ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২

অমানবিক শিশুশ্রম বন্ধ করা জরুরি

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ১৯:৪২, ২২ জুন ২০২৫

অমানবিক শিশুশ্রম বন্ধ করা জরুরি

আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। আবার জন্ম-জন্মান্তরের প্রবাদ বাক্য বনেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। আধুনিক শিল্প প্রযুক্তির কঠিনতর বলয় কোমলমতি শিশুদের যে মাত্রায় কায়িক শ্রমে নিয়োজিত করে তা কোনোভাবেই মান্যতা পায় না। শিল্প প্রযুক্তির নতুন বিশ^ দুনিয়াকে নিত্যনতুন আধুনিকতার সরঞ্জাম উপহার দিচ্ছে সন্দেহ নেই। কিন্তু বিপরীত প্রদাহে কত বিসদৃশ অপঘাত সামনে চলে আসছে তাও সমাজের নিত্য যন্ত্রণা তো বটেই। নিউটনের সেই তৃতীয় সূত্রের মতোই। প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে। যা মানুষকে সামনের দিকে এগিয়ে দিলেও পেছনে হটার দৃশ্যটাও চোখে পড়ার মতো। অষ্টাদশ শতাব্দীর নতুন শিল্প বিপ্লব আধুনিকতার বরমাল্যে নিয়ত উপহার সামগ্রী বিতরণে ব্যস্ততম সময় পার করে। কিন্তু নানামাত্রিক নেতিবাচক প্রদাহ সুষ্ঠু নিরাপদ জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করতেও সময় নেয় না। শুরু করেছি কোমলমতি শিশুদের নিত্য জীবনযাপনের বিষয় নিয়ে। শ্রেণি বিভক্ত সমাজে শুধু বিত্ত-নির্বিত্তের লড়াই নয়, লিঙ্গ বৈষম্যও বিভাজনের মাত্রাকে এগিয়ে দেয়। সেখানে আবার প্রচণ্ড প্রতাপে কোমলমতি শিশুদের ওপর কায়িক শ্রমের প্রবল চাপ তাও এক বিসদৃশ বাতাবরণ। শিশুশ্রম আসলেই আধুনিক শিল্পোন্নত সমাজের করাল নিষ্পেশনে তৈরি হওয়া আর এক অমানবিক, নিষ্ঠুর বাতাবরণ। যাদের বই হাতে বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুসময় সেখানে ভর করছে পাথর ভাঙা, মাটি কাটা, সিমেন্টের বস্তা মাথায় নেওয়া, ইটের গুঁড়ার অত্যধিক চাপে শিশুর সর্বাঙ্গ হেলে পড়া প্রযুক্তির নবউদ্ভাবনের পাশবিক যন্ত্রণা। হরেক গবেষণা প্রতিবেদনে দৃশ্যমান হচ্ছে আদিমকালের অমানবিক দাস প্রথার মতো শিশুদের পায়েও শ্রমের শিকল আটকে দেওয়া কোনোভাবেই নীতি-নৈতিকতাকে মান্যতা দেয় না। তাই আজ সভ্যশিল্প সমাজে যত্রতত্র দৃশ্যমান হচ্ছে। কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। নির্দ্বিধায়, অবলীলায় আমরা আধুনিকতার নব্যযুগে কোমলমতি শিশুশ্রমকে যেভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে তা যেন সভ্যতা সূর্য ঢেকে যাওয়ার অবস্থা। ১৭৬০ সালে জেমস ওয়াট প্রবর্তিত ইস্টিম ইঞ্জিনের আবিষ্কার নতুন এক আলোকোদয় জগতের দ্বার উন্মোচন করে। তার বিপরীত প্রদাহ বুঝতে বিশ^কে আরও এক শতক অপেক্ষা করতে হয়। শিল্প প্রযুক্তির যে কার্বন নিঃসরণে প্রকৃতি তার সহজাত নির্মল বায়ুকে হারাতে বসে। নারী নির্যাতন বেড়ে যায়। পাশাপাশি অল্প টাকায় শিশুশ্রমের আধিক্য সামাজিক বলয়কে ভারবাহী করলেও তার প্রতিকার, প্রতিবাদে সেভাবে সোচ্চার না হওয়াও পরিস্থিতির নির্মমতা। শুধু কি স্বচ্ছ, নির্মল বাতাসের ওপর দূষণ প্রক্রিয়া? তার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত থাকে সামাজিক গঠন প্রক্রিয়া, কার্যকলাপ, শ্রেণি বিভেদ বিরোধ। আরও আছে বংশ মর্যাদা, আভিজাত্যের গৌরব, বিত্ত-নির্বিত্তের লড়াই, বিবাদ যা আজও সমান তালে এগিয়েই যাচ্ছে। শিশুশ্রম যে কোনো সমাজের নীতি-নৈতিকতা স্খলিত করে, অমানবিকতার বলয়কে নির্মমভাবে এগিয়ে দিতে কসুর করে না। তার আগে সমাজের বিত্তবান, উপরের কাতারে বসা সভ্য মানুষরা যেভাবে শ্রেণি বৈষম্যের