ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৪ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২

যুদ্ধে স্বয়ংক্রিয় বুদ্ধিযুক্ত সমরাস্ত্র

আনিসুর রহমান এরশাদ

প্রকাশিত: ২০:৫৩, ২৩ জুন ২০২৫

যুদ্ধে স্বয়ংক্রিয় বুদ্ধিযুক্ত সমরাস্ত্র

আকাশে উড়ন্ত ড্রোনগুলো চালকহীন

মানুষের ভবিষ্যৎ কী চলে যাচ্ছে মেশিনের হাতে? আকাশে উড়ন্ত ড্রোনগুলো চালকহীন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাযুক্ত সমরাস্ত্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে শত্রু খোঁজে, স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয় কে বাঁচবে, কাকে কীভাবে মারবে সে উপায় বা কৌশলও ঠিক করে নেয় পরিস্থিতির আলোকে। যুদ্ধ যেন শুধু ইসরাইল-ইরানে সীমাবদ্ধ নয়।

এমন এক নতুন পৃথিবীর নক্সা হচ্ছে যেখানে যুদ্ধ বিমান চালাবে না মানুষ, লড়বে রোবট সেনা। স্বয়ংক্রিয় বুদ্ধিজ্ঞানচালিত অস্ত্র ও কৌশল ব্যবহারে শুরু নতুন অধ্যায়ে ভয়ংকর ভবিষ্যতের দরজায় দাঁড়িয়ে বিশ্ববাসী। এমতাবস্থায় উপযুক্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কোনো দেশ কতটুকু যথাযথভাবে প্রস্তুত?
ইরান-ইসরাইল যুদ্ধে বেশি কাজ করছে স্বয়ংক্রিয় বুদ্ধিমত্তা, যা বিপজ্জনক বাস্তবতা। চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধে রকেট-ড্রোন, কামান-ট্যাংক, যুদ্ধজাহাজ আর ক্ষেপণাস্ত্রই যথেষ্ট নয়। এখন অস্ত্র মানেই ড্রোন, অ্যালগরিদম, কোড আর কম্পিউটার। যুদ্ধ এখন শুধুই রক্তের খেলা নয়, ডেটার খেলা, প্রযুক্তির খেলা। অপারেশন রাইজিং লায়নে স্যাটেলাইট ইমেজ, স্মার্টফোনে ট্র্যাকিং ও গভীর ডিপ লার্নিং মডেল কাজে লাগিয়েছে ইসরাইল। সোয়ার্ম ড্রোনগুলি সীমান্ত পেরিয়ে গোপনে ইরানে ঢুকে নিজেরাই লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিত করে একের পর এক হামলা করেছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) সিস্টেমগুলো রাডার ও কমান্ড চেইন ধ্বংস করেছে। 
ইরান ব্যবহার করেছে কুদস মুহাজির-টেন ও আরাশ-টু নামের স্বয়ংক্রিয় যুদ্ধ ড্রোন, ইসরাইল ব্যবহার করছে উইংম্যান ড্রোন: ঘোস্ট ব্যাট। ১৩ জুন এর পর থেকে ‘শীতল যুদ্ধ’ আর শীতল নেই! মাটির নিচে গোপন ঘাঁটি, মহাকাশ থেকে নিরীক্ষণ, যুদ্ধবিমানকে ড্রোনের সহায়তা প্রদান—সবই আজ সত্যি।

স্পাইডারওয়েভ ও দ্য গসপেল নামের পেছনে লুকিয়ে আছে যুদ্ধের নতুন বাস্তবতা, যাদের ঠান্ডা মাথায় কাজ জাতীয় নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও ভবিষ্যৎ সংঘাতের মানচিত্রই বদলে দিচ্ছে। অপারেশন স্পাইডারওয়েভে সস্তা এআই গাইডেড ড্রোন ব্যবহার সাশ্রয়ী তবে কার্যকরী প্রমাণিত হয়েছে। ইসরাইলের স্টার্টআপ এক্সটেন্ড দ্রুত এআই ড্রোন উন্নত করতে পারছে।
যেখানে মানুষের হাতেই রিমোট নেই, সেখানে মানবিক বোধের জায়গাও নেই। মেশিন যখন ঠিক করে কে শত্রু, কে নয়- তখন রক্তপাততো হবেই। এআই যদি নির্ধারণ করে কে ‘সন্ত্রাসী’ আর কে নিরীহ ধ্বংসযজ্ঞ সেখানে অবশ্যম্ভাবী। ইসরাইলের টার্গেটিং সফটওয়্যার ‘ল্যাভেন্ডার’ টার্গেট সিলেকশনে ও অ্যালগরিদমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে; মাত্র ২০ সেকেন্ডে লাখো মানুষের তথ্য বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কে মারা পড়বে।

