
ড. মুহাম্মদ ইউনূস, তারেক রহমান
দৃষ্টি সবার লন্ডনে। বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্কট সমাধান হতে যাচ্ছে দেশটিতে। তৈরি হবে ভবিষ্যৎ রাজনীতির রূপরেখাও। দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকসহ বাংলাদেশি সকল নাগরিকের অপেক্ষা সকালের। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও দীর্ঘ সময় লন্ডনে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে ঐতিহাসিক বৈঠকটি হতে যাচ্ছে।
আজ শুক্রবার লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। স্থানীয় সময় সকাল ৯টা-১১টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টা এই বৈঠক চলবে। বৈঠককে কেন্দ্র করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ইতোমধ্যে লন্ডন পৌঁছেছেন। তিনিও বৈঠকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে দলীয় প্রতিনিধিদলের অংশ হিসেবে আগে-পরে সৌজন্যতায় যুক্ত থাকবেন। তবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের মূল বৈঠকটি হবে কার্যত ‘ওয়ান টু ওয়ান।
সেই রুদ্ধদ্বার বৈঠকে দুজন ছাড়া কেউ থাকতে পারবে না। সেখানে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির আঁধার সমঝোতার মাধ্যমে কেটে যেতে পারে বলেও ধারণা করছেন রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। একই সঙ্গে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির রূপরেখাও তৈরি পারে। আলোচনা যদি ফলপ্রসূ হয় তাহলে বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য বয়ে আনবে সুবাতাস। সূচিত হবে গণতন্ত্রের নতুন অধ্যায়। অনেকেই এমন ধারণা করছেন।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের পর দেশের নাগরিকদের সমর্থনে গত প্রায় ১০ মাস দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। ইতোমধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতায় কয়েক দফায় বিএনপিসহ সকল রাজনৈতিক দলের প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করেছে সরকার। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যরা বৈঠকে অংশ নেয়। সেখানে চলমান রাজনীতির সঙ্কট ও ভবিষ্যৎ নির্বাচন আয়োজনের প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। তবে বিএনপির হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে তারেক রহমান লন্ডনে থাকায় বৈঠকে অংশ নেওয়া সম্ভব হয়নি। অবশেষে বিদেশের মাটিতে রাষ্ট্রীয় সফরের ফাঁকে দেশের রাজনীতির চলমান সঙ্কট ও ভবিষ্যৎ রূপরেখা নির্ধারণে তারেক রহমানের জন্য সুযোগের দরজা খুলেছে সরকার।
সরকারে নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দলের প্রধানের কাছে অন্য সকল রাজনৈতিক দল ও গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র-জনতার চাওয়া চাহিদার বিষয়গুলোও সরকারের পক্ষ থেকে তুলে ধরা হবে। গত কয়েকমাস রাজনৈতিক সংলাপে অন্য রাজনৈতিক দলগুলো ও অভ্যুত্থানের নায়কেরা কী তুলে ধরেছেন। সরকারকে কী জানিয়েছেন সেটি জানানো হবে। ইতোমধ্যে সরকার একটি নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। সেখানে বিএনপি প্রকাশ্যে বিরোধিতা করছে। কেন করা হচ্ছে তার মৌলিক কারণ বা যৌক্তিকতা কী জানতে চাওয়া হবে।
গতানুগতিক নির্বাচনের বাইরে দেশের সিংহভাগ রাজনৈতিক দল গণপরিষদ নির্বাচন চেয়েছে সেখানে বিএনপির ভাষ্য বা চাওয়া কী থাকবে? একই সঙ্গে দুই হাজার ছাত্র-জনতা শহীদ ও ৫০ হাজার আহত যোদ্ধারা সরকারের কাছে জুলাই সনদপত্র চেয়েছে। এ ব্যাপারে বিএনপির পক্ষ থেকে কী সহযোগিতা থাকবে সেটিও জানতে চাওয়া হবে। বিশেষ করে ড. ইউনূস সরকারের কাছে শহীদ পরিবার লিখিতভাবে আবেদন জানিয়েছে, জুলাই গণহত্যার বিচারের আগে তারা কেউ নির্বাচন চায় না। শহীদ পরিবার আগে সন্তান হত্যার বিচার এবং গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়ার পূর্ণ রোডম্যাপ চায়। এ ক্ষেত্রে সরকারকে বিএনপির পক্ষ থেকে কী সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হবে সেগুলোও প্রাধান্য পাবে বৈঠকে। ড. ইউনূস শুধু দেশের জনগণের জিম্মাদারি পালন করছেন; তিনি ক্ষমতায় থাকতে বা নির্বাচন বিলম্ব করতে তার কোনো আগ্রহ নেই সেটি তারেক রহমানকে আশ্বস্ত করবেন।
এদিকে বিএনপির হাইকমান্ডের বিশ্বস্ত সূত্রগুলো বলছে, বৈঠকের বিষয় নিয়ে ইতোমধ্যে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়েছে। বড় অংশই দলের অবস্থান লিখিতভাবে জানাতে পরামর্শ দিয়েছেন তারেক রহমানকে। তার আলোকে সরকার ঘোষিত নির্বাচনের রোডম্যাপ থেকে সরে কিভাবে আগাম নির্বাচন করতে পারে তা দলের পক্ষ থেকে জানানো হবে। সংস্কার এবং বিচার চলমান প্রক্রিয়াÑ এ দুটোর জন্য নির্বাচন কোনোভাবেই বিলম্বিত করা যাবে না; দলের ভাষ্য তুলে ধরা হবে। একই সঙ্গে সাবেক সেনাপ্রধানের পুত্র ও একজন রাজনীতিক হিসেবে তারেক রহমানের দেশে ফেরার নিরাপত্তা কিভাবে দেওয়া হবে তার বক্তব্যও জানতে চাওয়া হবে।
