
গ্রাফিক্স: জনকণ্ঠ
একুশ শতকের বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে— "ব্লু ইকোনমি" বা নীল অর্থনীতি। এটি শুধু সমুদ্রসম্পদ ব্যবহারের কৌশল নয়, বরং টেকসই উন্নয়নের একটি দিক, যেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, পরিবেশ সংরক্ষণ ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তি একত্রে এগিয়ে চলে।
বাংলাদেশের জন্য ব্লু ইকোনমি এখন শুধু সম্ভাবনার আলো নয়, বরং ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক কৌশল। আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে ২০১২ ও ২০১৪ সালে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে প্রায় ১,১৮,৮১৩ বর্গকিলোমিটার নতুন সামুদ্রিক এলাকা অর্জন করে। এই বিশাল সমুদ্রসীমা আমাদের জন্য সম্ভাবনায় ভরপুর একটি সম্পদ।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বিশ্বজুড়ে ব্লু ইকোনমির বাজারমূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন ডলার। প্রায় ৮০ কোটি মানুষ এই খাতের সঙ্গে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে যুক্ত। বিশ্বের বহু উপকূলীয় দেশ ইতোমধ্যে ব্লু ইকোনমিকে কেন্দ্র করে মাছ ধরা, জাহাজ নির্মাণ, বন্দর ব্যবসা, পর্যটন, জ্বালানি খনি ও নবায়নযোগ্য শক্তির উন্নয়নে ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে।
বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। বঙ্গোপসাগর থেকে প্রতিবছর প্রায় ৬.৫ লক্ষ টন সামুদ্রিক মাছ আহরণ করা হয়। কক্সবাজার, কুয়াকাটা ও দ্বীপাঞ্চলগুলো আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। এছাড়া গ্যাস ও খনিজের বিশাল সম্ভাবনা এখনো পুরোপুরি উন্মোচিত হয়নি।
ব্লু ইকোনমিকে ঘিরে বাংলাদেশের প্রায় ৩ কোটি মানুষ উপকূলীয় জীবিকায় জড়িত। এই খাতে সঠিক বিনিয়োগ ও পরিকল্পনা হলে তাদের জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত হতে পারে।
তবে এই সম্ভাবনার পথেও রয়েছে কিছু বড় চ্যালেঞ্জ। গভীর সমুদ্র গবেষণায় দেশের সক্ষমতা এখনো সীমিত। সমুদ্র নিরাপত্তায় দুর্বলতা, যেমন জলদস্যুতা ও বিদেশি জাহাজের অনুপ্রবেশ, উদ্বেগজনক। পাশাপাশি, অসতর্ক ব্যবহারে সামুদ্রিক পরিবেশ হুমকির মুখে পড়তে পারে। ব্লু ইকোনমির জন্য এখনো একটি সমন্বিত ও শক্তিশালী জাতীয় নীতিমালা সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়নি।
এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার ইতোমধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০২১ সালে জাতীয় ব্লু ইকোনমি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয় এবং গঠন করা হয় “ব্লু ইকোনমি সেল”। চট্টগ্রামে মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা, গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প, এবং পানিসীমা গবেষণার অগ্রগতি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ভবিষ্যতে ব্লু ইকোনমির উন্নয়নের জন্য দরকার আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ:
- গভীর সমুদ্র গবেষণা এবং তথ্যভিত্তিক নীতি গ্রহণ
- জেলেদের আধুনিক প্রশিক্ষণ ও সুরক্ষা
- অফশোর উইন্ড, ওয়েভ ও টাইডাল শক্তির মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ
- পরিবেশবান্ধব স্মার্ট প্রযুক্তির ব্যবহার
- আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে সমুদ্রসম্পদ ব্যবস্থাপনা
“সমুদ্রই ভবিষ্যতের শেষ সীমান্ত”— এই ধারণা এখন বাস্তব। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা কেবল একটি ভৌগোলিক সীমানা নয়, বরং একটি কৌশলগত অর্থনৈতিক সম্পদ। সঠিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই ব্লু ইকোনমি আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে এক নতুন গতি এনে দিতে পারে। সমুদ্রের গভীরে যে সম্ভাবনার স্বপ্ন লুকিয়ে আছে, সেটিকে বাস্তব করতে এখন সময়ের দাবি— সঠিক দিকনির্দেশনা ও সুদৃঢ় পদক্ষেপ।
লেখক: সুন্দরবন গবেষক (ইমেইল: [email protected])
এম.কে.