিনের উদ্দেশ্য ছিল- ভিডিওর ওয়াচ টাইম বাড়ানো ও দর্শককে যত দীর্ঘ সময় সম্ভব ইউটিউবে আটকে রাখা। 

শালোর মতে, ভিডিওর ভিউর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে- ওয়াচ টাইম। একটি ভিডিও যত বেশি দৈর্ঘ্য পর্যন্ত দেখা হবে, সেটির এনগেইজমেন্ট তত বেশি হবে এবং সেই ভিডিও থেকে আয়ও তত বেশি হবে।

মেরুকরণ ও চরমপন্থা
আপনি যদি প্র্যাংক ভিডিও, কোনো কিছু করতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়ার ভিডিও কিংবা মাতাল লোকদের পুলিশের হাতে আটক হওয়ার ভিডিও দেখতে থাকেন, তাহলে ইউটিউবের অ্যালগরিদম অনুরূপ অসংখ্য ভিডিও আপনার ফিডে দিতেই থাকবে। কিন্তু এ কাজে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স যুক্ত করার পর এটি এখন ভিন্ন উচ্চতায় পৌঁছেছে। যা কখনো কখনো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। ইউটিউবের অ্যালগরিদম ভিডিওর দৃষ্টিভঙ্গিকেও আমলে নিচ্ছে এবং সে অনুসারে ভিডিও দেখার পরামর্শ দিচ্ছে। 

নেতিবাচকতা রুখতে গুগল কী করছে
ইউটিউবের নেতিবাচক প্রভাবগুলো রুখতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে গুগল। সংস্থাটি একটি বিশ্বস্ত 'ফ্ল্যাগার প্রোগ্রাম' চালু করেছে- যার মাধ্যমে বাছাইকৃত দর্শকরা কোনো ভিডিওর বিষয়বস্তু অনপুযুক্ত মনে করলে সে সম্পর্কে গুগলকে সতর্ক করতে পারে। আবার কোনো ভিডিওর বিষয়বস্তু যদি ধর্মীয় বা শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের অনুভূতিতে আঘাত হানার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে ভিডিও শুরুতেই সে সম্পর্কে সতর্ক বার্তা দেওয়া হয়। 

আয়ের নতুন উৎস
ইউটিউব সবার জন্য বাড়তি আয়ের উৎসে পরিণত হয়েছে। এটি এই প্ল্যাটফর্মের অন্যতম বড় ইতিবাচক ব্যাপার। মিউজিশিয়ান, রিভিউয়ার, কমেডিয়ান, প্র্যাংস্টার, অটো মেকানিকস- সবাই ইউটিউবে ভিডিও আপলোড করে বাড়তি অর্থ আয় করছে। 

রাজনীতিতে প্রভাব
রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাহীনদের হাতে ক্ষমতা দিয়েছে ইউটিউব। সরকারের কোনো দুর্নীতি ও দায়িত্ব পালনে অবহেলার ঘটনা সাধারণ মানুষ এখন ইউটিউবের মাধ্যমে প্রকাশের সুযোগ পাচ্ছে। যেসব দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত, সেসব দেশে সরকারবিরোধীদের মতামত প্রচারে ইউটিউব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ২০১২ সালে রাশিয়ার নারীবাদী আন্দোলন প্ল্যাটফর্ম পুসি রায়টের কর্মীরা প্রেসিডেন্ট পুতিনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছিলেন। এই ভিডিও ইউটিউবের মাধ্যমে সবাই দেখেছে। 

রাশিয়ার বিরোধী নেতা অ্যালেক্সি নাভালনি পুতিনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দুর্নীতির তথ্য প্রমাণও ইউটিউবেই প্রকাশ করছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প, ব্রজিলের জাইর বলসোনারোর মতো অতি ডানপন্থী নেতাদের অবির্ভাবেও ইউটিউবের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলো ভূমিকা রেখেছে। 

ক্ষতির চেয়ে ইউটিউবে লাভই বেশি। বিভিন্ন চ্যারিটি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান ইউটিউবের মাধ্যমে এবং এখান থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে নানা ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়, যা বিশ্বের সার্বিক মঙ্গলে কাজে আসে।  

শিক্ষাখাতে ইউটিউব
খান একাডেমির নাম আমরা অনেকেই জানি। অর্থনীতি, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত ও বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলো সহজে বোঝানো হয় খান একাডেমির ভিডিওতে। ভিডিওগুলো মূলত ইউটিউবেই আপলোড করা হয়। বিশ্বের যেকোনো একাডেমিক বিষয়ের ওপর সহজবোধ্য ভাষায় বিশেষজ্ঞদের লেকচার পাওয়া যায় ইউটিউবে। ফলে কোনো কিছু শেখা এখন অনেক সহজ হয়ে গেছে। ইউটিউবে নানা বিষয়ের ওপর লাখ লাখ টিউটোরিয়াল আছে, যেগুলো দেখে মানুষ সহজেই সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারে। 

যেভাবে শুরু
২০০৫ সালের ভ্যালেন্টাইনস ডে'র দিন www.youtube.com ডোমেইন চালু করেন জাওয়াদ করিম, চ্যাড হার্লি ও স্টিভ চ্যান। কিংবদন্তি অনুসারে, এই ৩ জন 'টিউন ইন, হুক আপ' নামে একটি অনলাইন ডেটিং পরিষেবা তৈরি করার পরিকল্পনা করেছিলেন, কিন্তু সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। 