আঁচড় বসায় একইভাবে আরও সংশ্লিষ্ট বহু দুর্বিপাককে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে পুরো সামাজিক প্রতিবেশকে বাসের অযোগ্য করলেও নিজেদের ভালো থাকার পথটা প্রশস্ত করতে মোটেও পেছনের দিকে তাকায় না পর্যন্ত। আমাদের ক্ষুদ্র বাংলাদেশ, ধনে ধান্যে পুষ্পে ভরা চিরায়ত বঙ্গভূমি বিশ্বের সর্ববৃহৎ ব-দ্বীপ। সমুদ্র ও নদী পরিবেষ্টিত শাশ্বত বাংলা মাছে-ভাতে বাঙালিয়ানার যে সমৃদ্ধ বৈভব তাও এই অঞ্চলের অভাবনীয় গৌরব। উন্নত ও শিল্প প্রযুক্তির আধুনিক বাংলা নিত্যনতুন এগিয়ে যাচ্ছে সমৃদ্ধির সোপানে। পাশাপাশি কত সমস্যা সঙ্কুল পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে তাও যেন শেকড়ের অভ্যন্তরে গাঁথা চরম দুর্বিষহ যাতনা। উন্নয়নৈর অভিগামিতায় নানামাত্রিক কর্মযোগে কচি শিশুদের শ্রমে নিয়োজিত করা মানবতার বিপর্যয় হলেও তা ক্রমশ দৃশ্যমানই শুধু নয়, সামনে আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞজনেরা। এই আমাদের ১৮ কোটি মানুষের দেশে ৩৫ লাখ শিশু নাকি কায়িক শ্রমে সমর্পিত। সেটা অবকাঠামো নির্মাণ থেকে শুরু করে পারিবারিক, ঘরোয়া কাজেও শিশুশ্রম যেন অবিচ্ছেদ্য এক অংশ। কোমলমতি শিশুদের শ্রমে নিযুক্তই নয় শুধু নয় আরও ভয়াবহ তাদের মানবেতর জীবনযাপন। পারিবারিক আঙিনা ১০ বছরের এক শিশু তার মালিকের ৬ মাসের শিশু সন্তানকে কোলে-পিঠে করে বড় করছে। ঘরের কাজে নিয়োজিত শিশুটির পর্যাপ্ত আহারের সঙ্গে প্রোটিন থাকাও যে আবশ্যক তেমন বিবেচনা গৃহকর্তা কিংবা কর্ত্রীর আছে বলে তথ্য-উপাত্তে উঠে আসে নাই। বরং তাদের ওপর নির্মমতার দুঃসহ যন্ত্রণা সংবাদমাধ্যমের পাতাকে ভারি করে তোলে। কাজের কাজ কিছু হয় না। এমন অমানবিক পেশায় নিয়োজিত হয়ে শিশুদের শুধু সম্মানহানিই নয় বরং শৈশব-কৈশরের স্মৃতিমধুর দৃশ্য শূন্যের কোঠায় গিয়ে ঠেকে। আমাদের বাংলাদেশে ৩৫ লাখ শিশুর মধ্যে ১১ লাখই নাকি ঝুঁকিপূর্ণ কাজে সম্পৃক্ত। আবার পথশিশুর সংখ্যাও নাকি কম নয়। প্রায় ৩৪ লাখ। যেখানে সিংহভাগ শিক্ষা, পরিচয় ও নিরাপত্তার বলয় থেকে প্রায়ই বঞ্চিত। পথশিশুদের ৯৪% নাকি আইনগত সামাজিক সুরক্ষার আওতায় থাকছে না। আন্তর্জাতিক শ্রম ও কর্মসংস্থান ব্যবস্থাপনায় এমন বঞ্চিত, হতভাগ্য শিশুদের নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করলেও যথার্থ কোনো কর্মযোগ আজ অবধি অন্ধকারে। যে কোনো বহুল প্রচলিত সামাজিক অব্যবস্থাপনার জন্য শুধু সংশ্লিষ্ট সংগঠনই দায়ী থাকে না। যে অভ্রভেদি সমস্যাসঙ্কুল রাস্তা পাড়ি দিতে হয় অসহায়, ছিন্নমূল ও পথশিশুদের সেখানে নিষ্কণ্টক পথ খুঁজে পাওয়াও আর এক কাঁটা বিছানো রাস্তা। বিজ্ঞজনেরা বলছেন শুধু আইন-আদালতে এমন অমানবিক কার্যক্রমকে ঠেকানো মুশকিল। দারিদ্র্য বিমোচন আর পারস্পরিক হৃদ্যতা মানবিকতা ছাড়াও শিশুর প্রতি সহজাত সহমর্মিতা দেখাতে না পারলে সমস্যা যে তিমির সেই তিমিরেই গেড়ে বসার সমূহ আশঙ্কা। এর নিরসনে প্রয়োজন সচেতনতা আর কাঠামোগত সংস্কারের মর্মমূলে অমানবিক প্রথাকে সজোরে আঘাত করাও পরিস্থিতির ন্যায্যতা। দারিদ্র্য বিমোচনও প্রভাবক হিসেবে কাজ করতে পারে। পিতা-মাতা আর শিশু সন্তানকে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে পাঠানো মানেই তারা নিতান্তই অসহায়। বিকল্প কোনো পথ সামনে খোলা না থাকাও আর এক রুদ্ধতার বেষ্টনী। শিশুশ্রম নিরসনে বিভিন্ন বাজেটে বরাদ্দ দেওয়া হলেও সুশাসন ও নৈতিকতার অভাবে সংশ্লিষ্টদের দ্বারে পৌঁছাতেই পারেনি। তেমন কঠোর কাঁটা বিছানো রাস্তাকেও ভেঙে দিতে হবে। 

প্যানেল

×