ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৪ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২

সংসদে নারী প্রতিনিধিত্বের কোন পদ্ধতি বেশি কার্যকর?

মোঃ ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ্, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৯:৩৬, ২৪ জুন ২০২৫

সংসদে নারী প্রতিনিধিত্বের কোন পদ্ধতি বেশি কার্যকর?

ছবি: জনকণ্ঠ

জুন মাসের এই গরমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি বিষয় নিয়ে তীব্র বিতর্ক চলছে আর তা হলো জাতীয় সংসদে নারীদের প্রতিনিধিত্বের পদ্ধতি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সাম্প্রতিক সংলাপে সংসদে নারীদের জন্য ১০০টি আসন সংরক্ষণের ব্যাপারে মোট চারটি প্রস্তাব আলোচনার টেবিলে হাজির হয়েছে। এই প্রস্তাবগুলোর মধ্যে কোনটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে কার্যকর হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো, নাগরিক সমাজ এবং নারী অধিকার সংগঠনগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। গত ১৫ জুন ২০২৫ তারিখে নাগরিক কোয়ালিশন কর্তৃক আয়োজিত "নারীর ক্ষমতায়নে সংসদে সরাসরি ভোটে নারী প্রতিনিধিত্ব নির্বাচন: প্রয়োজনীয়তা, চ্যালেঞ্জ ও সমাধান" শীর্ষক আলোচনা সভায় এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। আমার মতে, সংসদে নারীদের প্রতিনিধিত্বের জন্য সরাসরি নির্বাচন পদ্ধতিই সবচেয়ে কার্যকর, যা নারীদের প্রকৃত ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করবে।

বর্তমানে জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য ৫০টি আসন সংরক্ষিত রয়েছে, যা মোট আসনের মাত্র ১৪ শতাংশ। এই আসনগুলোতে নারীরা সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নয়, বরং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত আসন সংখ্যার অনুপাতে মনোনয়নের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। এই পদ্ধতিতে নারী সংসদ সদস্যরা জনগণের কাছে নয়, বরং দলীয় নেতৃত্বের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন। ফলে তাঁদের প্রতিনিধিত্ব প্রায়শই আলংকারিক হয়ে দাঁড়ায়। ২০২৫ সালের জুন মাসে নাগরিক কোয়ালিশনের আলোচনা সভায় তাসনিম জারা, ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টির সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব বলেছেন, "যদি একজন নারী সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হন এবং তাঁর একটি নির্বাচনী এলাকা থাকে, তাহলে তিনি ক্ষমতায়িত বোধ করবেন এবং ভোটারদের কাছে জবাবদিহি করবেন"। বর্তমান ব্যবস্থায়, যেহেতু তাঁরা দলীয় মনোনয়ন বা কোনো দলীয় নেতার মাধ্যমে সংসদ সদস্য হন, তাঁরা সেই দল বা নেতার কাছে দায়বদ্ধ থাকেন, জনগণের কাছে নয়।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন সংসদের আসনসংখ্যা ৩০০ থেকে ৪০০-তে উন্নীত করে ঘূর্ণমান পদ্ধতিতে ১০০টি আসনে নারীদের সরাসরিভাবে নির্বাচিত হওয়ার প্রস্তাব করেছে। এই পদ্ধতিতে প্রথম মেয়াদে ৪০০টি সংসদীয় আসনের ১০০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে এবং এসব আসন থেকে শুধু নারীরা একে অপরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সরাসরিভাবে নির্বাচিত হবেন। অন্যদিকে, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন আরও বেশি সাহসী প্রস্তাব দিয়েছে—সংসদীয় আসন ৬০০-তে উন্নীত করে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় একটি সাধারণ আসন এবং একটি নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন রাখার প্রস্তাব। উভয় আসনেই সরাসরি নির্বাচন হবে। এই প্রস্তাবটি নারীদের প্রতিনিধিত্বকে ৫০ শতাংশে উন্নীত করবে, যা বাংলাদেশের জনসংখ্যার অনুপাতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

