ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৪ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২

সিডনির মেলব্যাগ

গানের অমিয় ধারা

অজয় দাশগুপ্ত

প্রকাশিত: ২০:৫৫, ২৩ জুন ২০২৫

গানের অমিয় ধারা

সিডনির মেলব্যাগ

সিডনিতে এখন গান বাজনার আসর নিত্য নৈমিত্তিক। দেশ বিদেশ থেকে শিল্পীরা আসেন। গান শুনিয়ে যান। ঢাকা থেকে কলকাতা থেকে যেমন আসেন তেমনি অন্যদেশ থেকেও আসেন। নিউজিল্যান্ড প্রবাসী বাংলাদেশি চিকিৎসক গায়ক হিউবার্ট খোকন। তাঁর গান আমি আগে শুনেছি কি না মনে করতে পারছি না। তবে যে সন্ধ্যায় গানের আসরে গেলাম সে সন্ধ্যাটি সুর ও বাণীতে ভরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সফেদ চুল আর সোম্য দর্শনের গায়ক আমাদের নিয়ে গেছিলেন বাংলা গানের স্বর্ণালী যুগে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি সে সময়কাল আমাদের শিল্পসংস্কৃতির আসল সময়কাল। যার ভিত্তিতেই আমাদের শেকড়। শুরুটা হয়েছিল আমি বাংলায় গান গাই গানটি দিয়ে। সুপরিকল্পিত অনুষ্ঠানটির শুরু হয়েছিল সম্প্রতি প্রয়াত: শিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে স্মরণ করে। প্রতুলের অর্থ যাই হোক প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গান কিন্তু অপ্রতুল। তিনি দু-একটি গানে আমাদের জীবন রাঙিয়ে দিয়ে গেছেন। যার অন্যতম এই গানটি। আমি নিশ্চিত যতদিন বাংলা বাঙালি ততদিন থাকবে এই অবিনাশী গান।

অনুষ্ঠানে তাঁরা স্মরণ করলেন প্রয়াত কবি হেলাল হাফিজকে।  এও আমার কাছে যেমন বিস্ময়ের তেমনি আবেগঘন আনন্দের। যখন কবির ছবি পর্দায় ভেসে উঠেছিল, যখন তাঁর কবিতা পত্র দিও পাঠ হচ্ছিল আমি শিহরিত হয়ে উঠছিলাম। ডাক্তার রশিদ আহমেদের ভরাট কণ্ঠে আবৃত্তি আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।  
ভূপেন হাজারিকার গাওয়া দোলা হে দোলা গানটি অপূর্ব লেগেছে হিউবার্ট খোকনের কণ্ঠে। যে সব জায়গায় আবেগ আর কষ্ট সেসব জায়গাগুলো নিপুণভাবে গেয়েছেন। কিন্তু এই অনুষ্ঠানে তাঁর আরও কিছু উদারতা আমাদের জন্য বিশেষ করে আমার জন্য ছিল চমকপ্রদ। আমরা সিডনিতে বহু খ্যাতিমান শিল্পীর অনুষ্ঠান দেখি গান শুনি।

তাঁদের কেউই এ যাবৎ নিজের গান বন্ধ করে অন্য কাউকে গাইতে দিয়েছেন বলে জানি না। চোখেও পড়েনি। উপস্থাপক যখন বাংলা গান কারা সামনে নিয়ে যাবে আগামীতে এমন প্রশ্ন করলেন তখনই ধারণা করছিলাম তারুণ্যের কেউ হয়তো আসবে। কিন্তু তারা যে একক গান দিয়ে আমাদের মাত করে দেবে এটা ঠাওর করতে পারিনি।
এই আয়োজনে ফাবিহা অতুলনীয়া। বাঁশিতে হৃদয় মন হরণ করার পাশাপাশি হিউবার্ট খোকনের সঙ্গে আয় খুকু আয় গানটিতে ফাবিহার আবেগ আর সুরের অনুগামিতা আমাকে মুগ্ধ করেছে মুগ্ধ করেছে হলভর্তি দর্শক শ্রোতাকে।
ফাবিহা শ্রেয়া ঘোষালের যে গানটি একক গাইলো তাতে ও স্পষ্ট সে ভালো গায়িকা। ব্যক্তিগত জীবনে সে ডাক্তার । এমন একটি শ্রমলব্ধ কঠিন বিষয়ে পড়াশোনা করে চিকিৎসক হয়ে এতগুলো বিষয় ধারণ করা সহজ কিছু না। সে আমাদের সিডনি বাঙালির অহংকার ।
পরের জন নিলাদ্রী চক্রবর্তী। বহুদিন থেকে আমি তাকে দেখছি। তার অভিভাবক তার পরিবারকেও চিনি আমি। এই তরুণ শুধু গান গায় না সুর ও বাণীতে সে মানুষকে মজিয়ে রাখে। নীলাদ্রি মূলধারার এক অসামান্য প্রতিভাধর বালক। সে যন্ত্রী হিসেবেও অসামান্য। এই আয়োজনে সে যখন গান গাইছিল আমার মনে হচ্ছিল কিশোর বা তরুণ রবীন্দ্রনাথ বসে আছেন।

দাড়ি গোঁফ পোশাক মিলিয়ে এমনি এক আবহ তৈরি করা নীলাদ্রি গেয়েছিল কঠিন গান। অখিল বন্ধু ঘোষের গান গাইতে বড় বড় শিল্পীরাও স্বাছন্দ্য বোধ করেন না। অথচ, তোমার ভূবনে ফুলের মেলা আমি কাঁদি সাহারায় গানটি গেয়ে তাক লাগিয়ে দিল নীলাদ্রি। সেও আমাদের অহংকারের তালিকায় আছে।
যন্ত্রীদের কথা না বললেই নয়। আমি তাদের সবার নাম জানি না। তবে তবলায় অভিজিত দান এই শহরের এক সুপরিচিত নাম। যার তবলা বাদন শিল্পের সঙ্গে তুলনীয়। সোহেল খান পারিবারিক ভাবেই সঙ্গীতময়। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো প্রচ- ঠান্ডা আর কনকনে শীত উপেক্ষা করেই মানুষজন ছুটে এসেছিলেন গান শুনতে। হিউবার্ট খোকন তাদের নিরাশ করেননি বরং আশা ও ভালোলাগায় উজ্জীবিত করে গেছেন। বিষয়টি দেশে দেশে বাঙালির শিল্পী বিনিময়ের চাইতেও অধিক। আমি বলব সংস্কৃতি ও গানের বিনিময়।
সানাই কিংবদন্তি ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খাঁ সাহেব বলতেন, মানুষকে সুর লাগিয়ে দাও, সুর বা গান জানা মানুষ আর যাই করুক যুদ্ধ করে না।
সত্যি তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত দুনিয়ায় আমি বাংলায় গান গাই অনুষ্ঠানটি আমাদের মনে শান্তির প্রলেপ দিয়ে গেছে। প্রবাসের এই শান্তি ছড়িয়ে পড়ুক দেশ দেশান্তরে।[email protected]

×