
প্রতিবছর ৭ জুন পালিত হয় আন্তর্জাতিক খাদ্য নিরাপত্তা দিবস, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO)-এর যৌথ উদ্যোগে শুরু হয়েছে। এটি শুধু একটি আনুষ্ঠানিক দিবস নয়, বরং একটি গভীর বার্তা বহন করে- ‘খাদ্য নিরাপত্তা সবার দায়িত্ব’। দুঃখজনকভাবে, বাংলাদেশে এই গুরুত্বপূর্ণ বার্তাটি প্রায়ই উপেক্ষিত হয়। অথচ খাদ্য নিরাপত্তা কোনো বিলাসিতা নয়। এটি একটি মৌলিক মানবাধিকার। নিরাপদ খাদ্য কেবল জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষাই নিশ্চিত করে না, বরং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সামাজিক আস্থার ভিত্তিও গড়ে তোলে। এর বিপরীতে, অনিরাপদ খাদ্য অদৃশ্য রোগব্যাধি, দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি, অর্থনৈতিক ক্ষতি এবং সামগ্রিক নৈতিক অবক্ষয়ের শৃঙ্খল তৈরি করে।
বাংলাদেশ এক জটিল ও গভীর খাদ্য নিরাপত্তা সংকটের মুখোমুখি, যা শুধু দরিদ্র দিনমজুর বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকেই নয়, বরং শহুরে মধ্যবিত্ত ও অভিজাত শ্রেণিকেও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করছে। সুষ্ঠু নীতি, কার্যকর তদারকি এবং সম্মিলিত সামাজিক সচেতনতা ছাড়া এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। নিরাপদ খাদ্যের অধিকার নিশ্চিত করা আজ আমাদের নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব। বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তার চিত্র উদ্বেগজনক। রাস্তার পাশের খাবারের দোকান থেকে শুরু করে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুপারমল কিংবা নামকরা রেস্তোরাঁ- সবখানেই অনিরাপদ খাদ্যের বিস্তার। লাখো দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষ যে রাস্তার খাবার খায়, তা অনেক ক্ষেত্রেই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, নিম্নমানের কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণ উপাদান দিয়ে প্রস্তুত হয়। স্থানীয় চায়ের দোকানগুলোতে যে বান, কেক বা বিস্কুট পরিবেশিত হয়, তা প্রায়ই মেয়াদোত্তীর্ণ বা দূষিত। দোকানিরা নির্বিঘ্নে নকল মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ ব্যবহার করে। কারণ কার্যকর নজরদারি প্রায় নেই বললেই চলে। এক রিকশাচালকের কথায়, ‘আমাদের কোনো বিকল্প নেই, সামর্থ্য অনুযায়ী যেটা পারি, সেটাই খাই।’ শুধু প্রান্তিক মানুষের খাবার নয়, উচ্চবিত্তের খাদ্যেও নিরাপত্তাহীনতা বিদ্যমান। সুপারমার্কেট বা দামি রেস্তোরাঁতেও খাদ্যে ভেজাল একটি নিয়মিত ঘটনা। রাসায়নিক উপাদানে ফল পাকানো, দুধে ডিটারজেন্ট বা স্টার্চ মেশানো এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারে অতিরিক্ত সংরক্ষণকারী ব্যবহারের মতো অনৈতিক চর্চা অহরহ চলছে। ভোক্তারা প্রায়ই ধরে নেন, দামি মানেই নিরাপদ। কিন্তু নিয়ন্ত্রণহীন বাস্তবতায় এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। খাদ্যের গুণগত মানের নিশ্চয়তা ছাড়া, মূল্য শুধু এক ধরনের বিভ্রম তৈরি করে, নিরাপত্তা নয়।
খাদ্য নিরাপত্তা সংকটের সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো জনস্বাস্থ্যের ওপর এর বিরূপ প্রভাব। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ভেজাল ও দূষিত খাদ্য গ্রহণের ফলে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এই অসুস্থতা প্রায়ই পেটের সমস্যার মতো সাময়িক রোগ দিয়ে শুরু হলেও তা দীর্ঘমেয়াদি জটিলতায় রূপ নেয়। বেশিরভাগ মানুষ জানেই না, তাদের কিডনি সমস্যা, ডায়াবেটিস বা হৃদরোগের শিকড় অনেক সময় লুকিয়ে থাকে বছরের পর বছর অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে। ভেজাল খাদ্য একপ্রকার ‘ধীর বিষ’। যা ধীরে ধীরে শরীরে বিষাক্ত পদার্থ জমা করে এবং ক্যান্সার, স্নায়বিক সমস্যা, বন্ধ্যত্ব ও শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। এটি শুধু ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যের ক্ষতি নয়; এটি জাতির সামগ্রিক উৎপাদনশীলতাকে দুর্বল করে তোলে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমায় এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে। বিশ্বব্যাপী গবেষণা অনুযায়ী, খাদ্যবাহিত রোগ প্রতি বছর নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে আনুমানিক ১১০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ক্ষতির কারণ। