ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৩ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

উন্নয়নকে কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছাতে রাজস্ব আয়ের বিকল্প নেই

ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম

প্রকাশিত: ১৭:৩৫, ১১ জুন ২০২৫

উন্নয়নকে কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছাতে রাজস্ব আয়ের বিকল্প নেই

বাংলাদেশে বর্তমান কর-জিডিপির অনুপাত ৮ শতাংশের নিচে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। দেশে প্রদেয় করদাতার অধিকাংশই শহরকেন্দ্রিক। অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ নেয় সরকার। শর্তস্বরূপ রাজস্ব খাতে বড় ধরনের সংস্কার করতে হয়। বাড়াতে হয় কর জিডিপি। আইএমএফের শর্ত পূরণে দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দশমিক ৫ শতাংশ বাড়তি কর আদায় করতে হবে এটা তাদের শর্ত। এজন্য বাজেটে বাড়তি কর আদায়ের নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়ে থাকে। গ্রামের মানুষকে করজালের আওতায় আনতে উন্নত দেশের মতো বিভিন্ন জেলায় কর এজেন্ট নিয়োগের প্রস্তাবও করা হয়েছে বিগত দিনে। কর এজেন্টরা নতুন করদাতাদের সাহায্য করবে। ই-টিআইএন থাকা সত্ত্বেও যারা যথা সময়ে রিটার্ন জমা দেননি, তাদের রিটার্ন প্রস্তুত করতেও সহায়তা করে সরকার। ইতোপূর্বে বাজেটের অর্থ বিলে ‘ইনকাম ট্যাক্স প্রিপেয়ারার (আইটিপি)’ নামে একটি নিয়ম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যার খসড়াও প্রস্তুত করা হয়েছিল।
কোনো ব্যক্তি শূন্য আয় দেখিয়ে রিটার্ন জমা দিলে স্লিপ বা প্রাপ্তি স্বীকারপত্র পেতে তাকে ন্যূনতম ২ হাজার টাকা কর দিতে হবে। অন্যদিকে আয় ব্যক্তি শ্রেণীর করদাতাদের নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করলে নির্ধারিত হারে আয়কর দিতে হবে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে শূন্য রিটার্ন জমা দিলেও ২ হাজার টাকা আয়কর দেয়ার বিধান রাখছে রাজস্ব বোর্ড। রিটার্ন জমার স্লিপ না নিলে ৪৪ ধরনের সরকারি-বেসরকারি সেবা পাওয়া যাবে না, এমন নীতিও চালু করা হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকে শূন্য রিটার্ন জমা (করযোগ্য আয় না দেখিয়ে রিটার্ন জমা) দিলেও ২ হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে- এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
বিদ্যমান ৩৮ ধরনের সেবার বাইরে নতুন আরও ছয় ধরনের সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে রিটার্ন জমার রসিদ বা ‘প্রুফ অব সাবমিশন অব রিটার্ন’ বা পিএসআর বাধ্যতামূলক করা হয়। করের আওতা বাড়াতে মূলত অনেকটা বাধ্য হয়েই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। সেবা নিতে করদাতাদের রিটার্ন জমার রসিদ দেখানোর এ বিধান আরও কঠোর করা হয়। করযোগ্য আয় থাকুক আর না-ই থাকুক, ন্যূনতম ২ হাজার টাকা কর দিয়ে রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। ন্যূনতম এ কর না দিলে মিলবে না সরকারি-বেসরকারি এসব সেবা। 
কোনো করদাতা ন্যূনতম কর না দিলে সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো এসব সেবা দিতে পারবে না। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে নতুন আয়কর আইনের মাধ্যমে এ বিধান যুক্ত করা হয়। বাজেটে এ তালিকায় আরও যুক্ত হয় দলিল লেখক হিসেবে নিবন্ধনে; স্ট্যাম্প এবং কোর্ট ফির ভেন্ডর হিসেবে নিবন্ধনে, পৌরসভায় ১০ লাখ টাকা মূল্যের জমি বিক্রয় এবং লিজ রেজিস্ট্রেশনের সময়। ভূমি ও ভবন লিজ রেজিস্ট্রেশনের সময়ও পিএসআরের শর্ত দেওয়া হয়। এছাড়া যে কোনো ধরনের সোসাইটি, সমবায়, ট্রাস্ট, ফান্ড, ফাউন্ডেশন, এনজিও এবং মাইক্রোক্রেডিট অর্গানাইজেশনের ব্যাংক হিসাব খোলা ও চালু রাখতে এবং নির্দিষ্ট ব্যক্তি কর্তৃক সিটি করপোরেশন এলাকায় বাড়ি ভাড়া বা লিজ গ্রহণের সময় বাড়ির মালিকের পিএসআরের বাধ্যবাধকতা আসে।
