
ছবিঃ সংগৃহীত
হৃদ্রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে গবেষকরা তৈরি করেছেন মানুষের হৃদ্যন্ত্রের ৩,৮০০টিরও বেশি ‘ডিজিটাল টুইন’ বা ভার্চুয়াল হৃদ্মডেল। যুক্তরাজ্যের কিংস কলেজ লন্ডন, ইমপেরিয়াল কলেজ লন্ডন ও অ্যালান টুরিং ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের এই যুগান্তকারী গবেষণা প্রথমবারের মতো এত বিশাল পরিসরে রোগী-নির্দিষ্ট কার্ডিয়াক মডেল বিশ্লেষণের পথ খুলে দিয়েছে।
এই মডেলগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), ক্লিনিক্যাল ইমেজিং ও অগ্রসর গাণিতিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাস্তব হৃদ্যন্ত্রের আকৃতি ও কাজকে অবিকল অনুকরণ করে তৈরি করা হয়েছে। ফলে হৃদ্রোগ কীভাবে বয়স, লিঙ্গ ও জীবনধারা অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়—তা এখন আরও ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে।
ইমপেরিয়াল কলেজের বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান ও গবেষণার প্রধান লেখক স্টিভেন নিডারার বলেন,
“আমরা মূলত বিমানের ডিজাইন মডেলের মতো পদ্ধতিকে হৃদ্রোগ নির্ণয়ে প্রয়োগ করছি। এভাবে আগে কখনো হয়নি।”
ECG নিয়ে পুরনো ধারণার ভাঙন
এই গবেষণার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, এটি ইসিজি (ECG)-তে নারী-পুরুষের পার্থক্য বিষয়ে প্রচলিত ভুল ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। গবেষকরা জানান, ইসিজির ভিন্নতা আসলে হৃদ্যন্ত্রের গঠনগত পার্থক্যজনিত, কার্যগত নয়।
নিডারার বলেন, “পুরুষ-নারীর ইসিজি পার্থক্য আসলে আকারের কারণে, কার্যক্ষমতার নয়। এটি একটি যুগান্তকারী তথ্য, যা হৃদ্রোগ নির্ণয়ে লিঙ্গভিত্তিক পক্ষপাত দূর করতে সহায়তা করবে।”
ক্লিনিকে বাস্তব প্রয়োগের পথে
এই প্রযুক্তিকে বাস্তব চিকিৎসা ব্যবস্থায় প্রয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যুক্তরাজ্যের নটিংহ্যাম ও শেফিল্ড হাসপাতালের সঙ্গে কাজ করে গবেষকরা একটি ক্লাউড-ভিত্তিক সফটওয়্যার তৈরি করছেন, যা এনএইচএস-এর (NHS) সঙ্গে যুক্ত হয়ে সরাসরি ডিজিটাল টুইন নির্মাণ করতে পারবে।
নিডারার বলেন, “হাসপাতালের মাপজোখ ক্লাউডে আপলোড করে সেই অনুযায়ী ডিজিটাল হার্ট টুইন তৈরি করে আবার ক্লিনিশিয়ানের কাছে পাঠানো হবে—এই প্রযুক্তি বাস্তবে চালুর পথেই আছে।”
এছাড়া গবেষকরা এমন সেন্সর তৈরির কাজ করছেন, যা হৃদ্যন্ত্রে স্থাপন করে রক্তচাপ বা বৈদ্যুতিক সংকেত নিয়মিত পাঠাবে এবং সেই তথ্য দিয়ে টুইন মডেল আপডেট হবে। এতে হৃদ্যন্ত্রের একপ্রকার "জীবন্ত ভার্চুয়াল সংস্করণ" তৈরি হবে, যা যেকোনো পরিবর্তন বা চিকিৎসায় রিয়েল-টাইম সাড়া দিতে পারবে।
3D প্রিন্টেড হৃদয় ও মানবিক সংযোগ
এই প্রযুক্তির অন্যতম বিস্ময়কর দিক হলো, ডিজিটাল টুইন থেকে তৈরি ৩ডি প্রিন্টেড হৃদ্যন্ত্র—যা চিকিৎসা শিক্ষার পাশাপাশি রোগীদের বোঝাতে ও অস্ত্রোপচারের প্রস্তুতিতে ব্যবহার করা হচ্ছে।
ইমপেরিয়াল কলেজের ন্যাশনাল হার্ট অ্যান্ড লাং ইনস্টিটিউটের গবেষক ক্রিস্তোবাল রোদেরো গোমেজ বলেন, “এই প্রকল্প শুধু প্রযুক্তিগত নয়, বরং মানবিক চাহিদা পূরণে নিবেদিত। আমরা বারবার নিজেদের জিজ্ঞেস করি—আমরা এটা কার জন্য করছি?”
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
এই প্রযুক্তির পরিধি হৃদ্রোগেই সীমাবদ্ধ নয়। গবেষকরা এখন ক্যানসার গবেষণা ইউকে-এর সঙ্গে মিলে মস্তিষ্কের টিউমার নির্ণয়ে ডিজিটাল টুইন পদ্ধতি প্রয়োগের কাজ করছেন। তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হচ্ছে—একটি পূর্ণাঙ্গ ‘ডিজিটাল মানবদেহ’ নির্মাণ, যা একাধিক স্বাস্থ্য সমস্যার পূর্বাভাস ও নিরীক্ষায় ব্যবহৃত হবে।
এই গবেষণা চিকিৎসা জগতে প্রযুক্তির ব্যবহারকে আরও বাস্তবসম্মত, মানবিক এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক করার নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।
সূত্রঃ আনাদলু
ইমরান