ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৩ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

রোগীর সুস্থতা নয়,মুনাফাই মুখ্য: জীবন বাঁচানোর ওষুধে চলছে নির্মম ব্যবসা

আতিয়া ইবনাত রিফাহ্, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: ২২:০১, ১১ জুন ২০২৫

রোগীর সুস্থতা নয়,মুনাফাই মুখ্য: জীবন বাঁচানোর ওষুধে চলছে নির্মম ব্যবসা

ছবি: সংগৃহীত

স্বাস্থ্য মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। অথচ আমাদের চারপাশে যখন অসুস্থতা গ্রাস করে, তখন দেখা যায় একটি অদৃশ্য শোষণব্যবস্থা কিভাবে এই অধিকারটিকে বিলাসবস্তুতে রূপান্তর করে ফেলে। বিশেষ করে ওষুধ যা রোগ প্রতিকারের প্রধান উপাদান, তা আজ এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি হয়ে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ তখনই ওষুধ কিনে যখন প্রয়োজন চরমে ওঠে। সেই সংকটময় মুহূর্তটিকে পুঁজি করে চালানো হয় এক নির্মম ও লোভী বাণিজ্য।


ওষুধ: জীবন রক্ষার উপকরণ না মুনাফার উৎস?

ওষুধের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে রোগ নিরাময় করা, মানুষের জীবন রক্ষা করা। কিন্তু এই জীবনরক্ষাকারী উপাদানটি এখন এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীর কাছে হয়ে দাঁড়িয়েছে কেবল লাভের উৎস। আমরা দেখতে পাই, সাধারণত মানুষ যখন অসুস্থ হয় তখনই ওষুধ কেনে। যা থেকে স্পষ্টত বোঝা যায় যে, একজন ভোক্তা তখনই এই পণ্যের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে যখন সে শারীরিকভাবে অক্ষম, অসহায় এবং বিকল্পহীন।

এই দুর্বল ও সংকটময় মুহূর্তগুলোকে ব্যবসায়ীরা "সুযোগ" হিসেবে ব্যবহার করে। তারা জানে, এই সময় একজন রোগীর পরিবার কতটা ভীত ও অসহায় থাকে, কতটা মরিয়া হয়ে ওঠে প্রিয়জনকে বাঁচাতে। সেই অনুভূতিগুলোকে মুনাফার ফাঁদে পরিণত করতে এসকল অসাধু ব্যবসায়ী দ্বিতীয়বার ভাবেন না। একে বলে "ইমোশনাল এক্সপ্লয়টেশন" বা আবেগ শোষণ।


কৃত্রিম সংকট: পরিকল্পিত বিশৃঙ্খলা

ঔষধ সংকট অনেক সময় প্রকৃত নয়, বরং কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বা ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির ওষুধ মজুদ করে রাখে এবং বাজারে সরবরাহ বন্ধ বা কমিয়ে দেয়। ফলাফলস্বরূপ, একটি নির্দিষ্ট ওষুধের জন্য রোগীর পরিবারকে এক দোকান থেকে আরেক দোকানে ছুটে বেড়াতে হয়। চাহিদা বাড়ে, সরবরাহ কম থাকে, তাই স্বাভাবিকভাবেই মূল্য বেড়ে যায়।

এই কৃত্রিম সংকটের পেছনে থাকে সুপরিকল্পিত সিন্ডিকেট। তারা বোঝে কোন ওষুধের চাহিদা কখন বাড়বে—ঋতু পরিবর্তন, মহামারি, বা কোনো বিশেষ রোগের প্রাদুর্ভাবের সময় তারা তাদের "স্টক" প্ল্যানমাফিক বাজার থেকে গায়েব করে। পরে দ্বিগুণ, তিনগুণ দামে বিক্রি করে।


রাত বাড়লেই দাম বাড়ে: হাসপাতালপাড়ার নির্দয় ব্যবসা

বিশেষত রাতের বেলায় দেখা যায় ওষুধের দাম হঠাৎ করে বেড়ে যায়। একটি ইনজেকশন যা দিনে ২০০ টাকায় পাওয়া যেত, সেটি রাত গভীর হতেই হয়ে যায় ৫০০ টাকা। হাসপাতাল এলাকা বা জরুরি ওয়ার্ডের আশপাশে গড়ে ওঠা ফার্মেসিগুলো মূলত "জরুরি ভিত্তিতে জীবন বাঁচানোর লোভ"কে পুঁজি করে এই দামের দৌরাত্ম্য চালায়।

রাত বাড়ে, আতঙ্ক বাড়ে, আর সেইসঙ্গে বাড়ে ওষুধের দাম। একটি অসুস্থ শিশুর মা, একজন ভেঙে পড়া বৃদ্ধ বাবা কিংবা এক মরণাপন্ন রোগীর স্ত্রীর আর্তচিৎকার তখন কেবলই "ক্রেতার" আওয়াজ হয়ে পৌঁছায় এসব অসাধু ব্যবসায়ীর কানে।


