
ইরান-ইসরায়েলের পাল্টাপাল্টি হামলার জেরে বিশ্ববাজারে তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এমন পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ বাজার স্থিতিশীল রাখতে এবং সম্ভাব্য চাহিদা মেটাতে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি বাড়িয়েছে ভারত।
১২ দিন ধরে চলা উত্তেজনার পর অবশেষে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে ইরান ও ইসরায়েল এমন ঘোষণা এসেছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষ থেকে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে বিশ্ববাজারে তৈরি হয় তীব্র অনিশ্চয়তা। ইরান হুমকি দিয়েছিল হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়ার, যা বিশ্ব তেল বাণিজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রুট। ফলে আগাম ঝুঁকি বিবেচনায় ভারত সরকার আমদানির দিক পরিবর্তন করে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রমুখী হয়।
বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল আমদানিকারক দেশ ভারত এখন প্রতিদিন গড়ে ৫১ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল বিদেশ থেকে আনছে। এসব তেল দেশীয় পরিশোধনাগারগুলোতে প্রক্রিয়াজাত হয়ে রূপ নিচ্ছে ডিজেল ও পেট্রোলে।
বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়লেও ভারত তেলের জোগান নিশ্চিত করতে আমদানির উৎস বহুমুখীকরণে মনোযোগী হয়েছে। জুন মাসে রাশিয়া থেকে প্রতিদিন ২০–২২ লাখ ব্যারেল তেল এনেছে দেশটি, যা গত দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকেও তেলের আমদানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে দৈনিক ৪ লাখ ৩৯ হাজার ব্যারেলে।
এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই ভারত রুশ তেলের দিকে ঝুঁকে পড়ে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ফলে সস্তায় তেল পাচ্ছে ভারত। এক সময় যেখানে রাশিয়ার আমদানির অংশ ছিল মাত্র ১ শতাংশ, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ থেকে ৪৪ শতাংশে।
বিশ্ববাজারে তেলের অস্থিরতার প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশেও। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় বৃদ্ধি এবং শিল্প খাতে খরচ বেড়ে যাওয়া—সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড়সড় চাপ তৈরি হতে পারে। এ ছাড়া প্রবাসী আয়ে প্রভাব, বাণিজ্য ঘাটতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপের আশঙ্কাও করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশকে এখনই জ্বালানি খাতে বিকল্প উৎসের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি, এলএনজি ও বহুমুখী আমদানি উৎস গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ সাশ্রয়ী ব্যবহারে সচেতনতা তৈরি করা জরুরি।
বিশ্ববাণিজ্য বিশ্লেষক সুমিত রিতোলিয়ার মতে, পারস্য উপসাগরে উত্তেজনার কারণে অনেক জাহাজমালিক এখন তেলবাহী জাহাজ হরমুজ প্রণালিতে পাঠাতে আগ্রহী নয়। ফলে ওই পথে চলাচলকারী জাহাজের সংখ্যা ৬৯ থেকে নেমে এসেছে ৪০-এ। তাই ভারতের মতো দেশগুলো নতুন কৌশল গ্রহণে বাধ্য হচ্ছে।
ইকোনমিক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুনের শেষ নাগাদ সৌদি আরব ও ইরাক থেকে ভারতের তেল আমদানি ২০ লাখ ব্যারেলের নিচে নেমে যেতে পারে। অর্থাৎ, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি এখন ঐতিহ্যবাহী মধ্যপ্রাচ্য নির্ভরতাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
ভারতের পরিশোধনাগারগুলোও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের পরিশোধন সক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। তারা এখন রাশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা বিভিন্ন জাতের অপরিশোধিত তেল প্রক্রিয়াজাত করতে সক্ষম। ফলে হরমুজ প্রণালিনির্ভরতা কিছুটা কমেছে।
বাংলাদেশের জন্য এ ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। যুদ্ধ পরিস্থিতি কবে শেষ হবে, তা নিশ্চিত নয়। তাই সময় থাকতে বিকল্প উৎস থেকে জ্বালানি মজুত, জ্বালানি নিরাপত্তা পরিকল্পনা ও সচেতন ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে হবে—এমনটাই মত অর্থনীতিবিদদের।
মিমিয়া