ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০১ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২

ঝর ঝর মুখর বাদর দিনে

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ১৮:৪৫, ১ জুলাই ২০২৫

ঝর ঝর মুখর বাদর দিনে

ঋতু বৈচিত্র্যের আবহমান বাংলা ধনে ধান্যে পুষ্পে ভরা সুরম্য প্রকৃতির লীলাভূমি। এখন ভরা বর্ষার বারিধারায় সারাদেশ বৃষ্টি ভেজা প্রতিবেশকে সামলাতে ব্যস্ত। তবে চিরায়ত বাংলায় নিসর্গ যেমন উদার হস্তে অবারিত দানে কোলের সন্তানদের ভরিয়ে দেয় তাও এই বরেন্দ্র অঞ্চলের অনন্য শৌর্য। আবার বিপরীত পরিবেশে ভাঙনের খেলায় মেতে ওঠাও বিপর্যয়কে সম্মুখ সমরে মোকাবিলা করা। সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে সংশ্লিষ্ট মানুষরা যখন অসহায়ের মতো বিপদ-বিপর্যয়কে সামলিয়ে নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে সেটাও এই অঞ্চলের লড়াকু অভিযাত্রা। যুগ-যুগান্তরের এমন বিধি নিয়মকে মেনেই বরেন্দ্র অঞ্চলের অধিবাসীদের চিরন্তন সামনে এগিয়ে যাওয়ার এক দৃঢ় প্রত্যয়। আষাঢ় মাসের অর্ধেক সময় পার হয়ে গেলেও বর্ষাকাল পুনরায় শ্রাবণের ধারায় জনগণকে ব্যাকুল করে দেয়। তাই বর্ষাস্নাত শাশ্বত বাংলার এক অনন্য রূপশৌর্য। যেখানে কবি-সাহিত্যিক সৃজন বোদ্ধারা সৃষ্টির প্রেরণায় নতুন কিছু উপহার দেওয়া পরিস্থিতির ন্যায্যতা। কিন্তু জলসিঞ্চিত বারিধারায় মাঠ, ঘাট থেকে ফসলি খেত পরিপূর্ণ হয়ে প্লাবনের যে দুরবস্থা তৈরি করে তাও অঞ্চলবাসীর বর্ষাকালীন বিপন্নতা। তার পরও জনগোষ্ঠী প্রাকৃতিক সম্ভার আর সংহারকে জীবনের সঙ্গে এক সুতায় গেঁথেও নেয়। আষাঢ়ের পর বর্ষার আর এক রূপ শ্রাবণের ঘনঘোর মেঘ বার বরির্ষণ। তবে বাংলাদেশের সিংহভাগ এখনো গ্রামীণ অঞ্চলের অনন্য পরিবেশ। বৃষ্টিপাতের নিরন্তর ধারায় পল্লি জননীর যে বেহাল দশা তাও চিরায়ত বর্ষার বিপরীত প্রদাহ। কৃষি নির্ভর আবহবান বাংলা কিন্তু উর্বর পলিমাটির এক অনন্ত সিক্ততার বহুমাত্রিক আবেদন বলাই যায়। বর্ষণের অবিশ্রান্ত জলধারা শান্তির প্রলেপ বুলানো এক পরম আবেগঘন অনুভবও বটে, যা শুধু ভাবুক হৃদয়কেই চঞ্চল করে না বরং সর্ব মানুষের অন্তর নিঃসৃত আকুলতাকেও নবোদ্যোমে জাগিয়ে তোলে। অবিরাম বৃষ্টির ধারায় পথ-ঘাট পানিতে ডুবু ডুবু অবস্থায় পড়ে যায়। উন্নয়নের অভিগামিতায় হরেক জঞ্জালও আধুনিক নগর-শহর ব্যবস্থাপনায় ভিন্ন মাত্রায় দুর্ভোগ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর দুর্ভোগ নাকাল হয় সংশ্লিষ্ট অধিবাসীরা। পানিবন্দি অবস্থায় মানুষের যে ভোগান্তি সেটাও ঝর ঝর বারিধারায় আর এক বিপত্তি তো বটেই। সংশ্লিষ্ট জেলা-উপজেলায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে