
ছবি: জনকন্ঠ
একসময়ের প্রবাহিত প্রাণচঞ্চল আড়িয়াল খাঁ নদ এখন মৃত প্রায়। কালের আবর্তনে মানবসভ্যতার আধুনিকায়নের ছোঁয়ায় দিনে দিনে ধ্বংসের দিকে প্রতীয়মান হচ্ছে বিখ্যাত এই নদ।
পাঁচ কিলোমিটার জায়গায় পাঁচটি বাঁধ আড়িয়াল খাঁ নদের বুকের ওপর। সেই বাঁধগুলোর উপর দিয়েই তৈরি করা হয়েছে কংক্রিটের সড়ক। সড়ক দিয়ে চলছে যানবাহন। দুটি বড় বাঁধ বর্তমানে ব্যস্ত সড়কে পরিণত হয়েছে। নদে বাঁধ দেওয়ার ফলে বাঁধের দুই পাশে গড়ে উঠেছে ব্যক্তি মালিকানাধীন দোকানপাট ও স্থাপনা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে সরকারি নদের উপর প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই কিভাবে এসব বাঁধ দেওয়া সম্ভব? সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দখল ও দূষণ। ফলে একসময়ের খরস্রোতা আড়িয়াল খাঁ এখন অস্তিত্ব সংকটে। এক নদে এত বাঁধ দেওয়ার ফলে মরা লাশে পরিণত হয়েছে আড়িয়াল খাঁ। বর্তমানে দৃশ্যমান এই নদে সরকারি ইজারার মাধ্যমে মাছ চাষের খামারে পরিণত করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ময়মনসিংহ, ভৈরব ও নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আড়িয়াল খাঁ নদ দিয়ে একসময় নৌ-পথে যোগাযোগ ও মালামাল পরিবহণ করা হতো। কিন্তু এখন এই নদে পানি নেই। নদের পাঁচ কিলোমিটার জায়গা মরে গেছে। এই বর্ষায় পানির প্রবাহিত ঢেউয়ের তালে তালে দূরদূরান্তের নৌকার যাতায়াত ছিল প্রতীয়মান। কিন্তু আজ নদের উপর শুধু কচুরিপানার অস্তিত্বের দেখা মেলে।
আড়িয়াল খাঁ নদের উৎপত্তি কিশোরগঞ্জের পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে। সেখান থেকে এটি শাখা হয়ে কটিয়াদী সদরের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুলিয়ারচর পর্যন্ত চলে গেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলা সদরের থানার সামনে থেকে জালালপুর ইউনিয়নের ঝাকালিয়া পর্যন্ত একটি বাঁধ, কটিয়াদীর বীর নোয়াকান্দি-জালালপুরের চরনোয়াকান্দি বা খামখেয়ালির বাজারে দ্বিতীয় বাঁধ, কটিয়াদীর বরাদিয়া-জালালপুরের ফেকামারায় তৃতীয় বাঁধ, কটিয়াদীর চরিয়াকোণা-জালালপুরের ফেকামারায় চতুর্থ এবং লোহাজুরী-নাথের বাজারে পঞ্চম বাঁধ দেওয়া হয়েছে। প্রথম চারটি বাঁধ কটিয়াদী সদরের সঙ্গে জালালপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন অংশকে যুক্ত করেছে। আর শেষের পঞ্চম বাঁধটি লোহাজুরী ইউনিয়নের দুটি অংশকে যুক্ত করেছে।
বিভিন্ন সময় বেআইনিভাবে নির্মিত পাঁচটি বাঁধের মধ্যে সর্বশেষ বাঁধটির আংশিক অপসারণের কাজ শুরু হয়েছিল বিগত সরকারের আমলে। তখন বাকিগুলোর ব্যাপারে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছিল প্রশাসন।
স্থানীয়রা আরো জানান, আড়িয়াল খাঁ নদের বুকে প্রথম বাঁধ নির্মাণ করা হয় আশির দশকে। কটিয়াদী থানার সামনে থেকে এক কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এই বাঁধের ওপর দিয়ে পাকা সড়কও হয়েছে। এর দুই পাশে এখন অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে যা ব্যক্তি মালিকানাধীন হিসেবে গণ্য করা হয়।
এই বাঁধের প্রায় দেড় কিলোমিটার পশ্চিমে জালালপুর অংশের খামখেয়ালি বাজার এলাকায় আরেকটি বাঁধ দেওয়া হয় ১৫ থেকে ১৮ বছর আগে। এটির উপরও ইট দিয়ে সড়ক তৈরি করা হয়েছে। এটাও এখন ব্যস্ত সড়কে পরিণত হয়েছে। এরপর একে একে আরও তিনটি বাঁধ নির্মাণ করা হয়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বিভিন্ন সময়ে উন্নয়নের নামে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির উদ্যোগে এসব বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। বাস্তবে বড় ধরনের কোনও উন্নয়ন হয়নি। অথচ নদ মরে যাচ্ছে সেই বাঁধ দেওয়ার পর থেকে। এক নদে এত বাঁধ দেওয়ার ফলে মরা লাশে পরিণত হয়েছে আড়িয়াল খাঁ নদ।
বাঁধগুলোর কারণে নদের কোথাও সামান্য জলাধার, কোথাও কিছু জলাবদ্ধতা, কচুরিপানার জঞ্জালের চিহ্ন নিয়ে টিকে রয়েছে। জনগণের দাবি আড়িয়াল খাঁ নদের পানিপ্রবাহ ফেরাতে হবে। এতে যদি ওই সড়ক ও দোকানপাট সরাতে হয়, তাহলে তা-ই করা উচিত। চলাচলের জন্য সড়ক প্রয়োজন হলে সেতু করা যেতে পারে, তবে বাঁধ নয়।
সর্বশেষ নির্মিত বাঁধের বিষয়ে কটিয়াদী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাকুর রহমান বলেছিলেন, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির চার লাখ টাকায় ব্যয়ে বাঁধ ও সড়ক নির্মাণ করে জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ করেছি। এতে এলাকার উন্নয়ন হয়েছে।
এ ব্যাপারে কিশোরগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সাবেক কর্মকর্তারা বলেছিলেন নদের উপর বাঁধ দেওয়া সম্পূর্ণ বেআইনি। বাঁধ দেওয়ার সময় সংশ্লিষ্টরা পাউবোর মতামত নেননি। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখবো। এরপর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে এই কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধতা ছিল প্রশাসনের। এরপর অনেক বছর কেটে যায় তবুও এই বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
স্থানীয়রা অভিমত প্রকাশ করে বলেন, বিগত সরকার পতনের পর বর্তমান সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় উদ্যোগে সারাদেশের পরিত্যক্ত এবং অবৈধভাবে দখলকৃত এসব নদী,খাল ভূমি উদ্ধারের বিষয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা রয়েছে। তাই সরকারের প্রতি আমাদের আহ্বান থাকবে যেকোনো মূল্যেই হোক আমাদের এই হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী আড়িয়াল খাঁ নদের নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার যেন অতি দ্রুত আইনি পদক্ষেপের মাধ্যমে এই মানবসৃষ্ট বিলুপ্তির হাত থেকে এই নদ রক্ষা ও পুনরুদ্ধারে যথার্থ ভূমিকা পালন করে।
Mily