ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ জুন ২০২৫, ৯ আষাঢ় ১৪৩২

যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের হাতে দুই দশকে লণ্ডভণ্ড গোটা মধ্যপ্রাচ্য!

মেহেদী কাউসার

প্রকাশিত: ১১:০৮, ২৩ জুন ২০২৫

যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের হাতে দুই দশকে লণ্ডভণ্ড গোটা মধ্যপ্রাচ্য!

মধ্যপ্রাচ্যের সুখী ভবিষ্যত যেন এই শিশুটির মতই থমকে আছে! ছ‌বি: সংগৃহীত

বিশ্ব রাজনীতির মানচিত্রে মধ্যপ্রাচ্য এক সময় ছিল সভ্যতা, সংস্কৃতি ও বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল। ইতিহাসের পাতায় মেসোপটেমিয়া, ব্যাবিলন, দামেস্ক, কায়রো বা বাগদাদের নাম আমরা পড়েছি জ্ঞানের আলো, সৃষ্টির বিস্তার আর সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে। কিন্তু বিগত দুই দশকে এই অঞ্চলটি পরিণত হয়েছে রক্তাক্ত এক জনপদে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পরিচালিত সামরিক অভিযান ও কূটনৈতিক হস্তক্ষেপে এই অঞ্চলটি এখন গৃহযুদ্ধ, সন্ত্রাস, শরণার্থী সঙ্কট ও মানবিক বিপর্যয়ে জর্জরিত।

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের পর যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে এক বৈশ্বিক অভিযানে নামে। “ওয়ার অন টেরর” শুরুর ঘোষণার পরেই একে একে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক রাষ্ট্রে সামরিক আগ্রাসন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালাতে থাকে। ফলাফল—লাখো মানুষের মৃত্যু, কোটি কোটি শরণার্থীর উদ্ভব এবং ঐতিহাসিক সভ্যতাগুলোর চিরতরে বিলুপ্তি।

২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্ররা ইরাকে হামলা চালায়। যুক্তি ছিল, সাদ্দাম হোসেনের হাতে গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে। পরে আন্তর্জাতিক পরিদর্শনে প্রমাণিত হয়, তেমন কোনো অস্ত্রই ছিল না। কিন্তু ততক্ষণে ইরাক ধ্বংসস্তূপে পরিণত। বাগদাদ ছিল আগুনে পোড়া শহর, বসরা ছিল শরণার্থীতে পূর্ণ। সাদ্দামের পতনের পর দেশটিতে শুরু হয় গোষ্ঠীগত সহিংসতা, যা এখনো চলছে। ইরাক এখনো রাজনৈতিকভাবে অস্থির। নিরাপত্তাহীনতা ও জঙ্গি হামলা তার নিত্য সঙ্গী।

২০১১ সালে আরব বসন্তের ছোঁয়ায় উত্তাল লিবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর হস্তক্ষেপে মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে হত্যা করা হয়। তাকে সরিয়ে দেওয়ার পর বলা হয়েছিল, লিবিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। বাস্তবে দেখা যায়, দেশটি বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর হাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। সরকার নামমাত্র, কার্যত রাজধানীসহ অন্যান্য এলাকাগুলো গোষ্ঠীগত সংঘর্ষ ও বিদেশি হস্তক্ষেপে অচল। উপসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে শত শত লিবীয় তরুণ সাগরে প্রাণ হারিয়েছে।

সিরিয়াও যুক্তরাষ্ট্রের অপারেশনের সরাসরি শিকার। ২০১১ সালে বাশার আল-আসাদবিরোধী আন্দোলনকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় শক্তিগুলো অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে উস্কে দেয়। ফলে শুরু হয় ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ। লাখ লাখ মানুষ নিহত হয়, কয়েক কোটি মানুষ দেশত্যাগে বাধ্য হয়। আইএস সন্ত্রাসী গোষ্ঠীও এই যুদ্ধের ফাঁকে জন্ম নেয়। দামেস্ক, আলেপ্পোর মতো ঐতিহাসিক শহর পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে।

ফিলিস্তিন প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র শুরু থেকেই ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘে বারবার ফিলিস্তিনের পক্ষে আনা প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। গাজায় যখন শিশুরা মরছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সমর্থন ঘোষণা করছে। এভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ মদদেই ফিলিস্তিনের জনগণ দীর্ঘ সময় ধরে নিপীড়িত, গৃহহীন ও রাষ্ট্রহীন হয়ে আছে।

ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট ২০১৫ সালে হুথি বিদ্রোহীদের দমন করার নামে ব্যাপক বিমান হামলা চালায়। এই যুদ্ধ হাজার হাজার বেসামরিক মানুষের মৃত্যু ঘটায়, ধ্বংস করে খাদ্য ও চিকিৎসাব্যবস্থা। এই মানবিক বিপর্যয়ে সৌদিকে অস্ত্র, গোয়েন্দা তথ্য ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে এই যুদ্ধের দায় থেকেও তারা মুক্ত নয়।

আরব বসন্তের ঢেউয়ে হোসনি মোবারকের পতনের পর মিশরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মুহাম্মদ মুরসিকে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরিয়ে দেন জেনারেল সিসি। যুক্তরাষ্ট্র এই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে কার্যত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তিউনিসিয়ায়ও একইভাবে বেন আলীর পতনের পর যে গণআন্দোলনের জন্ম হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত গন্তব্যহীন হয়ে পড়ে, কারণ যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র নয়, তাদের অনুগত শাসককেই সমর্থন করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের এসব হস্তক্ষেপের পেছনে আসল উদ্দেশ্য ছিল ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার এবং তেল সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। “গণতন্ত্র রক্ষা” বা “মানবাধিকার রক্ষা” মূলত ছিল প্রচারমূলক অজুহাত। যেখানে তাদের স্বার্থ নেই, সেখানে গণহত্যা হলেও তারা নিশ্চুপ থেকেছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যা, ভারতের মুসলিম নিপীড়ন, কিংবা গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন— সবই তারা উপেক্ষা করেছে।

এই দুই দশকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে কয়েক কোটিরও বেশি মানুষ গৃহহীন হয়েছে। শত শত স্কুল, হাসপাতাল, ধর্মীয় উপাসনালয় ধ্বংস হয়েছে। নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠছে রক্ত, বোমা আর মৃত্যুর ভেতরে। তাদের কাছে জীবন মানে যুদ্ধ। শিক্ষা মানে অস্ত্রধারণ। এ এক ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎ।

মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান চিত্র আমাদের এক নির্মম সত্যের সামনে দাঁড় করায়। একক কোনো রাষ্ট্র যদি বিশ্বের এতোটা অঞ্চলে এতো সহিংসতা সৃষ্টি করতে পারে, তবে বৈশ্বিক নিরাপত্তা কাঠামো ও আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের ভবিষ্যৎ নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। এখনই সময় বিশ্ববাসীর জেগে ওঠার। যুদ্ধের বিরুদ্ধে, দখলদারির বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ মানবিক অবস্থান নিতে হবে। নতুবা মধ্যপ্রাচ্যের এই আগুন একদিন গোটা বিশ্বকে গ্রাস করবে।

লেখক: সাংবাদিক

এম.কে.

×