অবিরাম জলস্রোতের যে ঢল নামে তাতে সাধারণ মানুষের বিপন্নতা আর বিরূপ প্রতিবেশের শিকার হওয়াও উদ্ভূত পরিস্থিতির বিপরীত স্রোত। প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষের বসতবাড়ি থেকে ফসলি জমি পানির নিচে তলিয়ে যাওয়া শস্য শ্যামল বাংলার  ঋতুচক্রের নির্মল লীলা খেলা। আর এমন দুর্বিপাক সহজেই শেষ হয় না। নদী ও সমুদ্র উপকূলবর্তী জেলা- উপজেলায় শুধু বর্ষার ঢল নয় নদ-নদীর পানি উপচেপড়ে সংশ্লিষ্ট অঞ্চল ভাসিয়ে নেওয়া আর এক বিপদ দুরাবস্থার আবর্তে পড়ে যাওয়া। 
এরই মধ্যে চলছে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। সময়মতো পরীক্ষা হলে অনুপ্রবেশ আর এক ঝঁক্কি-ঝামেলা তো বটেই। বিশেষ করে যানজটের শহর ঢাকা। যেখানে সামান্য বৃষ্টিতে যানজাটের আশঙ্কা যাত্রীদের ভাবিয়ে তোলে। সেখানে পরীক্ষার সময় বিবেচনায় পথ-ঘাটের দুরবস্থাও শিক্ষার্থীদের ভাবিয়ে তোলার আর এক বিপন্নকাল তো বটেই। সিংহভাগ গ্রামাঞ্চলের পরীক্ষার্থীরা সময় মতো হলে পৌঁছানো নিয়েও দুরস্থায় পড়ে যায়। বৃষ্টিভেজা স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে এমনিতেই সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীরা যাত্রাপথে বিপৎসঙ্কুল রাস্তা পার হয়ে যেতে হয়। তেমন দুর্ভোগ পথেই শিক্ষার্থীর মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হতে সময় লাগে না। পরীক্ষার সময় সব শিক্ষার্থীই বিব্রতকর অবস্থায় সময় পার করে। তার মধ্যে বর্ষার প্লাবনে যদি শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর চাপ তৈরি হয় সেটাও বৃষ্টির বিপরীত প্রদাহ বলাই যায়। বর্ষার লাগাতার বৃষ্টি যেভাবে পরিবেশ পরিস্থিতিকে নাজেহাল করে সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো আর এক যাতনা তো বটেই। বর্ষার বারিধারা চোখের নিমিষে অনেক কিছু শেষ হতে সময় লাগে না। কিন্তু ভাঙনের পর নতুন করে পুনরায় তৈরি হতে কত যে কাঠ, খড় পোড়াতে হয় তা শুধু ভুক্তভোগীরাই জানে। তার পরও প্রতি বছর আষাঢ়-শ্রাবণ আসে তার চিরায়ত আবেদন নিবেদনে কোলের সন্তানদের মাতিয়ে দিতে। প্রচণ্ড খরা আর কাঠফাটা রোদে জনগোষ্ঠী যখন নিতান্ত দগ্ধ হয় তখন সমন্বয়ে মানুষের কণ্ঠ ভেসে আসেÑ ‘আল্লা মেঘ দে, পানি দে।’ আবার তেমন মেঘ পানির নিরন্তর ধারায় জনগোষ্ঠীর যে অস্থিরতা সেটাও উপকূলীয় অঞ্চলের আর এক বিষাদঘন দুরবস্থা। আমরা এখন বর্ষণশ্রান্ত তেমন ঋতুকে অবগাহন করে শ্রাবণের অশ্রান্ত বৃষ্টিকে আমন্ত্রণ জানাতে আবার অপেক্ষার প্রহর গুনি। গ্রীষ্মের তাপপ্রবাহে যখন গণমানুষের জীবন অতিষ্ঠ, ফসলি খেত যেমন পানির অভাবে দৈন্যদশায় তেমন দুঃসময়ে বৃষ্টির বারিধারা যেন প্রকৃতির এক অনন্য শীতল ছোঁয়ায় যে