
ঈদ একটি ছোট শব্দ। কিন্তু এর মাঝে লুকিয়ে থাকে মুসলমানদের অজস্র আবেগ, আত্মত্যাগ, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সর্বোপরি আনন্দের ছোঁয়া। রমজানের সিয়াম সাধনার শেষে ঈদুল ফিতর কিংবা কোরবানির চেতনা থেকে আসা ঈদুল আজহাÑ প্রত্যেক ঈদই আমাদের আত্মিক প্রশান্তি ও সামাজিক বন্ধনের এক অনন্য উপলক্ষ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আজকাল ঈদের সেই আনন্দ বহু পরিবারের জন্য পরিণত হচ্ছে চিরস্থায়ী বিষাদে। রাস্তায় ঝরে পড়ে প্রাণ, হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে অঙ্গহানির শিকার তরুণ, আর শোকবিহ্বল স্বজনেরা ঈদের দিনই হারাচ্ছে প্রিয়জন।
সড়ক যেন মৃত্যুর ফাঁদ না হয়
বিগত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ঈদের ছুটি শুরুর আগের দিন থেকে ঈদের পরে প্রায় ৭-১০ দিন পর্যন্ত দেশের সড়কে দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়ে যায় আশঙ্কাজনক হারে। ২০২৪ সালের ঈদের সময় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৩৯৮ জন এবং আহত হয়েছে ৬০০-এর বেশি মানুষ (সূত্র: রোড সেফটি ফাউন্ডেশন)। তাদের মধ্যে অধিকাংশই বাইকচালক বা বাইক-যাত্রী, যাদের মধ্যে অধিকাংশ ছিল তরুণ। নতুন মোটরসাইকেল কিনে ঈদের আনন্দে আত্মহারা তরুণদের কেউ কেউ বেপরোয়া গতিতে চালিয়ে বিপদের কারণ হন নিজের ও অন্যের জন্য।
হেলমেটবিহীন ঝুঁকি ও বেপরোয়া মনোভাব
সড়কে সচেতনতা যতটা প্রয়োজন, ঈদের সময় সেই অনুশীলন যেন প্রায় হারিয়ে যায়। হেলমেট ছাড়া বাইক চালানো, এক বাইকে তিন-চার জন ওঠা, শিশুদের কোলে বসিয়ে চালানো, দ্রুতগতিতে স্টান্ট দেখানো, ভিডিও বা সেলফি তুলতে তুলতে চালানোÑ এসব যেন এখন ঈদের ‘ট্রেন্ড’ হয়ে উঠেছে। অথচ একটি মুহূর্তের অসতর্কতা পুরো জীবনকেই অন্ধকারে ডুবিয়ে দিতে পারে। এই আচরণ শুধু চালকের নিজের জীবনের ঝুঁঁকি নয়, পথচারী ও অন্য গাড়ির চালকদের জীবনও ফেলে হুমকিতে।
আনন্দের ঈদ শোকে পরিণত না হোক
ঈদের দিনের সকালেই কত পরিবার প্রিয়জনের লাশ নিয়ে বাড়ি ফেরে। ঈদের জামা পড়া, মেহেদি লাগানো তরুণ-তরুণীরা হয়তো তাদের জীবনের শেষ ঈদ উদযাপন করে ফেলেন। কেবল একটি ভুল, একটি বেপরোয়া মুহূর্তÑ এসব দুঃখজনক ঘটনার জন্ম দেয়। অথচ ঈদের সারমর্মই ছিল আত্মনিয়ন্ত্রণ, সংযম ও আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে নিজেকে উৎসর্গ করা। যারা সিয়াম পালন করলেন, নামাজ পড়লেন, আল্লাহকে খুশি করতে চাইলেনÑ তারা কিভাবে ঈদের দিনেই নিজের ও অন্যের জীবনের প্রতি এমন অবহেলা করতে পারেন?
করণীয় ও সামাজিক দায়িত্ব
১. বাইক চালানোর আগে হেলমেট পরা এবং অতিরিক্ত যাত্রী না তোলা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
২. অভিভাবকদের উচিত সন্তানের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা। যেন তারা লাইসেন্সবিহীন বা অপ্রশিক্ষিত অবস্থায় বাইক না চালায়।
৩. সরকারি পর্যায়ে ঈদের আগেই সড়ক নিরাপত্তা প্রচারণা বাড়ানো দরকার, স্থানীয় মসজিদ বা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পৃক্ত করে।
৪. মিডিয়া ও সামাজিক মাধ্যমে ‘সেফ ঈদ ট্রাভেল’ ক্যাম্পেইন জোরদার করা উচিত, যাতে তরুণদের মাঝে সচেতনতা গড়ে ওঠে।
৫. ইমাম ও আলেমদের উচিত খুতবায় ঈদের দিন সড়ক সচেতনতা ও জীবন রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা।
ঈদের পরও থাকে জীবন
আমরা যেন ভুলে না যাই, ঈদের আনন্দ একটি দিনের, কিন্তু জীবনটা দীর্ঘ। এই সুন্দর পৃথিবীতে আল্লাহ আমাদের পাঠিয়েছেন পরীক্ষা ও আমানত হিসেবে। সেই জীবন যদি আমরা নিজের হাতেই ধ্বংস করে ফেলি, তবে তা কেবল আত্মঘাতী নয়, বরং মহান আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শামিল। জীবন রক্ষা করা ইমানের অংশÑ এই বোধটি ফিরিয়ে আনা আমাদের সকলেরই দায়িত্ব।
ঈদ মানেই উৎসব, ঈদ মানেই আনন্দ। তবে সেই আনন্দ যদি হয়ে ওঠে মৃত্যুর সংবাদ, তবে তা কেবল পরিবার নয়, পুরো জাতির জন্যই শোকের। চলুন, সবাই আমরা প্রতিজ্ঞা করি, সড়কে করব না কোনো ভুল, মানবজীবনের মূল্য বুঝব এবং ঈদের আনন্দকে সত্যিকার অর্থেই পূর্ণতা দেব আমাদের সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ দিয়ে। ঈদের পরবর্তী আনন্দ যেন আর কখনোই বিষাদ বা দুঃখে পরিণত না হয়, এই হোক আমাদের ইমানি অঙ্গীকার।
লেখক : শিক্ষক
প্যানেল