করের আওতা বাড়ানোর মাধ্যমে কর আদায় বাড়াতে এনবিআর জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে গত কয়েক বছরে বিপুলসংখ্যক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর বা টিআইএন রেজিস্ট্রেশনের আওতায় এনেছে এনবিআর। তবে টিআইএনের আওতায় আনা হলেও রিটার্ন জমায় কাক্সিক্ষত সাড়া মিলছিল না। এমন পরিস্থিতির মধ্যে গত বছরের বাজেটে ৩৮টি খাতের সেবা নেওয়ার সময় রিটার্ন জমার প্রমাণ বা পিএসআর বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু তাতেও রিটার্ন জমার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অগ্রগতি হয়নি। এবার আগের ৩৮টির সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে আরও ছয়টি সেবা খাত।
দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে ও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির বিকল্প নেই। মানুষকে আয় চক্রের মধ্যে আনতে হবে। দেশের প্রত্যেক এনআইডিধারীকেই ট্যাক্স রিটার্ন বাধ্যতামূলক করতে হবে। যাদের সামর্থ্য নেই, প্রয়োজনে তারা শূন্য রিটার্ন জমা দেবেন। কিন্তু রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। শুধু এ ৪৪ ধরনের নয়, সরকারি প্রত্যেক সেবার জন্যই, এমনকি শিশুদের স্কুলে ভর্তি বা টিকা দেওয়ার সময়ও ট্যাক্স রিটার্ন স্লিপ শো করা বাধ্যতামূলক করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে যেমন সামাজিক নিরাপত্তা কার্ড দেখিয়ে নাগরিকরা সব সেবা নিতে পারে, আমাদের এখানে সেরকম ট্যাক্স রিটার্ন স্লিপ দেখিয়ে সেবা নিতে পারবেন।
প্রত্যেক নাগরিক যারই জাতীয় পরিচয়পত্র আছে, তাদের ট্যাক্স রিটার্ন দিতে হবে। তাহলে ট্যাক্স রিটার্ন রাতারাতি কয়েকগুণ বাড়বে। ২০ হাজার টাকার বেশি প্রত্যেক লেনদেন (বাড়ি ভাড়া, কনসালট্যান্সি, ফ্রি ল্যান্সিং, পার্টটাইম জব প্রভৃতি) ব্যাংক বা চেকের মাধ্যমে করতে হবে। তাহলে ট্যাক্সের পরিমাণ ও পরিধি বাড়বে। 
রিটার্ন জমা দেওয়া মানেই যে কর জমা দিতে হবে, তা নয়। যাদের টাকা নেই, তারা শুধু রিটার্ন জমা দেবেন। শুধু মুখে বললে তো আর উন্নত দেশ হওয়া যাবে না। উন্নত দেশের মতো রাজস্ব আহরণ করতে হবে। তাদের মতো প্রত্যেক নাগরিককে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। প্রতি জেলা-উপজেলা পর্যায়ে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এ খাতে জনবল বাড়াতে হবে। দেশের প্রতিটি মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে যেতে হবে রাজস্ব বোর্ডকে। তবে ট্যাক্স রিটার্ন পদ্ধতিটা যেন সহজ হয়, সে ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে। মানুষের ভোগান্তি এড়াতে হবে। ট্যাক্স ভীতি দূর করতে হবে। মানুষকে বোঝাতে হবে নিজেদের ভালোর জন্যই ট্যাক্স রিটার্ন জমা দিতে হবে সবাইকে। নাগরিকদের বোঝাতে হবে, সরকারের নিজস্ব কোনো টাকা নেই। রাষ্ট্রের নাগরিকরাই মূলত রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা ও অর্থের উৎস। বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় হচ্ছে দিনকে দিন। বাড়ছে বাড়তি ব্যয়ের চাপ। এ চাপ সামলে উন্নয়নকে তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে রাজস্ব আয়ের বিকল্প নেই।

লেখক : সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান-ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন

প্যানেল

×