ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৩ জুন ২০২৫, ২৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে হার বাংলাদেশের

সাকিবুল হাছান

প্রকাশিত: ১৭:০২, ১১ জুন ২০২৫

সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে হার বাংলাদেশের

১০ জুন ২০২৫, বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে ২-১ গোলে হেরে যাওয়ার পর বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের মনে আবারও এক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে- আমরা আসলে কোথায় দাঁড়িয়ে? ফুটবল এখনো কি আমাদের সম্ভাবনার খেলা, নাকি শুধুই ব্যর্থ প্রত্যাশার পুনরাবৃত্তি?
বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০২৩ সালের পর থেকে আমরা ১৮টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে জয় পেয়েছি মাত্র ৪টিতে। গোল হজম করেছি ২৭টি এবং করেছি ১১টি। তার মানে প্রতিটি ম্যাচে গড়ে ১.৫ গোল হজম এবং মাত্র ০.৬১ গোল করার রেকর্ড রয়েছে। এবারের সিঙ্গাপুর ম্যাচেও সেই প্রবণতা বজায় থাকল। প্রথমার্ধের শেষ মুহূর্তে ও দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে দুটি গোল হজম করে রাকিব হোসেনের একটি গোলে ব্যবধান কমানো ছাড়া কিছুই করতে পারেনি বাংলাদেশ। তাহলে সমস্যাগুলো কোথায়? 
পরিকল্পনার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। মাঠে নেমে মনে হয়, বাংলাদেশের কোনো দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নেই। একাদশ নির্বাচন থেকে শুরু করে পজিশনিং, প্রতিপক্ষ বিশ্লেষণ এবং ম্যাচ কন্ট্রোল সব ক্ষেত্রেই আমরা অপরিণত। সিঙ্গাপুর যেখানে মিডফিল্ড ঘন করে রেখেছিল এবং বল পজিশনের ওপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছিল, সেখানে বাংলাদেশ বারবার লং বল ও উইং নির্ভর আক্রমণের চেষ্টা করেছে। এর ফলে খেলা ছন্দহীন ও এলোমেলো হয়ে পড়ে। সিঙ্গাপুরের দুটি গোলই এসেছে সেট-পিস থেকে- একটি কর্নার ও একটি ফ্রি-কিক। এটি প্রমাণ করে, আমাদের ডিফেন্ডারদের এয়ারিয়াল কভারেজ ও ট্যাকটিকাল রিডিং যথেষ্ট নয়। দীর্ঘদিন ধরে এই সমস্যা থেকে আমরা মুক্তি পাইনি। গোল হজম করার পর দলের আত্মবিশ্বাস দ্রুত ভেঙে পড়ে। সিঙ্গাপুরের দ্বিতীয় গোলের পর মাঠে এক ধরনের হতোদ্যমতা দেখা গেছে, যেটা আন্তর্জাতিক মানের কোনো দলের উচিত নয়।
সবকিছুই যে নেতিবাচক, তা নয়। এই ম্যাচে কিছু ইতিবাচক দিকও ছিল, যেগুলো আমাদের ভবিষ্যতের জন্য আশাবাদী করে তোলে। অভিষিক্ত মিডফিল্ডার শমিত শোম অনেক বেশি বল টাচ করেছেন এবং বল কন্ট্রোলে আগ্রহী ছিলেন। রাকিব হোসেনের গোলও একটি ট্যাকটিক্যাল ফিনিশিংয়ের উদাহরণ। এছাড়াও ডানপাশের ডিফেন্ডার রিয়াজুল ইসলাম ধারাবাহিকভাবে ড়াবৎষধঢ়ঢ়রহম করেছেন এবং দুই-একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্যাকলও করেছেন।
