ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৩ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

চামড়া উন্নয়ন অর্থনীতির মূল্যবান খাত

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ১৮:১৭, ১১ জুন ২০২৫

চামড়া উন্নয়ন অর্থনীতির মূল্যবান খাত

সম্প্রতি সম্পন্ন হলো কোরবানি ঈদের মহা আড়ম্বর ও জৌলুস। গরু-ছাগল কোরবানি দেওয়ার পরবর্তী সময়টা খুব বেশি স্বস্তিদায়ক হয় না। সেখানে পশুর চামড়া নিয়েও মহাব্যস্ততা শুরু হওয়া পরিস্থিতির ন্যায্যতা। চামড়ার সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন দেশের স্বনামখ্যাত ব্যবসায়ীরা। চামড়া শিল্প পণ্যের চাহিদা এবং আর্থিক কর্মযোগ দেশ ও দশের সমৃদ্ধি আনতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যাওয়া যুগ-যুগান্তরের পরম নির্মাল্য। প্রতি বছর কাঁচা চামড়ার প্রক্রিয়াজাতকরণ নিয়েও নানামাত্রিক কর্মযোগ বিধিবিধান মতো সামলাতে হয়। এমনিতেই কোরবানি ঈদের সঙ্গে শুধু চামড়া নয় দূষিত বর্জ্যও পরিবেশ পরিস্থিতিকে বেসামাল করে তোলে। আর পশুর চামড়া বেচা-বিক্রিতেও থাকে এক নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা। যার সঙ্গে সম্পৃক্ত শুধু সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরাই নন বরং কোরবানির সূচনালগ্ন থেকেই অনেকের দায়বদ্ধতায় সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে হয়। বিভিন্নভাবে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় চামড়া যত্রতত্র ফেলে না রাখার অনন্য নির্দেশনা। চামড়া যেমন দেশের অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির মূল্যবানসূচক। পাশাপাশি খেয়াল রাখতে হবে যাতে এমন প্রয়োজনীয় পণ্যটি অসময়ে অযথা নয়ছয় না হয়। তার ওপর বিবেচনায় রাখতে হবে চার পাশের পরিবেশ পরিস্থিতি যেন অকারণে গন্ধ আর দূষণ প্রক্রিয়া থেকে সুরক্ষিত রাখা যায়। স্বাস্থ্য ঝুঁকির আশঙ্কাকে সেভাবে উড়িয়ে দেওয়া যায়ই না। কারণ স্বাস্থ্য সকল সুখের মূল। পারিপাশির্^ক দুর্বিষহ অবস্থার শিকার হওয়া যেমন বাঞ্ছনীয় নয়। একইভাবে অর্থকরী এই পণ্যটি যাতে সুষম অবস্থায় সংশ্লিষ্ট মানুষদের জীবনমান উন্নয়নে যথার্থ ভূমিকা রাখতে পিছু হটতে না হয় তাও আবশ্যক। 
এবার বিভিন্ন কারণে পশুর হাটেও ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগম অন্যবারের তুলনায় ততটা সহনীয় ছিল না। পরিস্থিতি পরিবেশও সারা বছরে পালন করা খামারি পশুর বিক্রিও কিছুটা রকমফের মোটেও স্বস্তিকর নয়। তবে কোরবানি যা হয়েছে তাও হিসাবের বাইরে কিছু নয়। মুদ্রাস্ফীতি আর অর্থনৈতিক মন্দা সারাবিশে^ শিকল পড়া এক দীর্ঘমেয়াদি অন্তর্জাল। দরকারি পণ্য সামগ্রী যখন রাস্তাঘাট থেকে যত্রতত্র আবর্জনার শিকার হয় তাও পারিপাশির্^ক অবস্থার জন্য আর এক মাত্রার বিপন্নতা তো বটেই। আর মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও পড়েন মাথায় হাত দেওয়ার অবস্থায়। পাইকারি থেকে খুচরা ব্যবসায়ীরা বছরের এই সময়টির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষার প্রহর গোনেন। লাভ-লোকসানের হিসেব নিকেশ তো থাকেই। আবার উপস্থিত ক্রয়-বিক্রয় মূল্যের চলমান অবস্থাকেও সামাল দিতে হয়। তার ওপর চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে কাঁচা লবণ নিতান্ত প্রয়োজনীয় বিষয়। নুন আনতে পান্তা ফুরায় এমনটা নয় কিন্তু। বরং নুনই হয় চামড়ার যথাযথ অবস্থায় থাকার নিয়ামক শক্তি। তথ্য উপাত্তে উঠে আসছে লবণের দামও নাকি বাড়তির দিকে। যা পুরো প্রক্রিয়াজাতকরণে তেমন প্রভাবও ফেলছে না। তবে ব্যবসায়ীদের মুনাফা অর্জনও সারা বছরের আর এক আর্থিক যোগসাজশের বিষয় তো বটেই। এখনো তীব্র তাপপ্রবাহে জনজীবন অতিষ্ঠ। মাঝে মধ্যে বৃষ্টির ধারায় কোনোভাবেই শীতল হচ্ছে না পরিবেশ। সেখানে আরও এক বিপত্তি। ভ্যাপসা গরমে জনজীবন কাহিল হওয়ার চরম দুঃসময়। