
রাজনীতি যখন হয়ে পড়ে ক্ষমতা রক্ষার কৌশলমাত্র, তখন মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন হয় অবহেলিত। ঠিক সেই প্রেক্ষাপটে নতুন এক প্রত্যয়ের বার্তা নিয়ে সামনে এসেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তাঁর উচ্চারিত স্লোগান, ‘দিল্লি নয়, পিণ্ডি নয়, নয় অন্য কোনো দেশ, সবার আগে বাংলাদেশ’ শুধু একটি বাক্য নয়, এটি এক নতুন রাজনৈতিক দর্শনের ঘোষণা। তারুণ্যের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সমাবেশে পল্টনে উপস্থিত লাখো মানুষ তাঁর সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে উচ্চারণ করেছেন ‘সবার আগে বাংলাদেশ’ এ যেন পুরো দেশের একত্রিত স্লোগান, একটি স্বাধীন জাতির স্বাভিমানী উচ্চারণ। এটি সেই আদর্শের পুনরুজ্জীবন, যার ভিত্তিতে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান গড়ে তুলেছিলেন বাংলাদেশপন্থী রাজনীতি।
এই স্লোগানের মধ্যেই ধ্বনিত হচ্ছে জাতীয়তাবাদ, আত্মমর্যাদা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার অবিচল অঙ্গীকার। তারেক রহমান অতীতে যখন ‘টেক ব্যাক বাংলাদেশ’ স্লোগান দিয়েছিলেন, সেটি ছিল ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের আওয়াজ। আজ তিনি ‘সবার আগে বাংলাদেশ’ প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলে দেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস, ভাষা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য নতুন প্রজন্মকে জাগাতে চাইছেন। এটি শুধু একটি সাংগঠনিক উদ্যোগ নয়, বরং একটি জাতীয় আদর্শের আধুনিক রূপায়ণ, একটি জাতীয় স্বপ্নের সাথে বাস্তবের আলিঙ্গন।
শহীদ জিয়ার পররাষ্ট্রনীতি ছিল স্পষ্ট, ‘দেশের অনেক বন্ধু আছে, কিন্তু প্রভু কেউ নয়।’ তাঁর উত্তরসূরি বেগম খালেদা জিয়াও একই নীতিতে ছিলেন অনড়। তিনি বলতেন, ‘ওদের হাতে গোলামির জিঞ্জির, আমাদের হাতে স্বাধীনতার পতাকা।’ বিএনপির ইতিহাসে এই জাতীয়তাবাদ শুধু বক্তৃতার মধ্যে সীমাবদ্ধ শব্দচয়ন নয়, এটি ছিল অস্তিত্বের লড়াই। আজ সেই ধারাবাহিকতাকে আধুনিক প্রেক্ষাপটে রূপ দিচ্ছেন তারেক রহমান, যিনি কেবল দলের নয়, বরং জাতির এক দূরদর্শী কণ্ঠস্বর হয়ে উঠছেন।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষের কৃষি অর্থনীতি জনজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ তিস্তা নদী। এই নদী পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সাথে সংযুক্ত থাকার কারণে, ভারতের আইন বহির্ভূতভাবে বাঁধ নির্মাণ এবং স্বেচ্ছাচারিতার কারণে তিস্তা হয়ে উঠেছে মানুষের দুর্ভোগের নাম। ‘জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাই’এই স্লোগান শুধু উত্তরের জনগণের হৃদয় ছুঁয়েছে এমন নয়, এটি হয়ে উঠেছে জাতীয় মর্যাদার ইস্যু। বিএনপির নেতৃত্বে যে বিশাল কর্মসূচি তিস্তার তীরে সংগঠিত হয়েছে, তা ছিল জনগণের সঙ্গে একাত্মতার প্রতীক। নদীর প্রতি ভালোবাসা, জীবন বাঁচানোর আকুতি এবং এক আন্তর্জাতিক সমস্যা সমাধানের জন্য রাজনৈতিক দলের দৃঢ় অবস্থান, সব মিলিয়ে এটি নতুন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিচ্ছে।
১৭-১৮ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচিতে তিস্তাপাড়ের ১১টি পয়েন্টে যে জনসম্পৃক্ত আন্দোলন হয়েছে, সেখানে শুধু রাজনৈতিক নেতা নয়, কৃষক, শ্রমিক, পরিবেশকর্মী, শিক্ষার্থী, সাধারণ জনগণ সবাই এক কাতারে দাঁড়িয়েছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, রংপুর অঞ্চলের নেতৃত্ব ও তৃণমূল নেতাকর্মীরা জনগণের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অবস্থান নিয়েছেন। এই পদক্ষেপ রাজনৈতিক চর্চার গতানুগতিক পথ ভেঙে জনগণের হৃদয়ে গাঁথা হয়ে গেছে।
