
ইসলামের ইতিহাসে ঈদুল আজহা শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় উৎসব নয়; এটি মানব আত্মত্যাগ, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, এবং খাঁটি ঈমানের এমন এক প্রতীক যা যুগে যুগে আলোকবর্তিকার মতো পথ দেখিয়েছে গোটা মানবজাতিকে। ঈদুল আজহার প্রকৃত বার্তা হলো—নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সবকিছু উৎসর্গ করে দেওয়ার এক অন্তর থেকে উৎসারিত মহান সিদ্ধান্ত।
পবিত্র কুরআনের ভাষায়:
قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
“বলুন, আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মৃত্যু—সবকিছুই মহান আল্লাহ, জগতসমূহের প্রতিপালকের জন্য।”
(সূরা আন’আম: ১৬২)
এই আয়াত মুসলমানের জীবনের পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনা। ঈদের পশু কোরবানির বাইরেও, একজন মুমিনের প্রতিটি শ্বাস, তার জীবনযাপন, এমনকি মৃত্যুও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই হওয়া উচিত। কোরবানির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া—আল্লাহভীতি ও তাঁর আদেশের প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ।
ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর কোরবানির ঘটনা আমাদের সামনে এমন এক আত্মত্যাগের আদর্শ তুলে ধরে, যা কেবল ঐতিহাসিক নয়, বরং মুসলিম উম্মাহর প্রতিটি সদস্যের জন্য চিরন্তন পথনির্দেশ। ইব্রাহিম (আ.) তাঁর প্রিয় সন্তানকে আল্লাহর পথে কোরবানি করতে দ্বিধাহীনভাবে প্রস্তুত হয়েছিলেন—এ এক চরম ঈমান, এক নিখুঁত বিশ্বাস।
মহান আল্লাহ তা'আলা বলেন,
لَن يَنَالَ ٱللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلَٰكِن يَنَالُهُ ٱلتَّقْوَىٰ مِنكُمْ
“তাদের গোশত বা রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, বরং পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।”
(সূরা হজ: ৩৭)
আজকের বাস্তবতায়, যখন মুসলিম উম্মাহ আত্মবিস্মৃত, বিভক্ত, ও নৈতিক দিক থেকে দুর্বল, তখন ঈদুল আজহার এই বার্তা নতুনভাবে আমাদের আত্মজিজ্ঞাসায় ডেকে আনে। প্রশ্ন ওঠে—পশু কোরবানির পাশাপাশি আমরা কি নিজেদের নফস, লোভ, অহংকার ও দুনিয়াপ্রীতি কোরবানি করছি?
সভ্যতার ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—প্রতিটি মহান পরিবর্তন, প্রতিটি ইসলামী জাগরণ গড়ে উঠেছে ত্যাগ, অশ্রু ও রক্তের বিনিময়ে। রাসূলুল্লাহ (সা.), সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন এবং পরে উম্মাহর শ্রেষ্ঠ সন্তানরা তাদের জীবন, সম্পদ, ঘরবাড়ি—সব কিছুর কোরবানি দিয়ে কায়েম করেছিলেন ন্যায়, সত্য ও দ্বীন ইসলামের ভিত্তিভূমি।
মুসলমান মাত্রই ঈদুল আজহার দিনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবে—
আমি নিজেকে কোরবানি করবো আল্লাহর জন্য। জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্তে, প্রতিটি ত্যাগে, আমি তাকওয়াকে প্রাধান্য দেবো। শুধু পশু জবাই নয়, জবাই হবে আমার ভিতরের অন্যায় আকাঙ্ক্ষা।
ঈদুল আজহার প্রকৃত শিক্ষা হলো:
১. পশুর জবাইয়ের পাশাপাশি জবাই করতে হবে নিজের ভেতরের পশুত্বকে।
২. ত্যাগ করতে হবে অন্যায় কামনা, দুনিয়াপ্রীতি ও আত্মমগ্নতা।
৩. নফসের কোরবানিই প্রকৃত ঈমানদারির ভিত্তি।
এই আত্মত্যাগই ইসলামী সভ্যতার ভিত্তিপ্রস্তর। কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে যারা ভবিষ্যতের সভ্যতা নির্মাণ করতে চায়, তাদের জন্য ঈদুল আজহার বার্তা শুধু স্মরণ নয়, এক চলমান সংগ্রামের প্রস্তুতি।
এভাবেই ঈদুল আজহার প্রকৃত শিক্ষা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে আমরা তৈরি করতে পারি সেই ভবিষ্যৎ, যেখানে ইসলামী সভ্যতা আবারও ন্যায়ের প্রতীক, মানবিকতার আশ্রয়, ও শান্তির অভিভাবক হয়ে দাঁড়াবে।
আমরা বিশ্বাস করি—
"বান্দার অশ্রুর ফোঁটা ও রক্তের ফোঁটাই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়। আর সেই ত্যাগের রক্তেই লেখা হয় আগামী দিনের বিজয়।"
সানজানা