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা আর কি! চামড়ার দাম অর্ধেকে নেমে আসাও ব্যবসায়ীদের মুনাফায় নানামাত্রিক ঘাটতি। গত বছর এই চামড়াই নাকি ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। এবার সেটাই ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত নেমে আসে। সত্যিই ক্রয়-বিক্রেতারাও চরম বিপাকে। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের এমন আর্থিক কর্মযোগের দুরবস্থাও চোখে সর্ষে ফুল দেখা। মেনে নেওয়াও কঠিন। গণমাধ্যম তেমন তথ্য উপাত্তে যথাযথ বাস্তবতা তুলে ধরছে। এবার নাকি চামড়া কিনতে ও সংরক্ষণে প্রশাসনিকভাবে লবণের সরবরাহ করাও একটি উত্তম ব্যবস্থা ছিল বলে মন্তব্য সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের। তবে তেমন সুযোগ সবার জন্য অবারিত না হওয়াও পরিস্থিতির নির্মমতা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাওয়া খবরও একই রকম। গত বছরের তুলনায় এবার দাম কমে যাওয়া সত্যি ট্যানারি ব্যবসায়ীরা প্রমাদ গুনছেন। সঙ্গে লাভ-ক্ষতির হিসাব কষাও শুরু হয়ে গেছে। তবে দুর্গন্ধময় আর পচনশীল এই মূল্যবান চামড়া কোনোভাবেই ফেলে রাখাও ন্যায্যতা পাবেই না। সঙ্গতকারণে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের লাভ-ক্ষতির ঊর্ধ্বে উঠে বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোানা পথই খোলা থাকছে না। লবণের দাম বেড়ে যাওয়াও তীব্র তাপপ্রবাহে চামড়া নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের আর্থিক লেনদেনের হিসাব গোছানো কঠিন হয়ে পড়েছে। দুই লাখ পঁয়ত্রিশ হাজার টাকার গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে মাত্র ৩০০ টাকায়। সেখানে ২৮ হাজার টাকায় ছাগল কিনে চামড়া বিক্রির অঙ্ক কোনোভাবেই মিলছে না। নামে মাত্র মূল্যে ১০ টাকায়। অনেকে চামড়া বিক্রি করতে না পারার অপদৃশ্যও সংশ্লিষ্টদের মাথায় হাত। চোখ কপালে ওঠার মতোই। আবার যারা সদ্য কাঁচা চামড়া কিনেছেন তারাও অস্বস্তিতে দুঃসময় গুনছেন। কারণ লবণাক্ত করা ছাড়া চামড়ার প্রক্রিয়াজাতকরণ দুঃসাধ্য এবং হাতের নাগালের বাইরে। 
আবার অঞ্চলভিত্তিক স্থানীয় মহাজনরাও বিচার-বুদ্ধি খাটিয়ে লোকসানকে যথাসম্ভব দূরে রাখতে সচেষ্ট থাকছেন। মৌসুমি কারবারিরা সত্যিই এখন চরম বিপন্নতায় দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। তার ওপর শুধু তাৎক্ষণিক ক্রয়-বিক্রয় নয় পরবর্তীতে তার মাশুল কতখানি দিতে হবে তাও অজানা এক দুর্বিপাক তো বটেই। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী এবার যথার্থভাবে চামড়ার দাম মোটেই ব্যবসায়ীদের অনুকূলে ছিলই না। দিনমজুরের মতো ব্যবসায়ীদের ঘণ্টা গুনে টাকা নেওয়ার দুরবস্থা। পুরো চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের লভ্যাংশ হাতে গোনার অবস্থা কি না সেটাও হিসাবের মধ্যেই থাকছে না। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিক জেলা-উপজেলায়ও গরুর চামড়া নাকি মাত্র ৩০০ টাকা আর ছাগলের চামড়ার দাম গুনতে হচ্ছে কোনোমতে ১০ টাকা। এই চামড়া কেনা-বেচার মধ্যেই উঠে আসছে নানামাত্রিক সংকট আর উপস্থিত বিষণ্নতা। সেখানে গত কয়েক বছরের বকেয়ার হিসাবও মেলানো কঠিন এক পথ। অনেক ব্যবসায়ীর নাকি কোটি থেকে লাখ লাখ টাকা অপরিশোধ্য বলে গণমাধ্যমের পাতা ভারি হচ্ছে। এবারের কোরবানির পরিমাণ গত বারের চেয়ে স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু মূল্যের হেরফেরে তা যেন আর এক বিপন্নতার সম্মুখ লড়াই। তবে বর্তমান অনর্বর্তী সরকার গরু-ছাগলের চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু সরকার প্রদত্ত নির্ধারিত মূল্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের যে দূরত্ব দাম ফারাক সেখানে নিজেদের মতো বেচা-বিক্রির নির্ধারণ করা যেন আর এক নিয়মনীতির অনুষঙ্গ। খোদ ব্যবসায়ীদেরই একটা লম্বা শৃঙ্খলাবদ্ধ শেকল থাকে, যা সময় অসময়ে মাথা চাড়া দিতে পিছপা হয় না। চিহ্নিত এমন শেকলে আটকানো ব্যবসায়ীরা সেভাবে হাতেনাতে ধরাও পড়ে না। শুধু গণমাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত থাকে মাত্র। 

প্যানেল

×