ভারত যখন একতরফাভাবে তিস্তার প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে উত্তরবঙ্গকে মরুকরণ করছে, তখন তা শুধু একটি নদী বণ্টনের সমস্যা নয়, এটি পরিণত হয়েছে মানবিক বিপর্যয়ে। বিএনপির বক্তব্য স্পষ্ট, তিস্তা কেবল একটি নদী নয়, এটি উত্তরাঞ্চলের কৃষক, শ্রমজীবী ও গ্রামীণ অর্থনীতির জীবনরেখা।
তারেক রহমান বলেছেন, ‘প্রতিবেশী দেশ যদি তিস্তার ন্যায্য হিস্যা দিতে দেরি করে, তাহলে আমাদের আন্তর্জাতিকভাবে সব পথ বেছে নিতে হবে।’ তিনি ১৯৯৭ সালের পানি প্রবাহ কনভেনশন ও ব্রাদার কনভেনশনে বাংলাদেশের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা বলছেন। তাঁর নেতৃত্বে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তিস্তা হবে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকারের একটি ইস্যু, যেখানে থাকবে নদী পুনঃখনন, আধুনিক জলাধার নির্মাণ, উন্নত সেচ ব্যবস্থা ও নদীকেন্দ্রিক অর্থনীতি গড়ে তোলার বিস্তারিত পরিকল্পনা।
সে মহাযজ্ঞের ধারাবাহিকতায় ৪ মে রংপুরের শাপলা চত্বরে অনুষ্ঠিত হয় গণপদযাত্রা, যা সেই আন্দোলনকে দিয়েছে এক উন্মাতাল গণজাগরণের রূপ। পাঁচ জেলার জনতা সমবেত হয়েছে রাজপথে, তিস্তাকে বাঁচাতে, ন্যায্য পানির দাবিতে। স্লোগানে স্লোগানে মুখর রংপুরের আকাশ বাতাস যেন বলে উঠেছে, তিস্তা শুধু এক নদীর নাম নয়, এটি এক জাতির আত্মমর্যাদার প্রতীক। এই আন্দোলন নতুন এক আশার আলো জ্বালিয়েছে উত্তরবঙ্গের হৃদয়ে।
বিএনপির পররাষ্ট্রনীতি সবসময় ছিল মর্যাদাভিত্তিক। দেশের ভেতরে যেমন আত্মমর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখতে বিএনপি সংগ্রাম করেছে, তেমনি বাইরের সম্পর্কেও তারা চায় সমতা ও সম্মানের ভিত্তি। ভারতীয় আগ্রাসন, তিস্তা ইস্যুতে সরকারের নীরবতা, আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশন প্রাঙ্গণে হামলা কিংবা বিতর্কিত ওয়াক্ফ বিল, এই প্রতিটি ঘটনায় বিএনপি যে সাহসী ও প্রাসঙ্গিক প্রতিবাদ করেছে, তা প্রমাণ করে, তারা আপসহীন।
৮ ডিসেম্বর ভারতীয় হাইকমিশনের সামনে স্মারকলিপি প্রদান, ১১ ডিসেম্বর আখাউড়ায় লংমার্চ, এসব কার্যক্রম একটি শক্তিশালী এবং সুসংহত পররাষ্ট্রনীতি পুনর্গঠনের অঙ্গীকার। কিছুদিন আগে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জাতিসংঘের ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার জন্য করিডোর দিতে চাইলে সর্বপ্রথম আওয়াজ তোলেন বিএনপির মহাসচিব।
আজ যখন চারদিকে দাসত্ব ও নির্লজ্জ পররাষ্ট্রনীতির উদাহরণ দেখা যায়, আমরা দেখেছি কীভাবে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার একটি দেশের সেবাদাসে পরিণত হয়েছিল। তখন তারেক রহমানের দূরদর্শী অবস্থান প্রমাণ করে তিনি কেবল রাজনৈতিক উত্তরসূরি নন, তিনি এক জাতীয় আন্দোলনের অভিভাবক।
বিএনপি আজ শুধু একটি দল নয়, এটি হয়ে উঠেছে এক দর্শনের প্রতীক যেখানে জাতীয় স্বার্থ সবার ওপরে। দাসত্ব নয়, সমমর্যাদা; তোষণ নয়, কূটনৈতিক সাহস; ক্ষমতার লোভ নয়, মানুষের পাশে দাঁড়ানো, এই আদর্শে বিশ্বাসী তারেক রহমান ও বিএনপি।
তিস্তা আন্দোলন, ‘সবার আগে বাংলাদেশ, প্ল্যাটফর্ম ও ‘টেক ব্যাক বাংলাদেশ’- এর মতো স্লোগান একে একে প্রমাণ করছে বাংলাদেশপন্থী রাজনীতির বাতিঘর হচ্ছে বিএনপি। আগামী দিনের নেতৃত্বে এই দল থাকলে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ব কেবল রক্ষিতই হবে না, বরং গৌরবের নতুন দিগন্তে পৌঁছাবে, শহীদ জিয়া এবং দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মত করেই বাংলাদেশপন্থী রাজনীতির অগ্রভাগে থাকবেন তাঁদেরই সুযোগ্য উত্তরসূরি তারেক রহমান।
লেখক : রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক
প্যানেল