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ক্ষতির পরিমাণ শুধু সংখ্যায় সীমাবদ্ধ নয়, এর অর্থ হলো হারিয়ে যাওয়া স্কুলজীবন, শ্রম হারানো পরিবার এবং ভবিষ্যতের স্বপ্ন ভঙ্গ।
বাংলাদেশে রমজান এমন একটি সময়, যা পবিত্রতা, সংযম ও মানবিকতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু এই মহিমান্বিত মাসটিতেও অনৈতিক ব্যবসায়িক কার্যকলাপ চরমে পৌঁছে। খেজুর, ফল, ডাল, দুধ- রমজানের গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যসামগ্রীর দাম অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে যায়। এরচেয়েও উদ্বেগজনক হলো, বাজারে প্রকাশ্যেই বিক্রি হয় মেয়াদোত্তীর্ণ কিংবা রাসায়নিক-পরিপক্ব খেজুর। চট্টগ্রামের এক গৃহিণী আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘পুরো একটা বাক্স খেজুর কিনেছিলাম, কিন্তু সেগুলোতে পচা গন্ধ পেয়েছি। শেষে ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছি।’ অনেক পরিবার এই ধরনের আর্থিক ক্ষতি সহ্য করতে না পেরে, স্বাস্থ্যঝুঁকি জেনেও সেসব খাওয়ায় বাধ্য হয়। রমজানে খাদ্যপণ্যের অতিরিক্ত চাহিদা অসাধু ব্যবসায়ীদের মানহীন পণ্য বাজারজাত করতে উৎসাহিত করে। এর পেছনে রয়েছে নিয়ন্ত্রণহীন বাজার ব্যবস্থাপনা ও নৈতিক দায়িত্বের চরম অভাব।
খাদ্যের পাশাপাশি ভেজাল ওষুধ এবং বিভ্রান্তিকর স্বাস্থ্যসম্পূরক পণ্যের বাজারও ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষত ফেসবুক, এখন এমন একটি প্ল্যাটফর্মে রূপ নিয়েছে যেখানে সন্দেহজনক বিজ্ঞাপনে ডায়াবেটিস থেকে ক্যান্সার পর্যন্ত সব রোগের নিরাময়ের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এই পণ্যগুলো প্রায়ই তথাকথিত ‘বিখ্যাত ডাক্তারদের’ অনুমোদনের নামে প্রচারিত হয়- যারা মূলত জনস্বার্থ নয়, বরং আর্থিক লাভকেই প্রাধান্য দেয়। ভোক্তা অধিকার বা স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার্যকর তদারকির অভাবে সাধারণ মানুষ এসব পণ্যের ফাঁদে পড়ে, যা তাদের স্বাস্থ্যের আরও অবনতি ঘটায়। যখন খাদ্য ও ওষুধ- মানবজীবনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ- একযোগে দূষিত ও ভেজাল হয়ে ওঠে, তখন তা একটি গভীরতর নৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার ইঙ্গিত দেয়।
বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা রক্ষায় আইন থাকলেও তার বাস্তবায়ন প্রশ্নবিদ্ধ। ২০১৩ সালের খাদ্য নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (BFSA)-এর দায়িত্ব খাদ্যের গুণমান নিশ্চিত ও নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু বাস্তবতা হলো- এই প্রয়োগ ছিদ্রপূর্ণ, খণ্ডিত ও প্রায়ই প্রতীকী হয়ে থাকে। মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য মাঝে মাঝে কিছু অভিযানের আয়োজন করা হয়। কয়েকটি দোকানে ভেজাল পণ্য জব্দ, দু-একজন বিক্রেতার গ্রেপ্তার, নামমাত্র জরিমানা। কিন্তু এসব পদক্ষেপ দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরোধ গড়তে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। অভিযানের পরদিনই ব্যবসায়ীরা আগের অবস্থায় ফিরে যায়। নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থায় জনবল ঘাটতি, স্বচ্ছতার অভাব এবং ধারাবাহিকতার সংকট স্পষ্ট। পাশাপাশি, খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে ভোক্তা শিক্ষা প্রায় নেই বললেই চলে। অধিকাংশ মানুষ জানে না ভেজাল কী, কিভাবে তা শনাক্ত বা রিপোর্ট করতে হয়। আর যদি কেউ প্রতিবেদন করেও, তা প্রায়ই আমলাতান্ত্রিক জটিলতার ভিতর হারিয়ে যায়।