কিন্তু পেপ্যালের এই ৩ কর্মী মিলে যে সাইটটি তৈরি করেছিলেন, তা ব্যক্তিগত বিভিন্ন অভিজ্ঞতার ভিডিও সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করার জন্য যথেষ্ঠ। বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত- যেমন ২০০৪ সালে ভারত মহাসাগরে যে ভয়াবহ সুনামি হয়েছিল কিংবা ২০০৪ সালে সুপার বোলের মাঝবিরতির অনুষ্ঠানে জ্যানেট জ্যাকসনের সেই বিখ্যাত ওয়্যারড্রোব ম্যালফাংশনের কোনো ভিডিও কেউ দেখতে চাইলে তখন সম্ভব ছিল না। এই ৩ উদ্যোক্তা ভাবলেন, তারা এমন একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করবেন, যেখানে যে কেউ সহজেই যেকোনো ভিডিও আপলোড করতে পারবে এবং দেখতে পারবে। 

ইউটিউবের সফলতার মূল কারিগর তরুণরা, যাদের নিজেদের জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ভিডিও আকারে সারা দুনিয়ার সঙ্গে শেয়ারে কোনো সমস্যা নেই। যে কেউ যেকোনো সময় চাইলে যেকোনো বিষয়ের ওপর ভিডিও আপলোড দিতে পারে। যদিও এর ইতিবাচক দিকের সঙ্গে কিছু নেতিবাচকত দিকও আছে। 

এ বছর ইউটিউবের বয়স ১৮ হলো। ইউটিউবকে অবিশ্বাস্য প্রভাবশালী বললেও অনেক কম বলা হয়। ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মটি কীভাবে সারা দুনিয়াকে চিরতরে বদলে দিয়েছে, তা দেখব এই লেখায়। 

মিউজিক শিল্পে রাতারাতি পরিবর্তন
১৩ বছর বয়সী জাস্টিন বিবারের খালি গলায় গাওয়া একটি গানের ভিডিও তার মা ইউটিউবে আপলোড করার পরই সারা বিশ্ব এই খুদে সংগীত শিল্পীর কণ্ঠের জাদু সম্পর্কে জানতে পারে। এর মাত্র ৩ বছরের মাথায় ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে বিবারের কনসার্টের সব টিকিট কয়েক মিনিটের মধ্যে বিক্রি হয়ে যায়। অল্প সময়ের মধ্যে বিবারের অকল্পনীয় জনপ্রিয়তা, দর্শক-শ্রোতাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ প্রমাণ করে মিউজিক শিল্পে ইউটিউবের প্রভাব কতটা দৃঢ় হতে পারে। 

মুহূর্তের মধ্যে সারা বিশ্বের মানুষ তাদের গান শুনতে পারছেন। শিল্পীরাও সরাসরি তাদের শ্রোতা দর্শকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারছেন। ইউটিউব আসার আগে এমন চিত্র কল্পনাই করা যেত না। রেকর্ড লেবেলগুলো নিজেদের শিল্পীদের নিয়ে যে 'কুল ক্লাব' তৈরি করেছিল, ইউটিউবের প্রভাবে তা হাওয়ায় উড়ে গেছে। 

বড় বড় বিনোদন কনটেন্ট নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন যে নিজেদের স্ট্রিমিং সার্ভিস চালু করছে, সেখানেও ইউটিউবের প্রভাব আছে। যেমন- এনবিসি আগে তাদের কনটেন্টগুলো ইউটিউবে প্রকাশ করতো। কিন্তু পরে তারা তাদের ইউটিউব চ্যানেলটি বন্ধ করে দিয়ে হুলু নামের নতুন স্ট্রিমিং সার্ভিস চালু করে। 

আমাদের পপুলার কালচারকে ইউটিউব যেভাবে প্রভাবিত করেছে, সেটি আর কোনো মাধ্যম পারেনি। 

সংবাদের উৎস
ইউটিউব এখন সংবাদের বড় উৎস হয়ে উঠেছে। অনেক সাংবাদিক গতানুগতিক সংবাদপ্রতিষ্ঠানের চাকরি ছেড়ে ইউটিউবের মাধ্যমে ফ্রিল্যান্স জার্নালিজম করছেন। ২০১২ সালে মার্কিন থিংক ট্যাংক পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ইউটিউবে যত কিছু সার্চ করা হয়, তার মধ্যে সংবাদ অন্যতম। সিটিজেন জার্নালিজম জনপ্রিয়তা পেয়েছে ইউটিউবের সৌজন্যে। 

এর বাইরেও ব্যবসা, বিজ্ঞাপন, প্রযুক্তি শিল্পের বিকাশ, অর্থনতি, কমিউনিটি তৈরি, সমাজ সংস্কার ইত্যাদি নানা খাতকে চিরতরে বদলে দিয়েছে ইউটিউব। 

সূত্র: রিডার্স ডাইজেস্ট, আল জাজিরা, আইবিসি, ডিজিটাল ট্রেন্ডস

 

এসআর

×