ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৩ জুন ২০২৫, ২৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

মানবজাতি কি অক্সিজেন সংকটে পড়তে যাচ্ছে

মো. আবদুল বাকী চৌধুরী নবাব

প্রকাশিত: ১৭:৫০, ১১ জুন ২০২৫

মানবজাতি কি অক্সিজেন সংকটে পড়তে যাচ্ছে

মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন অপরিহার্য। মানবদেহে ৬৫ শতাংশ অক্সিজেন থাকে। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য অক্সিজেন প্রয়োজন। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গ্লুকোজ থেকে কোষে শক্তির সঞ্চার হয়। আসলে আমাদের দেহের প্রতিটি কোষে অক্সিজেন দরকার। যখন আমরা বাতাস থেকে শ্বাস নিই, তখন অক্সিজেনের অণুকণাগুলো ফুসফুসে প্রবেশ করে এবং তা আমাদের ফুসফুসের প্রকোষ্ঠের মধ্য দিয়ে রক্তে অতিবাহিত হয়। আশ্চর্য ব্যাপার হলো যে, অক্সিজেনের প্রাথমিক উৎস হলো গাছগাছালি। উল্লেখ্য, অক্সিজেন বা অম্লজান একটি রাসায়নিক মৌল, (এর প্রতীক # এবং পারমাণবিক সংখ্যা ৮ ও নিউট্রন সংখ্যা ৮)। অক্সিজেন শব্দটি দুটি গ্রিক শব্দ থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে; যেমন- অকসুস (‘অম্ল’) এবং গেন্যাস্(‘উৎপাদক’ বা ‘জনক’)। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানী অঁতোয়ান লাভোয়াজিয়ে অম্লজান নামটি উল্লেখ করেন। মজার ব্যাপার হলো যে, এই মৌলটি অন্যান্য মৌলের সঙ্গে সাধারণত সমযোজী বা আয়নিক বন্ধন দ্বারা যৌগ গঠন করে থাকে। আর উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার সময় এই মৌলটি উৎপন্ন হয় এবং এটি সব জীবের শ্বসনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। 
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, নিজের ভালো পাগলেও বোঝে। অথচ অক্সিজেন নির্ভরশীল মানুষ কি বেমালুম ভুলে গেছে যে অক্সিজেনের কারখানা বলে অভিহিত গাছপালার কথা? প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে আমরা সেই গাছপালা নিধন করে চলেছি। বুঝেও কেন বুঝছি না যে গাছপালা না থাকলে, আমরাও এ বিশে^ টিকে থাকতে পারব না। ইতোমধ্যে স্থূলভাবে বোঝা না গেলেও সূক্ষ্মভাবে অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে বন-বনানি হ্রাস পাওয়ার কারণে আমরা হয়তো অক্সিজেনের কারণে বিপদের মুখোমুখি হতে শুরু করেছি। উল্লেখ্য, আমরা ছোটবেলায় বিভিন্ন জনপদে আপনা থেকেই বেড়ে ওঠা কত গাছপালা ও ঝোপঝাড় দেখেছি। এখন সে রকম আর পরিলক্ষিত হয় না। সহজ কথায় বলতে পারি যে জীবকুলের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমান মানুষ নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারছে। এটা সত্য যে, প্রকৃতি সর্বসময় ভারসাম্য রক্ষা করে চলে এবং এর ব্যত্যয় ঘটলে প্রকৃতি রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। আর বলতে গেলে আমরা সেই রকম নেতিবাচক অবস্থার মুখোমুখি হতে শুরু করেছি। 