দীর্ঘদিন পর আবারও বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম প্রায় পূর্ণ ছিল। প্রায় ৩৫,০০০ দর্শক উপস্থিত থেকে দলকে সমর্থন দিয়েছেন, যা ফুটবলের পুনরুজ্জীবনের ইঙ্গিত দেয়। দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশ ম্যাচে ফিরতে চেয়েছিল। আগের দিনের মতো একেবারে আত্মসমর্পণ করেনি। যদিও ফল পক্ষে আসেনি, তবে মানসিকতায় পরিবর্তনের আভাস দেখা গেছে। তবে এখন ফুটবলে বাংলাদেশের করণীয় কি? 
আমাদের ফুটবল ফেডারেশনকে আগামী পাঁচ বছরের জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। কোচিং স্টাফে আধুনিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিদেশি ও দেশি কোচদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং একাডেমিক কোচিংকে গুরুত্ব দিতে হবে। বিপিএলে মানসম্মত বিদেশি খেলোয়াড় আনা, ঘরোয়া ক্লাবগুলোর আর্থিক স্বচ্ছতা এবং যুব দলের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। প্রতিভা আসবে ঘর থেকেই।
আমরা হামজা চৌধুরী কথা বলতে পারি, যিনি সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে ম্যাচেও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বল ছিনিয়ে নেন এবং মাঝমাঠে চাপ কমাতে বল ঘোরানোর কাজটি সফলভাবে করেছেন। যদিও দলের সার্বিক ছন্দ ঠিক ছিল না, কিন্তু হামজার মধ্যে ‘গ্লু প্লেয়ার’-এর ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। ইউরোপীয় ফুটবলে বেড়ে ওঠা এই মিডফিল্ডার জানেন কীভাবে চাপ সামাল দিতে হয়। বাংলাদেশি তরুণ ফুটবলারদের জন্য তিনি এক দৃষ্টান্ত। প্রবাসী হয়েও দেশের জন্য খেলার সিদ্ধান্ত, দেশের ফুটবলকে গুরুত্ব দেওয়ার মানসিকতা নিঃসন্দেহে অনুপ্রেরণাদায়ী। তার মাধ্যমে বাংলাদেশ ফুটবল কিছুটা হলেও আন্তর্জাতিক সংবাদ ও আলোচনার অংশ হতে শুরু করেছে, যা ভবিষ্যতে আরও বিদেশি-বংশোদ্ভূত খেলোয়াড়দের আকৃষ্ট করতে পারে। যদি বাংলাদেশ জাতীয় দল দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় থাকে এবং হামজাকে কেন্দ্র করে একটি মিডফিল্ড গঠন করে, তাহলে তিনি হতে পারেন ভবিষ্যতের ক্যাপ্টেন। অভিজ্ঞতা, নেতৃত্বগুণ এবং একাগ্রতায় তিনি বাংলাদেশের ফুটবল সংস্কৃতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারেন।
প্রতিটি প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আলাদা কৌশল প্রণয়ন। খেলোয়াড়দের ফর্ম ও ফিটনেস যাচাই এবং পরিসংখ্যান নির্ভর বিশ্লেষণ ছাড়া আন্তর্জাতিক মানে পা রাখা অসম্ভব। ফুটবল কেবল পা দিয়ে নয়, মাথা ও হৃদয় দিয়ে খেলা হয়। আমাদের খেলোয়াড়দের মধ্যে সেই আত্মবিশ্বাস ও জয়ের ক্ষুধা গড়ে তুলতে হবে, যা প্রতিটি পাস ও ট্যাকলে ফুটে ওঠে।
বাংলাদেশ ফুটবল এখনো মৃত নয়। হয়তো সে ঘুমিয়ে আছে। প্রয়োজন একটি সংগঠিত উদ্যোগ, সাহসী পরিকল্পনা ও আন্তরিক প্রচেষ্টা, যা শুধু মাঠে নয়, প্রশাসনিক কাঠামোতেও দরকার। সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে হার আমাদের ব্যর্থতা দেখিয়েছে, কিন্তু একই সঙ্গে আমাদের সামনে সম্ভাবনার দরজাও খুলে দিয়েছে। প্রশ্ন একটাই, আমরা কি সেই দরজা ঠেলে এগিয়ে যেতে পারব?

ঢাকা কলেজ, ঢাকা 
[email protected]

প্যানেল

×