স্বস্তি আর তৃপ্তি সেটাও এই বরেন্দ্র অঞ্চলের অভাবনীয় সম্ভার। পাহাড় কেটে সবুজ প্রকৃতিকে নয়-ছয় করা আর বৃক্ষ-নিধন কর্মে যুক্ত হয়ে অত্যাধুনিক ইমারত নির্মাণ তার দাম নৈসর্গই সুদে আসলে তুলে নিচ্ছে। প্রকৃতি-বিশারদরা তেমন ধারণাই দিচ্ছেন উদ্ভূত পরিস্থিতির নির্মমতায়। যা বলা হচ্ছে যেন প্রকৃতির প্রতিশোধই। নির্মম নৈসর্গকে নির্মমতার বেষ্টনী দিচ্ছে প্রকৃতির কোলে লালিত সন্তানরাই। তার ওপর পাহাড় কেটে অত্যাধুনিক দালান কোটা নির্মাণ করা আর এক বিধ্বংসী বাতাবরণ। সেটা স্বচ্ছ প্রকৃতিতে আর এক অভিশাপ। বলা হচ্ছে। উপরের আসনে বসা ব্যবসায়িক গোষ্ঠী পাহাড় কেটে নিসর্গের ওপর যে বিপরীত পরিস্থিতি তৈরি করে তার ফল ভোগ করে অতি সাধারণ নিম্নবিত্তের মানুষ। যাদের ননু আনতে পান্তা ফুরায়। 
আষাঢ়-শ্রাবণের বর্ষণধারা প্রত্যাশিত এক প্রকৃতির পরম উপহার। আবার প্লাবনের নির্মমতায় যখন একূল ও কূল ভাসিয়ে নেয়া তাও অঞ্চলবাসীকেই চরম দুর্গতির দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। আবার নির্মল সবুজ প্রকৃতি ঘেরা আবহমান বাংলা তার আপন শৌর্যে টিকিয়ে থাকাও অঞ্চলগত ঐতিহ্যের পরম বরমাল্য। 
১৮ কোটি জনসংখ্যা অতিক্রম করা আমাদের এই ক্ষুদ্র বাংলাদেশ। সে মাত্রায় জায়গা-জমি বাড়েনি। বরং আধুনিকতার নিত্য নতুন বৈভবে কমেছে জমি আর পতিত অনেক পরিসর। ভারি বৃষ্টি আর জোয়ার ছাড়াও পূর্ণিমা চাঁদের প্রভাবে উত্তাল হওয়া নদ-নদীও পানির স্রোতকে আরও বেগবান করে দেয়। সত্যিই অপূর্ব এই ক্ষুদ্র অস্ট্রিক জাতির বাংলাদেশ। আবার বিপরীত স্রোত সামলানোও ঝক্কি-ঝামেলার নিরন্তর দুর্ভোগ, আর উন্নয়ন পরিকল্পনায় যথার্থ কর্মযোগে হরেক গরমিলও উঠে আসে। তা দেশের জন্য স্বস্তিদায়ক হয় না। বিশেষ করে গত ১৬ বছরের একদলীয় দুঃশাসন সারা বাংলাদেশের কষ্টার্জিত অর্থের অপচয়ই শুধু নয়, বরং মূল কাঠামোগত শক্ত অবস্থানকেও নড়বড়ে করে দেয়। যার দাম গুনতে হচ্ছে বদলে যাওয়া নতুন বাংলাদেশের নবতর আঙিনায়। তবে দুঃসময় যেমন যাত্রাপথকে বিলম্বিত করে পাশাপাশি পরিচ্ছন্ন প্রতিবেশও সব আবর্জনা ধুয়ে-মুছে সাফ করে দেয়। আমরা আশা করছি বদলে যাওয়া আজকের বাংলাদেশ হরেক দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে আগামীর প্রজন্মকে নব সম্ভাবনায় উদ্দীপ্ত করতে আলোকের ঝর্ণাধারা বর্ষিত করবে, তেমন নতুন বাংলাদেশকে বরণ করতে প্রস্তুতি গ্রহণই শুধু নয় স্বচ্ছ আর সততার সঙ্গে যৌক্তিক কর্মযোগে এগিয়ে যাওয়াও পরিস্থিতির ন্যায্যতা। নতুন ও যৌক্তিক বাংলাদেশ সময়ের অভিগামিতায় আরও সামনের দিকে নিয়তই ধাবমান হবে তেমন অপেক্ষায় ১৮ কোটি মানুষের জনবহুল এই দেশ। জনসংখ্যা শুধু ভার নয় বরং শক্তি হিসেবেই এগিয়ে যাবে।

প্যানেল

×