কিন্তু এই প্রস্তাবগুলোর বিরোধিতাও রয়েছে। বিএনপিসহ কিছু রাজনৈতিক দল মনে করে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সংসদীয় সংস্কৃতিতে এখনই সরাসরি নির্বাচনের সময় হয়নি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ ৩ জুন ২০২৫ তারিখে বলেছেন, "সরাসরি নির্বাচনের জন্য যে পদ্ধতিগুলো... ঘূর্ণমান পদ্ধতি অথবা সরাসরি পদ্ধতি যেগুলো আলোচনায় এসেছে, সেটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক বা সংসদীয় সংস্কৃতিতে ভিজিবল (দৃশ্যমান) বলে আমাদের মনে হয়নি"। তিনি আরও বলেছেন, "আরও প্র্যাকটিসের মধ্য দিয়ে হয়তো এক বা দুটি সংসদ চলার মধ্য দিয়ে এটি এমন একটি অবস্থায় যাবে, যাতে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা যাবে"। জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য ইসলামী দল প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে নারী আসনের বণ্টন চায়।

এই বিতর্কের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সংরক্ষিত আসনে নারীদের সরাসরি নির্বাচন না হওয়ার কারণে তাঁদের প্রকৃত ক্ষমতায়ন হচ্ছে না। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, সংসদে নারীদের উপস্থিতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর প্রতিনিধিত্বে পরিণত হয় না, বরং এটি সাংগঠনিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কারণগুলোর ফলাফল। বাংলাদেশের সংসদে নারী সদস্যরা প্রায়শই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে অর্থপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন না। সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কাঠামোগত বাধা, পেশী রাজনীতি এবং শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের পরিবর্তন গ্রহণে অনীহা এক্ষেত্রে প্রধান বাধা হিসেবে বিবেচিত হয়।

সরাসরি নির্বাচনের পক্ষে সবচেয়ে শক্তিশালী যুক্তি হলো, এটি নারী সংসদ সদস্যদের জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য করবে। হবিগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী, যিনি দশম সংসদে সংরক্ষিত আসনের সদস্য ছিলেন, তিনি বলেছেন, "অনেক অফিসিয়াল অনুষ্ঠানে লোকজন আমাকে জিজ্ঞেস করত আমি কেন সেখানে, যা আমার জন্য খুবই অপমানজনক ছিল... 'সংরক্ষিত আসন' স্ট্যাটাসের কারণে আমি স্থানীয় প্রশাসন থেকেও কোনো সহযোগিতা পেতাম না। তবে সাধারণ আসনে নির্বাচিত হওয়ার পর, আমি আর এই সমস্যাগুলো মোকাবেলা করি না"। এই অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায়, সরাসরি নির্বাচন নারী সংসদ সদস্যদের মর্যাদা ও কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করবে।

অন্যদিকে, সরাসরি নির্বাচনের চ্যালেঞ্জগুলোও উপেক্ষা করা যাবে না। বিএনপির সংগঠন সম্পাদক শামা ওবায়েদ স্বীকার করেছেন যে নারীরা নির্বাচনী এলাকায় বাস্তব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন, যেমন পেশী শক্তি, অর্থ এবং বিভিন্ন সিস্টেমগত বাধা। তবে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নারী প্রার্থীদের সংখ্যা বাড়ানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। নাগরিক কোয়ালিশন প্রস্তাব করেছে যে ২০২৬ সালের নির্বাচনে প্রতিটি রাজনৈতিক দল অন্তত ৩০ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়ন দিক, যা পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে ক্রমান্বয়ে ৪০ শতাংশ এবং ৫০ শতাংশে উন্নীত করা হোক।

উপসংহারে বলা যায়, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে নারীদের প্রতিনিধিত্বের জন্য সরাসরি নির্বাচন পদ্ধতিই সবচেয়ে কার্যকর হবে। এটি নারীদের প্রকৃত ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করবে, তাঁদের জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য করবে এবং তাঁদের মর্যাদা ও কার্যকারিতা বাড়াবে। আমি মনে করি, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত ঘূর্ণমান পদ্ধতিতে ১০০টি আসনে নারীদের সরাসরি নির্বাচন বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বাস্তবসম্মত সমাধান। এর পাশাপাশি, রাজনৈতিক দলগুলোকে সাধারণ আসনে নারী প্রার্থীদের সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাধাগুলো দূর করতে হবে। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত ২০৩০ সালের মধ্যে সংসদে নারীদের প্রতিনিধিত্ব ৫০ শতাংশে উন্নীত করা, যা আমাদের জনসংখ্যার অনুপাতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। এভাবেই আমরা একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক ও সমতাভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব, যেখানে নারীরা সমাজের সকল স্তরে সমান অংশীদার হিসেবে ভূমিকা রাখবেন।

মুমু ২

×