চেহারা ও পরিচ্ছদ দেখে দাম নির্ধারণ: শ্রেণি বিভাজনের নতুন মাত্রা

এমনকি অনেকে অভিযোগ করেন যে, ওষুধ বিক্রেতারা ক্রেতার আর্থিক অবস্থা অনুমান করার চেষ্টা করে তাদের পোশাক এবং চেহারা দেখে। যদি দেখা যায় ক্রেতা "শহুরে" পোশাক পরা বা আর্থিকভাবে ভালো অবস্থানে আছে, তাহলে তাকে দ্বিগুণ দাম বলা হয়। আবার গ্রামের কোনো নারী, হিজাব পরা কোনো তরুণী বা দরিদ্র চেহারার কেউ এলে তার সঙ্গে দাম নিয়ে দর কষাকষি করা হয়, অথবা অবজ্ঞাসূচক আচরণ করা হয়।

এই বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি সমাজে একটি অদৃশ্য শ্রেণি বিভাজন তৈরি করছে—স্বাস্থ্যসেবা যেন ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ভাগ হয়ে যাচ্ছে।


নিয়ন্ত্রণহীন বাজার ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা

বাংলাদেশে ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর (DGDA), স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ নানা সংস্থা রয়েছে। তবুও প্রতিদিন অসংখ্য অভিযোগ আসছে ওষুধের কৃত্রিম সংকট, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি এবং ভেজাল ওষুধের ব্যাপারে।

মূল সমস্যা হচ্ছে নিয়মনীতি থাকা সত্ত্বেও বাস্তবায়নে গাফলতি। মনিটরিং টিম মাঝে মাঝে অভিযান চালালেও তা দৃশ্যমান কোনো প্রভাব ফেলে না। কারণ, সিন্ডিকেট এতটাই শক্তিশালী যে তারা তাৎক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি সামলে নেয় এবং আবারও আগের অবস্থানে ফিরে যায়।


মানবিকতা বনাম মুনাফা: সমাজ কোথায় দাঁড়িয়ে?

স্বাস্থ্য খাতের মতো স্পর্শকাতর ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক লাভের চেয়ে মানবিকতার মূল্য থাকা উচিত ছিল অনেক বেশি। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে মনে হয়, মানবিকতা যেন ধনীদের জন্য বিলাসিতা আর গরিবদের জন্য স্বপ্ন মাত্র।

একটি দেশ তখনই উন্নত হয়, যখন তার নাগরিকেরা স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা পায়। অথচ আমাদের সমাজে এখনো রোগীকে ওষুধ কিনতে গিয়ে অপমানিত হতে হয়, সর্বস্ব বিক্রি করতে হয়, আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে একমাত্র জীবিত প্রিয়জনকে হারিয়ে ফেলতে হয় শুধু এক বোতল ইনজেকশনের অভাবে।


করণীয়: সম্ভাব্য সমাধান ও নীতি প্রস্তাবনা

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ, জনসচেতনতা এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার।

১. ওষুধের দাম নির্ধারণে স্বচ্ছ প্রটোকল: সরকারকে স্পষ্টভাবে সকল ওষুধের দাম নির্ধারণ করে ফার্মেসিতে সেই মূল্য তালিকা ঝুলিয়ে রাখার নির্দেশ দিতে হবে।

২. ২৪/৭ মনিটরিং টিম: বিশেষ করে হাসপাতাল এলাকায় নজরদারির জন্য ২৪ ঘণ্টার মনিটরিং টিম গঠন করতে হবে।

৩. সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে: কৃত্রিম সংকট তৈরি করা সিন্ডিকেট চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

৪. জনগণের অংশগ্রহণ: সাধারণ মানুষকেও সাহস করে অভিযোগ করতে হবে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে।

৫. সরকারি ওষুধ ব্যাংক: প্রত্যেক জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে সরকারি উদ্যোগে ওষুধ ব্যাংক চালু করে জরুরি ওষুধ বিনামূল্যে বা কম দামে সরবরাহ করতে হবে।

ওষুধ কেবল একটি পণ্য নয়—এটি মানুষের জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। একে ঘিরে ব্যবসা, মুনাফা বা অবিচারের কোনো স্থান নেই। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আমাদের সমাজে অসাধু ব্যবসায়ীরা এই ক্ষেত্রটিকেই পরিণত করেছে অন্ধ মুনাফার উৎসে। রাষ্ট্রের উচিত এই বিকৃত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া।

একটি সমাজ তখনই সভ্য, যখন সেখানে বিপদের সময় কেউ আরেকজনের দুর্বলতাকে পুঁজি করে না। আমরা সেই সভ্যতার মুখ কবে দেখবো?

Mily

×