ব্যক্তিগত তথ্য-গোপনীয়তা এআই ভিত্তিক টার্গেটিংয়ের ফলে চরমভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। এই ধরনের অদৃশ্য দানবের জবাবদিহিতাও নেই। বুদ্ধিমান অস্ত্র দ্বারা আগ্রাসনে হাসপাতাল ও স্কুলে আঘাতের নৈতিক দায়ভার কার? নিরীহ বাচ্চা, বৃদ্ধ বা নারীর ওপর ভুলভাবে হামলা চালালেও এআইতো দায়িত্ব নেবে না! অথচ সৈন্যবিহীন যুদ্ধে একটি ল্যাপটপের সামনে বসে থাকা এআই ইঞ্জিনিয়ারই হতে পারে লাখো মানুষের মৃত্যু ও ধ্বংসের কারণ। 
এআই সিস্টেমের ‘ব্ল্যাক বক্স’ সিদ্ধান্তপ্রক্রিয়া চোখের আড়ালে হওয়ায় এবং তা নিয়ন্ত্রণ করার উপায় না থাকায় এতে গভীর উদ্বেগ ও ভয় পাওয়ার কারণ আছে! এআই-তে ব্যবহৃত অ্যালগরিদমের পক্ষপাতিত্ব, ভুল তথ্য, ব্ল্যাক বক্স সিদ্ধান্ত। এসব মানবাধিকারের জন্য হুমকি। এআই মানুষের জীবন-মৃত্যুর সিদ্ধান্ত নিলে তা মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনের সরাসরি লঙ্ঘন। যুদ্ধ দূরের ইরান-ইসরাইলের হলেও বাংলাদেশের জন্যও চিন্তার! কারণ কখনো যুদ্ধের আগুন উপসাগর অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লে মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় ৮০ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিকের জীবন ও রেমিট্যান্স।

উভয়ই বিপন্ন হতে পারে। হরমুজ প্রণালির আশপাশে শিপিংয়ে বিঘ্ন সৃষ্টি হওয়ায় বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি পাবে। জ্বালানি ব্যয়ে বড় ধাক্কার প্রভাব সরাসরি পড়বে আমাদের বাজারে, পণ্যের দাম, পরিবহন খরচে; এমনকি খাদ্যসামগ্রী-চাল-ডালের দামেও! যা অভ্যন্তরীণ চাপ সৃষ্টি করে। আসলে বর্তমান সময়ে যেকোনো সাইবার বা এআই চালিত আক্রমণ হলে তা প্রতিহত করার প্রস্তুতি সকল রাষ্ট্রেরই থাকা উচিত।
যুদ্ধ যদি হয় ন্যায় প্রতিষ্ঠার চেয়ে প্রযুক্তির দম্ভের সেখানে কারোরই ঘুমিয়ে থাকার সুযোগ নেই! প্রতিটি দেশকেই এই পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিতে হবে। সাইবারস্পেসে নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিতকরণে সরকারকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ব্যবহারে নীতিমালা ও মূল্যবোধভিত্তিক আইন প্রণয়ন করতে হবে। জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থায় এআই ও সাইবার প্রতিরক্ষা কৌশল অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো, ব্যাংকিং বা সেনাবাহিনীর ওপর সাইবার হামলার ঝুঁকি কমাতে সাইবার সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। ডাটা প্রাইভেসির বিষয়ে অবস্থান তৈরি করতে হবে।

যুদ্ধের সময় দ্রুত প্রবাসীদের রক্ষা ও ফিরিয়ে আনতে নিরাপত্তা পরিকল্পনা ও কৌশল থাকতে হবে; যাতে প্রয়োজনে দ্রুত অপারেশন টিম প্রস্তুত করা যায়। যুদ্ধ বন্ধে ও এআই অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণে জাতিসংঘ ও ওআইসি প্লাটফর্মের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে কণ্ঠস্বর উঁচু করতে শান্তি ও যুদ্ধবিরোধী উদ্যোগে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক আইনের কাঠামোতে এন্টিসিপেটরি সেলফ ডিফেন্স তথা পূর্বাভাসমূলক-প্রতিরোধমূলক-আগাম আত্মরক্ষা বৈধ কি না, তা স্পষ্ট করা দরকার।

তেহরান, তেলআবিব, কিংবা গাজায় যুদ্ধের মাঠে না থেকেও দেশে দেশে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষ। পুরো বিশ্বজুড়ে বাজারে, পরিবারের রেমিট্যান্সে, ভবিষ্যতের প্রযুক্তিতে- এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এই যখন যুদ্ধের ময়দানে তখন প্রস্তুতির সিদ্ধান্ত না নিয়ে আগামীর রক্তাক্ত প্রযুক্তি যুদ্ধে মেশিন হামলায় জীবনাবসানের অপেক্ষা করা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। এক অদৃশ্য প্রযুক্তি যুদ্ধে এআই এর হত্যাকে নৈতিকতার চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে দেখা মনুষ্যত্বের পরীক্ষায় ফেল করা।  প্রযুক্তিকে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে হলে ভবিষ্যতে স্বাধীনতা ও সংহতির মূল্য প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
লেখক : সাংবাদিক

×