খাদ্য নিরাপত্তা সংকট সবার ওপর সমানভাবে প্রভাব ফেলে না। শহরের দরিদ্র জনগোষ্ঠী, দিনমজুর, পথশিশু ও গ্রামীণ গরিব পরিবারগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের কোনো বিকল্প নেই। জৈব বা নিরাপদ খাদ্য তাদের নাগালের বাইরে। তারা খায় যা সবচেয়ে সস্তা ও সহজলভ্য। এসব শরীর যেন একেকটি পরীক্ষাগার, যেখানে প্রতিদিন চলে বিষাক্ত পদার্থের অনুপ্রবেশ। সস্তা তেল, দূষিত পানি, কৃত্রিম রঙের স্ন্যাকস, পুনর্ব্যবহৃত মাংস ইত্যাদি। এটি একটি নির্মম পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বহির্প্রকাশ, যা নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টির বাইরে থেকে যায়।
বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা সংকট সমাধানে কসমেটিক বা লোক দেখানো সংস্কার নয়, প্রয়োজন বাস্তবভিত্তিক ও বহুস্তরীয় কার্যকর ব্যবস্থা। এ সংকটের গভীরতা ও ব্যাপকতা বিবেচনায় একটি সমন্বিত রূপরেখা তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি। খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষকে সরবরাহ শৃঙ্খলের প্রতিটি স্তরে কার্যকর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। নিয়মিত ও আকস্মিক পরিদর্শন জোরদার করতে হবে। পাশাপাশি, স্বচ্ছ লেবেলিং ও পণ্যের উৎস শনাক্তযোগ্য (traceable) ব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ প্রয়োজন। খাদ্য নিরাপত্তা সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে ব্যাপক প্রচারাভিযান চালাতে হবে, যাতে ভোক্তা মাত্রেই নিজের অধিকার সম্পর্কে জানেন এবং সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। স্থানীয় সরকার ও কমিউনিটির সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব। একইসঙ্গে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান ও পেশাদারদের নৈতিক জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে, যেন ব্যবসায়িক স্বার্থের নামে জনস্বাস্থ্যের ওপর আঘাত না আসে। সর্বোপরি, নিরাপদ খাদ্য প্রযুক্তি, পরীক্ষণ পদ্ধতি এবং মনিটরিং ব্যবস্থার উন্নয়নে গবেষণা ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বহুমুখী পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন ছাড়া খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কেবল অসম্ভবই নয়, জাতির স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।
বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা সংকট কেবল একটি স্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জ নয়, এটি একটি গভীর সামাজিক ও নৈতিক ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। যখন খাদ্যই রোগের উৎস হয়ে ওঠে, তখন তা দেশের মৌলিক ভিত্তিকে দুর্বল করে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একদিকে যেমন সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের দায়িত্ব, তেমনি ধর্মীয় ও নৈতিক বাধ্যবাধকতাও। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) অর্জন এবং মধ্যম আয়ের দেশের কাক্সিক্ষত অবস্থান অর্জনের স্বপ্ন যদি সত্যিই বাস্তবায়ন করতে হয়, তবে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণকে উপেক্ষা করার আর সুযোগ নেই। সরকারকে শুধু ঘোষণা নয়, দৃঢ়ভাবে কাজ করতে হবে। সুশীল সমাজকে জবাবদিহি দাবি করতে হবে। নাগরিকদের সচেতন, সংগঠিত ও ক্ষমতায়িত হতে হবে। খাদ্য জীবন রক্ষা করে। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে সেই খাদ্যই জীবনের হুমকিতে পরিণত হয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব এখন আমাদের সকলের।
(প্রাগ, চেক রিপাবলিক থেকে)
লেখক : অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
প্যানেল