
ছবি:সংগৃহীত
মেঘনা নদীর ওপর আরও একটি বিকল্প সেতু নির্মাণ করছে সরকার, যা ঢাকার সঙ্গে পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর যোগাযোগ আরও সহজ করে তুলবে। সেতুটি নির্মাণ হলে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার মধ্যে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপন হবে, যা ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বিকল্প অ্যালাইনমেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পরিবর্তনের সময় এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে সন্দেহ ছিল যে, আদৌ তৃতীয় মেঘনা সেতুটি হবে কি না। তবে সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও সেতু বিভাগের একাধিক বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, শুরুতে একটি কোরিয়ান কোম্পানি অর্থ সহায়তা দিতে চাইলেও সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তারা সরে দাঁড়ায়। এরপর জাপানের কয়েকটি বেসরকারি কোম্পানি কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সেতুটি নির্মাণে প্রাথমিকভাবে সম্মতি জানিয়েছে।
সেতুটি জাপানের সহায়তায় পিপিপি (PPP) এবং জি-টু-জি (G2G) ভিত্তিতে নির্মিত হবে। বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকবে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। সেতুর উভয় পাশে সংযোগ সড়ক নির্মাণ করবে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)।
জানা গেছে, ভুলতা–আড়াইহাজার–বাঞ্ছারামপুর সড়কের কড়াইকান্দি ফেরিঘাটের ১০০ মিটার উজানে নির্মিত হবে তৃতীয় মেঘনা সেতুটি। এর দৈর্ঘ্য হবে ৩.১৩ কিলোমিটার এবং উভয় পাশে ৪.৪ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মিত হবে। নৌযান চলাচলের সুবিধার্থে সেতুর ভার্টিক্যাল ক্লিয়ারেন্স ধরা হয়েছে ১৮.৩০ মিটার।
বাংলাদেশ সেতু বিভাগ তাদের ওয়েবসাইটে জানিয়েছে, ভুলতা–আড়াইহাজার–বাঞ্ছারামপুর সড়কের বিশনন্দী-কড়াইকান্দি ফেরির মাধ্যমে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর ও নবীনগরের সঙ্গে ঢাকা ও অন্যান্য জেলার সড়ক যোগাযোগ চালু রয়েছে। এটি সময়সাপেক্ষ এবং দুর্যোগকালে ঝুঁকিপূর্ণ। এ বাস্তবতা বিবেচনায় সেতু নির্মাণে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ২০২০ সালের মার্চ মাসে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন করে।
অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির ২০২০ সালের ১৯ আগস্টের সভায় প্রকল্পটি পিপিপি পদ্ধতিতে বাস্তবায়নের বিষয়ে নীতিগত অনুমোদন পায়। পরবর্তীতে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান এপ্রিল ২০২২ মাসে তাদের নিজস্ব সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন করে। সেতুটির ধরন হবে Extradosed concrete box girder bridge, যার প্রধান স্প্যান ২০০ মিটার। প্রকল্পের VGF প্রস্তাব অর্থ বিভাগ কর্তৃক নীতিগতভাবে অনুমোদিত হয়েছে। বিনিয়োগকারীর বরাবর ১০ মার্চ ২০২৪ তারিখে RFP ইস্যু করা হয় এবং RFP দাখিলের শেষ সময় ছিল ১০ মে ২০২৫।
এই সেতুটি নির্মাণের ফলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর ও নবীনগরের সঙ্গে ঢাকার সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হবে এবং এটি ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বিকল্প রুট হিসেবে ব্যবহৃত হবে। ফলে ঢাকা থেকে আড়াইহাজার–বাঞ্ছারামপুর হয়ে আখাউড়া বন্দরের দূরত্ব উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে।
বর্তমানে বিশনন্দী–কড়াইকান্দি ফেরির মাধ্যমে যোগাযোগ করতে হয়, যা দুর্যোগকালীন সময়ে ঝুঁকিপূর্ণ ও সময়সাপেক্ষ। দীর্ঘদিন ধরেই এই সেতুটি নির্মাণের দাবি উঠছিল। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, জাপান ইঞ্জিনিয়ারিং এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশনের সমন্বয়ে গঠিত কনসোর্টিয়াম ২০২৫ সালের মধ্যেই বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কনসেশন চুক্তি স্বাক্ষরের পরিকল্পনা করেছে।