তবে রাজনীতিতে চোখ রাখা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ড. ইউনূসের রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের উদ্যোগ যুগ যুগ ধরে মাইলফলক হয়ে থাকবে। এই আলোচনা যদি সফল হয় তাহলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য ভালো কিছু অপেক্ষা করছে। আর যদি সফল না হয় তাহলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য অন্ধকার রয়েছে এটিও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে দীর্ঘ সময় গবেষণা করে আসছেন যিনি এখন তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা। জানতে চাইলে তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, “ইতোমধ্যে আপনারা দেখেছেন গণহত্যা চালিয়ে হাজার মানুষকে হত্যা ও পঙ্গু করে হাসিনা ও তার সরকারের অনেকে পালিয়ে গেছেন। অনেকে কারাগারে আছেন। এমন খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে দেশের জনগণের পক্ষ থেকে ড. ইউনূস বড় দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। দফায় দফায় দেশের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন যখনি কোনো সঙ্কট সামনে এসেছে। এখন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে।
তাই সরকার মনে করছে বিএনপির হাইক্মান্ডের প্রধানের সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন। তাই লন্ডনে রাষ্ট্রীয় সফরের ফাঁকে সেই সুযোগের দরজা খোলা রয়েছে বিএনপির জন্য। এই আলোচনা যদি সফল হয় তাহলে বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য অনেক সুফল অপেক্ষায় করছে। আর যদি সঙ্কট সমাধানে বৈঠকে আলোর মুখ দেখা না হয় তাহলে বিএনপির জন্য ক্ষতির আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
উল্লেখ্য, সোমবার যুক্তরাজ্যে যাওয়ার আগে, গত শুক্রবার জাতির উদ্দেশে ঈদুল আজহার ভাষণে ড. ইউনূস বলেন, প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে বিএনপি এই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে অনড়। দলটির দাবি, সংস্কারগুলো এর অনেক আগেই বাস্তবায়ন সম্ভব। এ নিয়ে সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একটি জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে ভার্চুয়ালি যোগ দেন তারেক রহমান। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেওয়ার বিষয়ে আলাদা করে সবার মতামত নেওয়া হয়।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ বিষয়ে জানান, চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই বৈঠক ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হতে পারে । জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে এই বৈঠকের গুরুত্ব ও সম্ভাবনা অনেক। এই বৈঠক থেকে অনেক কিছুর ডাইমেনশন হতে পারে। এ ছাড়াও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়ে খালেদা জিয়ার বার্তার বিষয় নিয়েও আলোচনা করেন। ‘বিরোধ নয় সঙ্কট সমাধানে আলোচনাই শ্রেয়। সে পথেই হাঁটতে হবে’ বিএনপি চেয়ারপারসনের এমন নির্দেশনায় করণীয় কী তাও খোঁজা হয়।
আজকে লন্ডনে ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠক নিয়ে জানতে চাইলে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বলেন, আমার বিশ্বাস তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ ফলপ্রসূ হবে। নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার এবং জুলাই সনদসহ অনেক বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও বিএনপির যে দূরত্ব বা মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে, সেটা কমে আসতে পারে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী বলেন, ড. ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকে নির্বাচন, সংস্কার ও গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি রাজনৈতিক আলোচনা অবশ্যই হবে। আমরা আশা করি প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের তারিখ সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবেন এবং দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি এবং বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা করবেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, নির্বাচনই হবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দলের অবস্থান তুলে ধরবেন। ডিসেম্বর নির্বাচনের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। আমরা আশা করি, এই বৈঠক ইতিবাচক রাজনৈতিক অগ্রগতির পথ দেখাবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, বর্তমান সময়ে তারেক রহমান এবং মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যকার বৈঠকটি ‘অত্যন্ত ইতিবাচক পদক্ষেপ। অতীতে যারাই ক্ষমতায় ছিলেন রাজনৈতিক সঙ্কটে এমন বৈঠক করতে দেখা যায়নি। যা ড. ইউনূস সরকার করছে। এই বৈঠক ভুল বোঝাবুঝি নিরসন, রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা এবং উত্তেজনা প্রশমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে আমি মনে করছি।
আমার ধারণা, বৈঠকটির মাধ্যমে ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য একটি পথ খুলে দিতে পারে এবং রাজনৈতিক দৃশ্যপট পুনর্গঠন করতে পারে। বিএনপির ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি কিছুটা নমনীয় হতে পারে, যেহেতু ইউনূস সরাসরি বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসছেন। এটাই ইতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতির নিদর্শন। ড. ইউনূস যেভাবে এই উদারতা, সংস্কৃতির যাত্রা শুরু করেছেন তাতে বিএনপির সম্মান জানানো উচিৎ।