
ছবি: সংগৃহীত
মধ্যপ্রাচ্যের আকাশ যেন সোমবার (২৩ জুন) মধ্যরাতে হঠাৎ করেই প্রতিশোধের আগুনে লাল হয়ে উঠল। রাতটা যেন সত্যিই ছিল মার্কিন সেনাদের জন্য এক দুঃস্বপ্ন! ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার জবাবে বিভিন্ন মার্কিন ঘাঁটিতে পাল্টা একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে গোটা বিশ্বকে চমকে দিল ইরান। যুদ্ধের মাঠে এই সাহসী জবাব শুধু আঘাত নয়, ছিল এক স্পষ্ট বার্তা— অন্যায়ের জবাব তারা দেবে, মর্যাদার প্রশ্নে একচুলও ছাড় দেবে না।
এই রাতে ইরান সরাসরি আক্রমণ চালায় কাতারে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বিদেশি সামরিক ঘাঁটি ‘আল উদেইদ’- এ। ১৯টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হয় এই ঘাঁটিতে, যেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্র তার পুরো মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। প্রায় ১০ হাজার মার্কিন সেনা, শতাধিক যুদ্ধবিমান ও ড্রোন রয়েছে এই ঘাঁটিতে। এই জায়গাটিতেই এত বড় আঘাত নিঃসন্দেহে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
যুক্তরাষ্ট্র ও কাতারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় যে, অধিকাংশ ক্ষেপণাস্ত্র আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ধ্বংস করা সম্ভব হয়েছে এবং বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কিন্তু মূল প্রশ্ন সেখানে নয়। বাস্তবতা হলো— ইরান চুপ করে বসে থাকেনি, বরং সরাসরি দেখিয়ে দিয়েছে, নিজেদের ভূখণ্ডে হামলা হলে তারা নিশ্চুপ থাকবে না।
এদিকে, মঙ্গলবার (২৪ জুন) ভোররাতে হামলা হয় ইরাকেরও অন্তত দুটি মার্কিন ঘাঁটিতে— ইমাম আলী এবং বালাদ সেনাঘাঁটি। যদিও এসব হামলার দায় কেউ প্রকাশ্যে স্বীকার করেনি, তবুও ঘটনাগুলোর ধরন ছিল অত্যন্ত সংগঠিত ও সমন্বিত। প্রতিরোধ কেবল প্রতিশোধ নয়, বরং ছিল সুপরিকল্পিত একটি কৌশল।
বিশ্লেষকদের মতে, ইরান শুধু সামরিক শক্তি নয়, কূটনৈতিক পরিপক্বতারও পরিচয় দিয়েছে। কারণ হামলার আগে ইরান কাতার সরকারকে অবহিত করে, যেন তারা নিরাপত্তামূলক প্রস্তুতি নিতে পারে। এতে বোঝা যায়, ইরান যুক্তরাষ্ট্রকে লক্ষ্য করলেও কাতারের সার্বভৌমত্বকে সম্মান করেছে।
এই ঘটনার পর থেকেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানারকম প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। পশ্চিমা কিছু গণমাধ্যম যেখানে ঘটনাটিকে ‘আক্রমণ’ হিসেবে দেখিয়েছে, সেখানে অনেক সাধারণ মানুষ ও বিশ্লেষক এটিকে বলছেন ‘ন্যায়সঙ্গত প্রতিরোধ’। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে ইরানের সাহস, কৌশল ও সময়জ্ঞান নিয়ে প্রশংসা। অনেকেই বলছেন, ইরান এমন একটি বার্তা দিয়েছে যা এত সহজে মুছে যাবে না।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি স্পষ্ট করে দিয়েছেন, ইরান যুদ্ধ চায় না, ধ্বংসও চায় না। তবে ইসরায়েল যদি আগ্রাসন চালিয়ে যায়, ইরানও থেমে থাকবে না। এই বার্তায় স্পষ্ট— আত্মরক্ষাই ইরানের লক্ষ্য, কিন্তু মর্যাদার প্রশ্নে তারা কখনোই মাথা নত করবে না।
সব মিলিয়ে এই রাত তাই কেবল একটি সামরিক সংঘর্ষের মুহূর্ত নয়, এটি ছিল প্রতিরোধের প্রতীক, এক সাহসী সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন। যুক্তরাষ্ট্রের বহু প্রচারিত “সুরক্ষিত ঘাঁটি” কেঁপে উঠেছিল এক রাষ্ট্রের আত্মমর্যাদার উত্তপ্ত জবাবে।
এখন প্রশ্ন উঠেছে— এই ঘটনার পর মধ্যপ্রাচ্য কি নতুন এক বাস্তবতার দিকে এগোচ্ছে? যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি আগ্রাসনের জন্য থাকবে জবাব এবং প্রতিরোধই হবে নতুন কূটনৈতিক ভাষা?
ইরান হয়তো সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়েই দিয়েছে— তারা যুদ্ধ চায় না, কিন্তু অন্যায় সহ্য করবে না। আর সেই ঘোষণাই মধ্যরাতে আকাশ কাঁপিয়ে গোটা বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছে, সাহসের ভাষা আজও টিকে আছে।
লেখক: সাংবাদিক
এম.কে.