জানা গেছে, এই সেতুটি নির্মিত হলে ঢাকা-সিলেটের ২২ কিলোমিটার ও ঢাকা-চট্টগ্রামের ২৭ কিলোমিটার দূরত্ব কমে যাবে। এ অঞ্চলে গড়ে উঠবে নতুন শিল্প-কারখানা। দক্ষিণ কোরিয়ার সহায়তায় নতুন সড়ক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সওজ, যা সেতুটির ব্যবহার বাড়াতে সহায়ক হবে। এতে বাঞ্ছারামপুর–নবীনগর–আখাউড়া হয়ে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ আরও সহজ হবে, যাত্রী ও পণ্য পরিবহন বাড়বে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের এক সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বহুদিন ধরেই এই সেতু নির্মাণের চেষ্টা চলছে। সেতুর পাশাপাশি সরকার সড়ক নির্মাণেও জোর দিচ্ছে। ফলে আড়াইহাজার–বাঞ্ছারামপুর হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ভারতের আগরতলার দূরত্বও কমবে।
সরকারি অর্থায়নে সওজের অধীনে ৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ দুই লেনের একটি সড়ক নির্মাণ করা হবে, যা নারায়ণগঞ্জের ভুলতা থেকে কড়িকান্দি ফেরিঘাট হয়ে নবীনগর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। এটি সওজের কুমিল্লা জোনের আওতায় উন্নয়ন করা হবে। এ সংক্রান্ত প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনের মাধ্যমে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
এছাড়া, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে ভুলতা–বাঞ্ছারামপুর–রাধিকা সড়ক নির্মিত হবে, যা কুমিল্লার মুরাদনগর-কোম্পানীগঞ্জ সড়ককে যুক্ত করবে। ভবিষ্যতে ভুলতা–আড়াইহাজার–বাঞ্ছারামপুর–নবীনগর–শিবপুর–রাধিকা মহাসড়ক হিসেবে উন্নীত হবে, যার দৈর্ঘ্য হবে ৮০ কিলোমিটার। অপরদিকে, বাঞ্ছারামপুর–মুরাদনগর–কোম্পানীগঞ্জ সড়কটি হবে ২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ, যা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিকল্প রুট হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
ভুলতা থেকে কোম্পানীগঞ্জ হয়ে ময়নামতির দূরত্ব ৮৯ কিলোমিটার এবং ভুলতা থেকে মদনপুর হয়ে ময়নামতির দূরত্ব ৮৩ কিলোমিটার। এছাড়া, ভুলতা–মুরাদনগর (কোম্পানীগঞ্জ) সড়কটি ঢাকা–সিলেট মহাসড়ক ও কুমিল্লা–ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহাসড়ককে সংযুক্ত করবে। এটি আখাউড়া স্থলবন্দরের একটি বিকল্প সংযোগ রুট হবে। ফলে কুমিল্লা হয়ে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার যাতায়াত এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে আখাউড়া স্থলবন্দরে যাতায়াত সহজতর হবে।
বর্তমানে Road Transport Connectivity Improvement Project Preparatory Facility প্রকল্পের আওতায় সওজের ২৩টি সড়কে প্রায় ১,৭১১ কিলোমিটার এলাকায় সমীক্ষা ও বিশদ নকশার কাজ চলছে, যার অধিকাংশই সম্পন্ন হয়েছে। এ ছাড়াও ভারতের Line of Credit (LOC) অর্থায়নে আশুগঞ্জ–ধরখার–আখাউড়া সড়ক চার লেনে উন্নীত হয়েছে এবং পৃথক প্রকল্পে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেনে উন্নয়নাধীন।
সব মিলিয়ে প্রস্তাবিত এই সেতু ও সংশ্লিষ্ট সড়কগুলো নির্মিত হলে আখাউড়া স্থলবন্দর হয়ে ভারতের আগরতলা ও সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাপকভাবে বাড়বে। এতে আমদানি-রপ্তানির নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে।
সওজ বিভাগ জানায়, মেঘনা নদীর তৃতীয় সেতুটি বাস্তবায়ন করবে সেতু বিভাগ, আর এর সঙ্গে সংযুক্ত সড়কগুলো নির্মাণ করবে সওজ। এ প্রকল্পের সুফল পাবে সমগ্র দেশ।
আশা করা যাচ্ছে, প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে নির্মিতব্য এই তৃতীয় মেঘনা সেতুর কাজ ২০২৫ সালের মধ্যেই শুরু হতে পারে।
মারিয়া