বিজ্ঞানীদের গবেষণায় বলা হয়েছে, একটি মাত্র পূর্ণবয়স্ক সুস্থ সবুজ পাতাযুক্ত গাছ ১০ জন মানুষের এক বছরের অক্সিজেন উৎপাদন করতে পারে এবং ৪৮ পাউন্ড কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে দুজন মানুষের অক্সিজেন বায়ুমণ্ডলে ছেড়ে দিতে পারে। একটি যাত্রীবাহী বাস ২৬ হাজার মাইল পথ চালানোর পর যে পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড ছাড়ে, এর বিপরীতে এক একর বনভূমির গাছ সেই পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করতে পারে। এদিকে একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোক প্রতিদিন ৫৫০ লিটার অক্সিজেন গ্রহণ করে। আর গড় আয়ু ৭০ বছর হলে সবমিলে ১৪ লাখ ৬ হাজার ২৫০ লিটার অক্সিজেনের আবশ্যক হয়। মজার ব্যাপার হলো যে, এ পরিমাণ অক্সিজেন তৈরি করে পূর্ণবয়স্ক মাত্র ১৭টি গাছ। এ ধরনের একটি গাছ বছরে প্রায় ১১৮ কেজি অক্সিজেন দিয়ে থাকে। শুনে হয়তো আশ্চর্য হবেন যে, অ্যালোভেরা বা ঘৃতকুমারী, নিমগাছ, স্নেইকপ্লান্ট, পিপলগাছ, অর্কিড গাছ রাতে প্রচুর পরিমাণ অক্সিজেন দেয়। সেহেতু অ্যালোভেরা বাড়ির ছাদ-আঙিনা এবং অর্কিড গাছ বিছানার পাশে রাখা সমীচীন। এদিকে নিমগাছ যেখানে থাকে, সেখানে শিশুদের শ্বাসকষ্ট ও হাঁপানি রোগ তুলনামূলক কম হয়। এদিকে তুলসী শুধু ২৪ ঘণ্টা ধরে অক্সিজেন সরবরাহ করে না এবং একই সঙ্গে পরিবেশকে শুদ্ধ রাখতে সহায়তা করে। তাছাড়া বাঁশ, পাইন, বটগাছ ইত্যাদি প্রচুর অক্সিজেন দিয়ে থাকে। উদহারণ হিসেবে এক্ষেত্রে যদি বাঁশ গাছের কথা বিবেচনা করি, তাহলে দেখি যে বাঁশ বন ৩০-৩৫ ভাগ বেশি অক্সিজেন ছাড়ে এবং একইসঙ্গে ৫-৬ গুণের অধিক কার্বন শোষণ করে থাকে। হয়তো আপনারা অবহিত আছেন যে, মরুভূমির দেশ সৌদি আরবসহ আরব বিশ্বের অনেক দেশে নিমগাছ রোপণ করার কারণে অক্সিজেন বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। 
বিশ্বে বনভূমির পরিমাণ ৮.৬০ বিলিয়ন হেক্টর। সেই হিসেবে বিশ্বের মোট ভূমির ৩০.৪ শতাংশ বনভূমি। এদিকে জাতিসংঘ বলেছে, বনভূমি বিশ্বে ৩০ শতাংশ অর্থাৎ ৪ মিলিয়ন হেক্টর বা ১৫ মিলিয়ন বর্গমাইল। আশ্চর্য হবেন যে, সুদূর প্রাচীনকালে পৃথিবীর প্রায় ৬০ শতাংশ ভূমি অনাবৃত বা খালি ছিল বলে বন-বনানীতে ভরা ছিল। কিন্তু মানুষের বন বিধ্বংসী কার্যকলাপে প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ১৩ মিলিয়ন হেক্টর বনভূমি নষ্ট বা ধ্বংস হচ্ছে। আর এইভাবে লাগাতার বনভূমি নষ্ট করার কারণে বিশ^ সভ্যতার স্বর্ণশিখরে এসেও পরিবেশ দূষণের কারণে মানুষসহ জীবজগৎ নিজেদের স্থায়িত্ব নিয়ে দিশাহারা। অধুনা বিজ্ঞানের বদৌলতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ জলে, স্থলে ও মহাশূন্যে আধিপত্য বিস্তার করলেও বনসম্পদ রক্ষায় মানুষ সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ। এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, বনভূমি আবহাওয়াকে আর্দ্র রাখে এবং সময়মতো বৃষ্টিপাত হওয়ার সুবাদে কাম্যফসল উৎপাদনের পথ সুগম করে। অথচ বনভূমি ধ্বংস হওয়ায় অনাবৃষ্টি, ভূমিধস, ভূগর্ভের পানির স্তর সীমাহীনভাবে নিচে নেমে চলছে। আর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শুধু বায়ুমণ্ডল উষ্ণ নয়, একইসঙ্গে মেরু অঞ্চলসহ পর্বতমালার বরফ গলে সমুদ্রের পানির স্তর বেড়ে যাচ্ছে বিধায় উপকূল অঞ্চলে লবণাক্ত পানি ঢুকে আর তেমন ফসল জন্মাতে পারছে না। 
