
ছবি: প্রতীকী
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় ইন্টার্নশিপ ক্রমেই অপরিহার্য হয়ে উঠছে। একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন ছাড়া বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক চাকরির বাজারে সফল হওয়া কঠিন। বিশেষ করে, যারা ইঞ্জিনিয়ারিং, বিজনেস স্টাডিজ, তথ্য প্রযুক্তি (আইটি), ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট, মিডিয়া স্টাডিজ এবং অন্যান্য পেশামুখী বিষয়ে পড়াশোনা করছেন, তাদের জন্য ইন্টার্নশিপ একাডেমিক ক্রেডিটের বাধ্যতামূলক অংশ হয়ে উঠেছে।
তবে প্রশ্ন হলো, ইন্টার্নশিপ কতটা কার্যকর? এটি শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ও ক্যারিয়ার জীবনে কীভাবে ভূমিকা রাখছে? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইন্টার্নশিপ কতটা বাস্তবসম্মত এবং এর চ্যালেঞ্জগুলো কী?
একাডেমিক শিক্ষার পরিপূরক হিসেবে ইন্টার্নশিপ
বাংলাদেশের নিয়োগকর্তাগণ শুধুমাত্র সিজিপিএ নয়, বরং প্রার্থীর বাস্তব অভিজ্ঞতার ওপরই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। অথচ, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগ কোর্স এখনো বইভিত্তিক শিক্ষায় সীমাবদ্ধ, যেখানে বাস্তব সমস্যার সমাধান বা কর্পোরেট পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর অনুশীলন কম।
একজন শিক্ষার্থী শুধুমাত্র ক্লাসরুমের পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে তাত্ত্বিক জ্ঞান অর্জন করতে পারেন; তবে ইন্টার্নশিপের মাধ্যমে তারা সেই জ্ঞান বাস্তবে প্রয়োগ করতে শিখেন। উদাহরণস্বরূপ, বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থী মার্কেটিং কৌশল শিখলেও, ইন্টার্নশিপের সময় তিনি বাস্তবে কাস্টমার এনগেজমেন্ট, ব্র্যান্ডিং ও কনজ্যুমার বিহেভিয়ার পর্যবেক্ষণ করতে পারেন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একাডেমিক ক্রেডিটের জন্য ইন্টার্নশিপ বাধ্যতামূলক কেন?
শিক্ষাকে বাস্তবতার সাথে সংযুক্ত করা
বর্তমানে দেশের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় ইন্টার্নশিপকে একাডেমিক ক্রেডিটের আওতাভুক্ত করেছে। এটি শিক্ষার্থীদের শিল্পখাতের সাথে সংযোগ তৈরি করতে, বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে এবং কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুত হতে সাহায্য করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম ও বাস্তব কাজের মধ্যে ব্যবধান কমানোর জন্য ইন্টার্নশিপ অত্যন্ত কার্যকর। উদাহরণস্বরূপ, বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি সহ বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন অনুষদে ইন্টার্নশিপ ক্রেডিট আওয়ারের আওতায় বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
চাকরি বাজারে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রাখা
বাংলাদেশের চাকরির বাজার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ৬০% শিক্ষার্থী যারা ইন্টার্নশিপ করেছেন, তারা গ্র্যাজুয়েশন শেষের তিন মাসের মধ্যেই চাকরি পেয়েছেন।
BASIS-এর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, আইটি ও সফটওয়্যার কোম্পানিগুলোর ৭৫% নিয়োগকর্তা নতুন গ্র্যাজুয়েটদের ক্ষেত্রে ইন্টার্নশিপ করা শিক্ষার্থীদের বেশি অগ্রাধিকার দেন।
সফট স্কিল ও প্রফেশনালিজম অর্জন
শুধুমাত্র একাডেমিক জ্ঞান থাকলেই চাকরি পাওয়া সম্ভব নয়। নিয়োগকর্তারা আজকাল এমন প্রার্থী খোঁজেন, যারা যোগাযোগ দক্ষতা, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা, দলগত কাজের অভিজ্ঞতা এবং কর্পোরেট সংস্কৃতিতে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন।
Harvard Business Review-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৭৫% নিয়োগকর্তা সফট স্কিলকে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থীদের এই দক্ষতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
গবেষণা ও প্রকল্পের জন্য বাস্তব অভিজ্ঞতা
অনেক শিক্ষার্থীর থিসিস, ফাইনাল ইয়ার প্রজেক্ট বা রিসার্চ ওয়ার্কের জন্য বাস্তব ডেটা ও অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। ইন্টার্নশিপ সেই সুযোগ এনে দেয়, বিশেষ করে বিজনেস, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ডেটা সায়েন্সের শিক্ষার্থীদের জন্য এটি অত্যন্ত কার্যকর।
নেটওয়ার্কিং ও ক্যারিয়ার সংযোগ বৃদ্ধি
ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযোগ তৈরির সুযোগ দেয়, যা পরবর্তী সময়ে চাকরি পেতে সাহায্য করে।
বাংলাদেশের একাডেমিক ইন্টার্নশিপ বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ
বর্তমানে দেশে ইন্টার্নশিপ বাধ্যতামূলক হলেও ৮০% শিক্ষার্থী মনে করেন তারা পর্যাপ্ত মানসম্পন্ন ইন্টার্নশিপের সুযোগ পান না। প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো হলো:
- যোগ্য প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়া – অনেক প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের প্রকৃত কাজের সুযোগ না দিয়ে শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতা রক্ষা করে।
- অবৈতনিক ইন্টার্নশিপ – বেশিরভাগ ইন্টার্নশিপে কোনো স্টাইপেন্ড বা ভাতা দেওয়া হয় না, যা অনেক শিক্ষার্থীর জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
- প্রশিক্ষণের অভাব – ইন্টার্নশিপের সময় শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না দেওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে তারা শুধুমাত্র কাগজপত্র সাজানো বা আনুষঙ্গিক কাজেই সীমাবদ্ধ থাকেন।
একটি মানসম্মত ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থীদের জন্য একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি বাস্তব দক্ষতা অর্জনের সেতুবন্ধন। এটি শুধুমাত্র ডিগ্রি সম্পন্ন করার শর্ত নয়, বরং কর্মজীবনে প্রবেশের প্রস্তুতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে আরও বেশি সংযোগ স্থাপন করতে হবে এবং কোম্পানিগুলোকেও শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্মত ইন্টার্নশিপ নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নিতে হবে।
লেখক: এডটেক উদ্যোক্তা
এম.কে.