এ বিশে^ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেক বন-বনানী থাকলে ১০টি চিরহরিৎ বনের বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। এগুলো হলো- আমাজন বনাঞ্চল; কঙ্গো বেসিন; নিউগিনি বনাঞ্চল; সুমাত্রার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রেইনফরেস্ট; বোসাওয়াস বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ; ওয়েস্টল্যান্ড নাতিশীতোষ্ণ বন; বোর্নিও নিম্নভূমি বনাঞ্চল; ভলদিভীয় নাতিশীতোষ্ণ বনাঞ্চল; পূর্ব অস্ট্রেলীয় নাতিশীতোষ্ণ বন এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় নাতিশীতোষ্ণ বনাঞ্চল। অবশ্য আমাদের ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের গুরুত্বও কম নয়। বস্তুত সব বনাঞ্চল নিয়ে কথা বললে, প্রবন্ধের কলেবর অনেক বড় হয়ে যাবে বিধায় সঙ্গতকারণেই বিশে^র ফুসফুস বলে খ্যাত শুধু আমাজন বনভূমির ওপর কিছুটা আলোকপাত করছি। এই বনভূমি থেকে উৎপাদিত হয় বিশে^র ভূমিস্থ মোট অক্সিজেনের শতকরা ২০ ভাগ। শুধু তাই নয়, এখানে প্রায় ২০০ কোটি টন কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণের মাধ্যমে পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা করার পথ সুগম করে থাকে। অবশ্য অবশিষ্ট শতকরা ৮০ ভাগ অক্সিজেন পৃথিবীর অন্যসব বনে উৎপাদিত হয়। যদিও অনেক বিজ্ঞানী এই মর্মে অভিমত ব্যক্ত করেন যে, সামুদ্রিক প্ল্যাঙ্কটন প্রচুর অক্সিজেন উৎপাদন করে থাকে। বস্তুত দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদীর অববাহিকায় প্রায় ৭ লাখ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ৬ লাখ বর্গকিলোমিটার বনভূমি দ্বারা আবৃত। এ বনভূমির ৬০ শতাংশ ব্রাজিল, ১৩ শতাংশ পেরু, ১০ শতাংশ কলম্বিয়া, বাকি ১৭ শতাংশ বলিভিয়া, ইকুয়েডর, ফরাসিগায়ানা, গায়ানা, সুরিনাম ও ভেনিজুয়েলা জুড়ে বিস্তৃত। আর এই বিশাল বনে ১৬ হাজার ৩৯০ বিলিয়ন গাছ, যা ১৬ হাজার প্রজাতিতে বিভক্ত। এখানের বেশির ভাগ বৃক্ষ চিরহরিৎ। তাছাড়া এ বনাঞ্চল বিশ্বের সবচেয়ে বড় জীববৈচিত্র্যের সমৃদ্ধ ক্রান্তীয় বর্ষাবন। কিন্তু মানুষ কর্তৃক ধ্বংসযজ্ঞসহ দাবানলে বহু বার আমাজন বনভূমি পুড়ে ও ভূমিক্ষয়ে এর পরিমাণ দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের একজন বিজ্ঞানী আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, এইভাবে অপরিকল্পিত ধারায় গাছপালা নিধনের কারণে আমাজন আগামী ৫০ বছরের মধ্যে হয়তো বিলীন হয়ে যেতে পারে। এ প্রশ্ন কি উঠে আসে না যে, গাছপালা হলো অক্সিজেন তৈরির কারখানা। আর সেই কারখানা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে বিধায় অক্সিজেন সরবরাহ সেভাবে কমে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে কার্বন বেড়ে যাচ্ছে। আর এর সত্যতা আমরা তো দেখতেই পাচ্ছি। কেননা কার্বন বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে প্রকৃতি অশান্ত হয়ে পড়েছে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে।  
পরিশেষে এই বলে ইতি টানছি যে, আমাদের নিজেদের এ বিশ্বে টিকে থাকার জন্য গাছপালা অপরিহার্য, বলতে গেলে এর কোনো বিকল্প নেই। তাই তরুরাজিকে হেলায় উপেক্ষা না করে যেন যত্নশীল হই। আর আমরা নিজেদের যেমন মর্যাদা দেই; ঠিক আমাদের বাঁচার স্বার্থে গাছ-গাছালিকে যেন সেই মাত্রায় আসন দিই।
লেখক : গবেষক, অর্থনীতিবিদ 
[email protected]/www.goonijon.com

প্যানেল

×